রেশম শিল্প একটি কৃষিভিত্তিক গ্রামীন কুটির শিল্প, যা গ্রামীন অর্থনৈতিক বিকাশে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এর মাধ্যমে স্বরোজগার দ্বারা মানুষকে শহরমুখী হতে বিরত করে এবং পরিবারের তথা গ্রামের আর্থিক উন্নতিতে সাহায্য করে।
আমরা জানি তুঁতগাছের পাতাই রেশম পোকার একমাত্র খাদ্য। এই তুঁত গাছের বৈশিষ্ট্য হোল এটি একটি বহুবর্ষজীবি, গভীর শিকড় বিশিষ্ট, পত্রঝাড় উদ্ভিদ, যা থেকে ১৫ – ২০ বছর পর্যন্ত উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে পাতা পাওয়া সম্ভব। গুণমান সম্পন্ন তুঁত পাতা খেয়ে রেশমপোকা উৎকৃষ্ট মানের রেশমগুটি তৈরী করে যা থেকে প্রথমে রেশম (সিল্ক ) সূতো এবং পরে তা থেকে রেশম বস্ত্র তৈরী হয়। এই রেশম সূতো/ রেশম বস্ত্র রপ্তানী করে আমাদের দেশ অনেক বৈদেশিক মুদ্রা (২০১৫ সালে ১৯৫৭ কোটি টাকা ) অর্জন করে। এর চাহিদা দেশে ও বিদেশে প্রবল। বিশ্বে মোট সিল্ক (২০১৫ সালে ২,০২,০৭৩ টন) উৎপাদনে চীনের স্থান প্রথম (১,৭০,০০০ টন – ৮৪%) এবং তারপরই ভারত বিশ্বের ১৪% সিল্ক উৎপাদন করে (২৮,৫২৩ টন ) দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। ভারতবর্ষে কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশের পরই পশ্চিমবঙ্গের স্থান সিল্ক উৎপাদনে তৃতীয় (২৫০০ টন) ।
উচ্চফলনশীল (পাতার ফলন-হেক্টর প্রতি বছরে ৪০-৪৫ টন) তুঁত প্রজাতির (এস-১৬৩৫) চাষের জন্য অন্যান্য পরিচর্যার (বারে বারে গাছ/ ডালপালা ছাঁটাই) সাথে সাথে অনুমোদিত উদ্ভিদ খাদ্য প্রয়োগ আবশ্যক, যা হোলো সেচ এলাকার জন্য হেক্টর প্রতি বছরে ২০ টন গোবর সার , ৩৩৬ কেজি নাইট্রোজেন, ১৮০ কেজি ফসফরাস ও ১১২ কেজি পটাশিয়াম। এগুলি বছরে ৫টি ফসলের জন্য ৫টি সমান ভাগে প্রয়োগ আবশ্যক । কিন্তু বর্তমান বিশ্বে রাসায়নিক সার থেকে উৎপাদিত তুঁত পাতা খাইয়ে এবং আন্যান্য কাজেও রাসায়নিক দ্বারা প্রস্তুত রেশম সূতো ও রেশম বস্ত্রের ব্যবহারে নানান চর্মরোগের সমস্যার জন্য আমদানিকারী দেশ সমূহ (আমেরিকা যুক্ত রাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান দেশ সমূহ, ইউ কে ইত্যাদি) অনীহা প্রকাশ করায় আমাদের দেশেও জৈব রেশম উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। তাই ভারত সরকারের আধীন কেন্দ্রীয় রেশম পর্ষদের আদেশানুসারে ১৯৯২ সাল থেকে কেন্দ্রীয় রেশম অনুসন্ধান ও প্রশিক্ষণ সংস্থা, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ বিশেষ উদ্ভিদ খাদ্য উপাদান তৈরী রক্ষণাবেক্ষণ, মানবর্দ্ধন এবং জৈব কৃষির দ্বারা তুঁত পাতা উৎপাদনে তার প্রয়োগ ও ফলাফল নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে।
রাসায়নিক সার, গোবর সার এবং অন্যান্য জৈবসারের বিভিন্ন উপাদানের কম-বেশী পরিমাণের মিশ্রণ যেমন, কেঁচোসার, কেঁচো/ কেঁচোর বেড ধোয়া জল, সবুজসার এবং দুই প্রকারের জীবাণুসার (এজোটোব্যাক্টর ও আরবাসকুলার মাইকোরাইজাল ছত্রাক) এবং কেবলমাত্র উৎকৃষ্ট কেঁচোসার (হেক্টর প্রতি বছরে ৩০ টন) বা সার বিহীন তুঁত চাষ, এইভাবে মোট ৬টি ট্রিটমেন্ট সহযোগে সেচসেবিত এলাকায় (যে জমিতে আগে দীর্ঘকাল ধরে অনুমোদিত মাত্রায় রাসায়নিক সার ও গোবর সার ব্যবহার করা হচ্ছিল) উন্নত উচ্চফলনশীল তুঁত প্রজাতি (এস – ১৬৩৫)-র উপর ৩ বছর ধরে একটি পরীক্ষা শুরু হয়।
ফলাফরে দেখা যায় বছরে ৫টি ফসল হিসাবে প্রথম দু বছর (১০ টি ফসল) উপরোক্ত জৈব উদ্ভিদখাদ্য উপাদানের বিভিন্নপরিমান সহযোগে, তুঁতপাতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, ফলন ও গুণগতমান অনুমোদিত রাসায়নিক এবং গোবরসার প্রয়োগের তুলনায় কম ছিল। কিন্তু ২ বছরের (১০টি ফসল) পর থেকে সবচেয়ে ভালো ফল পাওযা যায় যেখানে হেক্টর প্রতি বছরে ৩০ টন উচ্চমানের কেঁচোসার ব্যবহার করা হয়। শুধু তাই নয় তৃতীয় বছরের সামগ্রিক ফলাফল বিশ্লেষণে রাসায়নিক ও গোবরসার প্রয়োগের তুলনায় হেক্টর প্রতি বছরে ৩০ টন কেঁচোসারে অপেক্ষাকৃত ভাল ফল পাওয়া যায় যা নীচে বর্ণনা করা হল:
(ক) মাটির স্বাস্থ্য : মাটির অম্লত্ব কম, ইলেক্ট্রিক্যাল কনডাকটিভিটি বেশী, জৈব কার্বন, মোট নাইট্রোজেন, প্রাপ্ত ফসফরাস ও পটাশিয়াম, কার্বন- নাইট্রোজেন অনুপাত, মাটিতে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
(খ) তুঁত গাছ ও তুঁত পাতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য: তুঁত গাছের উচ্চতা, গাছ প্রতি শাকারর সংখ্যা/পাতার সংখ্যা, মোট কান্ডের দৈর্ঘ্য, পাতার পরিমাপ, পাতা – কান্ডের অনুপাত, গাছ প্রতি মোট ডালপালার পরিমাণ ও পাতার ফলন (হেক্টর প্রতি বছরে ৪৫,৩১৫ কেজি) ৬.৪১% বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্বের অন্তর্বর্তী দূরত্ব কম হওয়ায় , ডাল এবং পাতার সংখ্যা ও পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
(গ) পাতার গুণগত মান: হেক্টর প্রতি বছরে ৩০ টন কেঁচোসারে পাতার জলীয় পরিমান এবং প্রোটিন, রাসায়নিক ও গোবর সারের সমান পাওয়া গেছে। বাষ্পমোচনের হার, সালোকসংশ্লেষের হার ও মোট দ্রবণীয় প্রোটিন উপরোক্ত সহযোগে সমান বা জৈবসারে অল্প বৃদ্ধি পেয়েছে।
(ঘ) রোগ ও কীটপোকা: হেক্টর প্রতি বছরে ৩০ টন কেঁচোসার প্রয়োগে রোগ ও কীটপোকার আক্রমণ রাসায়নিক ও গোবরসার প্রয়োগের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে।
(ঙ) রেশম কীট পালন: অনুকূল ও প্রতিকূল পরিবেশে রেশম চাষ করে সামগ্রিকভাবে ১০ টি রেশম কীটের ওজন, রেশম গুটির ফলন, একক রেশম গুটির ওজন (মূককীট সহ), একক রেশমের ওজন (মূককীট ছাড়া) এবং ফলপ্রসু রেশমকীট পালনের হার রাসায়নিক ও গোবরসার প্রয়োগের তুলনায় হেক্টর প্রতি ৩০ টন কেঁচোসার দ্বারা প্রাপ্ত তুঁত পাতা খাইয়ে ভাল ফল পাওয়া গেছে।
(চ) রেসম গুটি কাটাই: গুটি কাটাই ক্ষমতা, রেশমের আনুপাত, রেশমের পরিমাণ, রেশম সূতোর দর্ঘ্য, সূতোর মোটাই (ডিনিয়র) এবং ১ কেজি রেশম সূতো তৈরী করতে রেশম গুটির পরিমাণ (রেনডিটা) ইত্যাদি অন্যান্য ট্রিটমেন্ট-সহযোগের তুলনায় হেক্টর প্রতি ৩০ টন কেঁচোসার প্রয়োগ দ্বারা প্রাপ্ত পাতা খাইয়ে রেশম গুটি কাটাই-তে ভাল হয়েছে।
(ছ) আর্থিক লাভ: হেক্টর প্রতি ৩০ টন কেঁচোসার প্রয়োগে আর্থিক লাভ সবথেকে বেশী পরিলক্ষিত হয়। সর্বোচ্চ নেট লাভ হেক্টর প্রতি বছরে ২২,৬৯৭ টাকা এবং প্রতি টাকায় সর্ব্বোচ্চ প্রাপ্তি ১ টাকা ৩৩ পয়সা। এই পরীক্ষায় কেঁচোসার ক্রয় করে (৫ টাকা প্রতি কেজি) প্রয়োগ দেখানোর জন্য যদিও খরচ একটু বেশী হয়েছে (হেক্টর প্রতি বছরে ৬৭,৯৩১ টাকা) কিন্তু রেশম চাষী তার তুঁত জমির বর্জ্য, অব্যবহৃত ও অভুক্ত তুঁতপাতা ও রেশমকীটের মল দিয়ে যখন কেঁচোসার তৈরি করে ঐ নির্দিষ্ট তুঁত জমিতে প্রয়োগ করবে তখন কেঁচোসারের মূল্য অনেকাংশে কমে যাবে, ফলে খরচও অনেক কমবে।
উপরোক্ত ফলাফল এটাই প্রতিপন্ন করে যে, উৎকৃষ্ট মানের কেঁচোসারের ক্ষমতা অসীম এবং অবশ্যই রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেহেতু এই পরীক্ষায় হেক্টর প্রতি বছরে মাত্র ৩০ টন কেঁচো সার প্রয়োগ করা হয়েছে এবং তাতেই ২ বছরের (দশটি ফসল) পর থেকে রাসায়নিক সারের তুলনায় ভাল ফল পাওয়া গেছে। তাই এই জৈব সারের পরিমাণ একটু বাড়িয়ে আরো অল্প সময়ে রাসায়নিক সারের তুলনায় এর থেকে আরও ভাল ফলাফল আশা করা যেতেই পারে। কারণ ধীরে ধীরে কেঁচোসার প্রয়োগ দ্বারা ২ বছরের পর থেকেই কেঁচো সারের নানা উপকারী জীবাণু (ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ইত্যাদি) মাটিতে বংশ বিস্তার করে একটি আদর্শ জীবাণুসমৃদ্দ পরিবেশ তৈরী করতে সক্ষম হয়। এই জৈবসার বা কেঁচোসার, গাছের বৃদ্ধির উপযোগী সমস্ত খাদ্যগুণ গাছ ধীরে ধীরে পায়, পরিবেশ বন্ধু, মাটির সুস্বাস্থ্য বজায় রাখে এবং খরচের সাশ্রয় করে। তাই অন্যান্য সমস্ত দিক থেকে উৎকৃস্ট কেঁচোসার একটি আদর্শ জৈব সার এবং শুধু তুঁত চাষ নয় সমস্ত রকমের চাষবাসে এটি বিশেষ উপযোগী।
- ডঃ সেতুয়া
- অভিষেক চক্রবর্তী