এই 20টি ব্যবস্থা পোল্ট্রি খামারকে বার্ড ফ্লু থেকে নিরাপদ রাখবে! ভার্মি কম্পোস্ট ইউনিটের জন্য ৫০% পর্যন্ত ভর্তুকি পাওয়া যাবে, শীঘ্রই আবেদন করুন এই হাইব্রিড জাতের টমেটো 900 কুইন্টাল প্রতি হেক্টর ফলন দেবে দুধের সঠিক সময় বেছে নিলে উৎপাদন বাড়বে, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
Updated on: 24 May, 2020 11:20 AM IST

ভারতবর্ষ চিরকালই একটি কৃষি প্রধান দেশ হিসাবে গণ্য হয়ে এসেছে। জনসংখ্যার খাতিরে বিচার করে দেখলে, খাদ্য চাহিদা এই দেশে চিরন্তন। তাই  ভারত সরকারের সরাসরি নজর থাকে কৃষি কাজের ওপরে এবং বিভিন্ন সময়ে ভারত সরকার দেশের কৃষিকাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সময়োপযোগী বিভিন্ন নতুন পরিযোজনা নিয়ে এসছে, যার মূল উদ্দেশ্য উৎপাদনশীলতা বজায় রাখা। বর্তমান কৃষি প্রকল্পগুলিকে ভালো ভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে বর্তমান ভারত সরকার কৃষিতে যে পথ এগোচ্ছে তার মূল ভাবনা হল সংরক্ষণ কৃষি” (Conservation agriculture). শেষ ১৫ থেকে ২০ বছরে কৃষি পরিযোজনা গুলি সেই দিকেই ইঙ্গিত করে,  যেমন ন্যাশানাল মিশন ফর সাস্টেনেবেল এগ্রিকালচার (NMSA),  কাস্টম হায়ারিং সেন্টার (CHC), ফার্ম মেকানাইজেসান বা কৃষিক্ষেত্রে যান্ত্রিক সহায়তা , জিরো টিলেজ ফারমিং (Zero tillage) ইত্যাদি।  তো আজ সবাইকে একটু ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করব এক সংরক্ষণ কৃষিকাজ সম্পর্কে, সম্পূর্ণটা কখনোই একটি মাত্র প্রতিবেদনে তুলে ধরা সম্ভব নয়, বিশ্বের তথা ভারতের বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সংরক্ষণ কৃষি নিয়ে রীতিমত সিলেবাস ধরে পড়ান হয়। এই  প্রতিবেদনে আপনারা মোটামুটি কিছু ধারনা পাবেন যেমন, বিষয়টা ঠিক কি? কৃষিক্ষেত্রে কিভাবে এর আগমন? বিশ্বে জুড়ে এর গ্রহণ যোগ্যতা এবং ভারত জানাব কেনই বা ভারত এই পথে এগোচ্ছে ইত্যাদি।

সংরক্ষণ কৃষি পদ্ধতির উৎস

সংরক্ষণ কৃষিকাজ সম্পর্কে বিশদে যাওয়ার আগে, এর উৎস বোঝার জন্য আমি আপনাদের কয়েকশ বছর আগে নিয়ে যেতে চাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৩০-এর সময়, তারা এক গভীর সমস্যার সম্মুখীন হয় যার পেছনে ছিল প্রথাগত কৃষিকাজ পদ্ধতির অনুশীলন। কৃষকরা জমিতে ফসল লাগানোর আগে সাধারণত ট্র্যাক্টর বা লাঙ্গলের মাধ্যমে জমি কর্ষণ করে থাকে, যাতে মাটি ভঙ্গুর ও আলগা হয়ে যায়। কিন্তু তাদের দেশে ঘূর্ণিঝড় বা হ্যারিকেন এর প্রাদুর্ভাব খুবই সাধারণ ঘটনা। তো সেই জমি কর্ষণ পরবর্তী সময়ে এই সমস্ত ঘূর্ণিঝড় বা হ্যারিকেনের মাধ্যমে তাদের শহরে প্রচুর পরিমাণে ধূলিকণা প্রবাহিত হতে থাকে যা শহরগুলিকে চরম অস্বস্তিতে ফেলতে শুরু করে। এই সমস্যার সমাধানের জন্য, সেই সময় অনেক গবেষণা এবং আলোচনা করা হয়েছিল। ফলস্বরূপ, এই সমস্ত কৃষি গবেষণার উপসংহারে তারা এই ধারনায় উপনীত হয় যে জমি কর্ষণ ছাড়াই করা সম্ভব এমন একটি নতুন কৃষিজাত ব্যবস্থা জরুরি। এই ভাবেই জন্ম হয় সংরক্ষণ কৃষিকাজের ধারনার।

সুতরাং, সংরক্ষণ কৃষিকাজ ১৯৩০ সালে শুরু হয়েছিল কিন্তু ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এটি তেমনভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে, যখন গবেষণা পরবর্তী সংরক্ষণ কৃষিকাজের ধারনাগুলি পরীক্ষামূলকভাবে সরাসরি কৃষিজমিতে প্রয়োগ করা হয়েছিল, তখন এটি অনেক ইতিবাচক ফলাফল অর্জন করেছি যা কৃষকদের দ্রুত সংরক্ষণ কৃষিকাজ সংক্রান্ত পদ্ধতিগুলি গ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করে। এরপর  ১৯৫০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত খুব সামান্য উত্থান ঘটেছিল - কেবল ২ মিলিয়ন-হেক্টর জমিতে সংরক্ষণ কৃষিকাজের প্রয়োগ হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই সংরক্ষণ কৃষি পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী গ্রহণ যোগ্যতা পায়।  এই সময়ে প্রতি বছর ১০০ লক্ষ্ হেক্টর জমি হারে প্রায় ১৮০০ লক্ষ্ হেক্টর জমিতে এর অনুশীলন করা হয়েছিল।

যে জায়গাগুলিতে সংরক্ষণ কৃষি পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি অনুশীলন করা হয় সেগুলির মধ্যে প্রথম হল ব্রাজিল, তার পরে আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া। এই মুহূর্তে ভারতে, আমরা বিভিন্ন ভাবে প্রায় ৩০ লক্ষ হেক্টর জমিতে এই সংরক্ষণ কৃষি পদ্ধতি অনুশীলন করে ফেলেছি।

সংরক্ষণ কৃষি পদ্ধতি কি?

এবার সরাসরি সংরক্ষণ কৃষিকাজ পদ্ধতির উপর সামান্য আলোচনা করছি। এই সংরক্ষণ কৃষিকাজের মূলত তিনটি নীতি রয়েছে:

১. ন্যূনতম জমি কর্ষণ (৩০% এর বেশি মাটিকে ঘাঁটানো যাবে না)

২. জৈববস্তুর সাথে মাটির সংযুক্তিকরণ (ফসলের অবশিষ্টাংশের সাথে মাটি মিশ্রিত করা)

৩. শস্য বৈচিত্র্যকরণ (একই টুকরো জমিতে এক বছরের ফসল চক্রে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদ্ধতিতে বিভিন্ন ফসল বপন করতে হবে)

ইতিপূর্বে সংরক্ষণ কৃষির যে বিশ্বব্যাপী সাফল্যের কথা উল্লেখ করেছি তা মূলত সম্ভব হয়েছিল বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চল বা যে অঞ্চলে বছরে কেবল একটি ফসল সংগ্রহ করা হয় সেই সমস্ত জায়গায়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া সহ আমাদের দেশে কৃষিকাজের ব্যবস্থাটি সেই অর্থে জটিল কারণ আমাদের কৃষিকাজে প্রাণীজ পালন ও মৎস্য চাষও জড়িত এছাড়াও, আমরা এমন একটি ফসল চক্র অনুসরণ করি যাতে ২ থেকে ৪ টি ফসলের ফলন করানো হয়ে থাকে, যার মধ্যে শস্য প্রজাতি ( ধান, গম ) এবং শাকসব্জী উভয়েই অন্তর্ভুক্ত, সেগুলির মধ্যে আবার কৃষকদের চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তা অনুসারে পরিবর্তন আসে। সুতরাং, দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে সংরক্ষণ কৃষির তিনটি নীতি প্রয়োগ করা খুব জটিল।

যার জন্য আমাদের এখানে সংরক্ষণ কৃষির থেকে সামান্য বাইরে গিয়ে সংরক্ষণ কৃষি ভিত্তিক সুস্থিতিশীল ব্যবহারিক প্রয়োগের (Conservation Agriculture-based Sustainable Intensification/CASI) ওপরে জোর দেওয়া হচ্ছে।

সংরক্ষণ কৃষি পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা

বর্তমানে আমরা ভারতীয় কৃষিতে কিছু সমস্যা সমাধান করতে চাইছি। আমরা বর্তমানে ভারতীয় কৃষিতে যে সমস্যার মুখোমুখি রয়েছি তা খুঁজে পেতে আমাদের আবারো একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে। 1960 সালে, যখন সবুজ বিপ্লব শুরু হয়েছিল। সেই সময় যা দেশের কৃষিক্ষেত্রে উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে সফল হয়েছিল কিন্তু তার মূল্যও আমাদের দিতে হচ্ছে। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল অত্যাধিক হারে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে ভারতবর্ষের কৃষিক্ষেত্রে জমির উর্বরতার উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। 

এরপর বর্তমান কৃষিজনিত সমস্যাগুলি দেখি তাহলে তাদের মানবসৃষ্ট ও প্রকৃতিক এই দুটি বিভাগে সাজানো যেতে পারে। মানবসৃষ্ট সমস্যার অধীনে মনোক্রপিং সিস্টেম আসে যার মধ্যে কেবল এক প্রকার ফসলই ধারাবাহিকভাবে বপন করা হয়। দ্বিতীয় সমস্যাটি হল উপযুক্ত সংস্থানের বা উপকরনের অভাবে নতুন স্থানে নতুন ফসল এবং শস্যের ফলনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারা। তৃতীয়টি হল অবশিষ্টাংশ জ্বলন্ত যা আজকাল একটি ভয়াবহ সমস্যা হয়ে উঠছে। চতুর্থটি হল অত্যাধিক জমি কর্ষণ অর্থাৎ কৃষিজমির বারবার লাঙ্গল করা যার ফলস্বরূপ মাটির পুষ্টির অবনতি ঘটে এবং বন্যা পদ্ধতির সেচ আরও একটি বড় সমস্যা। সুতরাং, আমরা আরও অনেক সমস্যা তৈরি করেছি।

অন্য শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক সমস্যাগুলি। যার মধ্যে প্রধান হল জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত সমস্যা (যেমন অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলবায়ুর অন্যান্য বিভিন্নতা), নতুন রোগের মতো জৈবিক প্রতিকূলতা সহ খরা, বন্যা, লবণাক্ততা, অম্লতা ইত্যাদির মতো অজৈবিক প্রতিকূলতারও মুখোমুখি হচ্ছি আমরা । যদি এই সমস্ত সমস্যাকে একসাথে দেখা হয় তবে তাদের প্রভাব কিন্তু খুব ভয়াবহ - জলের স্তর হ্রাস পাচ্ছে; মাটির স্বাস্থ্য খারাপ হচ্ছে; গ্লোবাল ওয়ার্মিং বাড়ছে; এবং সর্বোপরি কৃষিজমির উৎপাদন কম হচ্ছে।

এখন আমরা যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তা হল উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ও সেটি বজায় রাখা এবং ফসলকে জলবায়ু সংক্রান্ত প্রতিকূলতার থেকে রক্ষা করাও দরকার। তবে, এই সমস্ত সমস্যার সমাধান কী? সমাধান অনেকগুলি রয়েছে, তবে সেরাটি হল সংরক্ষণ কৃষি ভিত্তিক সুস্থিতিশীল অনুশীলন (Conservation Agriculture-based Sustainable Intensification/CASI)

সংরক্ষণ কৃষি ভিত্তিক সুস্থিতিশীল অনুশীলন (CASI) এবং সংরক্ষণ কৃষি দুটি সামান্য হলেও আলাদা, দ্বিতীয়টির চেয়ে প্রথমটি  অনেক বেশী সুবিস্তৃত। সংরক্ষণ কৃষিকাজ কেবল জমি কর্ষণ, ফসল অবশিষ্টাংশ এবং ফসলের বৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করে তবে সংরক্ষণ কৃষি ভিত্তিক সুস্থিতিশীল অনুশীলনের উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে বহিরাগত উপদান সরবরাহ (সার, কীটনাশক) এবং প্রাকৃতিক সম্পদের দক্ষ ব্যবহারের সাথে সংরক্ষণ কৃষির নীতির অনুশীলন। এটি কৃষকদের জন্য অর্থনৈতিক ও স্থিতিশীল এবং ভারতীয় কৃষিকাজের জন্য উপযুক্ত যা আমাদের পশুপালন, মাছ এবং কৃষিজমি সহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।

সংরক্ষণ কৃষি পদ্ধতির দীর্ঘমেয়াদী ফলাফ

এটি আমাদের অর্থাৎ ভারতীয় কৃষিক্ষেত্রকে আরও সুদৃঢ় করে তুলবে, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য প্রাকৃতিক শক্তির সঞ্চয করবে, পরিষ্কার পরিবেশ তৈরি করবে এবং জীববৈচিত্র্যকে আমাদের মাটিতে ও এইভাবে আমাদের বাস্তুতন্ত্রে ফিরিয়ে আনবে। এছাড়াও, এটি কৃষকদের আরও বেশি আয় দেবে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করবে, আমাদের জীবিকা নির্বাহ করে সর্বোপরি জাতীয় স্তরে আমাদের খাদ্য সুরক্ষা বাড়াবে।

ভারত সরকার এই পদ্ধতি ভারতীয় কৃষি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছে, তার মধ্যে একটি বড় অংশ হল কৃষি ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো, তার জন্য কৃষক সহ বিভিন্ন কৃষি প্রতিষ্ঠানগুলিকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। ধান এবং আলুর বপনের ক্ষেত্রে ভারতে যন্ত্রের ব্যবহারের জনপ্রিয়তা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পরছে। সরকারের সাথে সাথে বিভিন্ন বেসরকারি কৃষিকাজ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান সল্পমুল্যে কৃষকদের এই যান্ত্রিক সহায়তা প্রদান করতে এগিয়ে আসছে। যাদের মধ্যে অন্যতম কিছু হল  সাতমাইল সতিশ ক্লাব, যারা মূলত পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায় ধানের বপনের ক্ষেত্রে যান্ত্রিক সহায়তা প্রদান করে এবং WRMS প্রাইভেট লিমিটেড, একটি সর্বভারতীয় কৃষি পরিষেবা কোম্পানি যারা বিগত ৫ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে আলু বীজ বপনে যান্ত্রিক পরিষেবা প্রদান করে আসছে। এছাড়াও ডিহাট (DeHaat) নামে একটি সংস্থা ঝাড়খণ্ড রাজ্যে যান্ত্রিক পরিষেবা প্রদান করে থাকে।  

বিহার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুসারে সংরক্ষণ কৃষি ভিত্তিক সুস্থিতিশীল অনুশীলন পদ্ধতি থেকে ভারতীয় ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফলাফল এসেছে। বিগত ২০ বছরে তাদের নিজস্ব ফার্ম-ট্রায়াল থেকে তারা যে সমস্ত জিনিস লক্ষ্য করেছেন সেগুলি হল,

-১০% উৎপাদনশীলতায় বৃদ্ধি,

৮-১৭%  সেচ জলের সাশ্রয়,

২৬-৪২% শ্রম সাশ্রয়

৪৬-৬২% জ্বালানি খরচ / শক্তি সাশ্রয়

১৬-৫৬% কৃষকদের বৃদ্ধি আয়

১১-১৬% কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হ্রাস

সৈকত মান্না

English Summary: Conservation agriculture approach in India
Published on: 24 May 2020, 11:20 IST