ছত্রিশগড়ের একটি জেলা বস্তার। এটি সুন্দর বন এবং উপজাতীয় সংস্কৃতির জন্য পরিচিত, এই কারণে এটিকে রাজ্যের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়। বস্তার গ্রামের ৭০ শতাংশ জনসংখ্যা উপজাতীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। যেমন গোন্ড, মারিয়া, মুরিয়া, ভাট্রা, হালবা, ধ্রুব সম্প্রদায়। 24 জানুয়ারি 2012 সালে বস্তার জেলা থেকে পৃথক করা হয় কোন্ডাগাঁও জেলাকে। আজ আমরা এই নকশাল-আক্রান্ত কোন্ডাগাঁও জেলার এমন এক কৃষকের কথা বলব, যিনি ইতিমধ্যেই দেশের সেরা কৃষক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সাফল্যের মুকুটে রয়েছে রিচেস্ট ফার্মার অফ ইন্ডিয়ার খেতাব। কোন্ডাগাঁও জেলার মাটি থেকে উদিত এই সাফল্যের কাহিনী আজ গোটা দেশের প্রেরনা।
কৃষক রাজা রাম ত্রিপাঠী। ভারতীয় কৃষি খাতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ১১০০ একর জমিতে চাষ। অশ্বগন্ধা, কালমেঘ, ইনসুলিন ট্রি, স্টেভিয়া, অস্ট্রেলিয়ান সেগুন, , হলুদ সহ ২২টি ভেষজ গাছের চাষ করেন তিনি। তিনিই দেশের প্রথম কৃষক যার নিজস্ব হেলিকপ্টার রয়েছে। বছরে 25 কোটি টাকার টার্নওভার। ডঃ ত্রিপাঠি ইতিমধ্যেই ১২টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং সেখানকার কৃষি ও বিপণন পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। B.Sc (গণিত), হিন্দি, ইংরেজি, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান সহ পাঁচটি বিষয়ে M.A সহ LLB এবং ডক্টরেট ডিগ্রি রয়েছে তাঁর কাছে। The Richest Farmer of India সহ সবুজ যোদ্ধা, কৃষি ঋষি, ভেষজ রাজা, অ্যাওয়ার্ড রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। পাশাপাশি ডঃ ত্রিপাঠী হলেন দেশের প্রথম কৃষক যিনি ভারত সরকারের বিভিন্ন কৃষিমন্ত্রীর কাছ থেকে এ পর্যন্ত চারবার দেশের সেরা কৃষক হওয়ার পুরস্কার পেয়েছেন।
আরও পড়ুনঃ 1 কেজির দাম 800 টাকা, চাষ পদ্ধতি এবং বিক্রির মন্ত্র দিলেন এই কৃষক
এত গেল ওনার সাফল্যের কাহিনী। কিন্তু এই সাফল্য অর্জন করতে পথে এসেছে বহু কাঁটা। নকশাল-আক্রান্ত এই গ্রামে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া এত সহজ ছিলনা। স্কুল জীবনের পেরিয়ে যখন কলেজ জীবনে পা রাখেন তখন পথে আসে একগুচ্ছ বাঁধা। প্রতিদিন ২৫ কিমি সাইকেল চালিয়ে যেতে হত কলেজ। গনিতে গ্রাজুয়েশন করেন কৃষক রাজা রাম ত্রিপাঠি। তারপর একের পর এক বিষয়ের ওপর পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। ডঃ ত্রিপাঠি মনে করেন কৃষিতে উচ্চশিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আপনার দক্ষতা কৃষিকাজ, মার্কেটিং, আধুনিক প্রযুক্তির পথকে সহজ করে।
আরও পড়ুনঃ কৃষি নিয়ে এই এক রত্তির কথা শুনলে আপনিও অবাক হবেন
কৃষিতে বিপ্লব আনার যুদ্ধ শুরু হয় ৭ বছর বয়স থেকে। রাজারাম ত্রিপাঠীর দাদা ৫ একর জমি কিনে চাষ শুরু করেন। পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে দাদার সঙ্গে কৃষি কাজে সাহায্য করতেন ডঃ ত্রিপাঠি। প্রথমে একটি কলেজে অধ্যাপক হিসাবে এবং তারপরে এসবিআইয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাঙ্কে ম্যানেজার হিসাবে প্রায় ৭-৮ বছর সরকারি চাকরি করেছেন তিনি। সরকারি এই কাজ কর্মের ভিড়ে মন পড়ে থাকত কোন্ডাগাঁও এর মাটিতে। প্রথমে শুরু করেন টমেটো, বাঁধাকপি ইত্যাদি গতানুগতিক সবজি রোপণ করে। কিন্তু লাভের মুখ না দেখতে পেয়ে নিয়ে আসেন অন্য হাতিয়ার। গোলমরিচ, সাদা মুসলি চাষ করেই শুরু করেন কৃষি বিপ্লব। তবে কথায় আছে সাফল্যের চাবিকাঠি এত সহজে মেলেনা। 2002 সালে যখন সফেদ মুসলির দাম কমে যায়, তখন তিনি অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হন, কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। এরপর তিনি মিশ্র চাষ শুরু করেন। 2016 সালে অস্ট্রেলিয়ান সেগুনের সাথে কালো মরিচের চাষ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান তিনি। এতে ভাল উপার্জন হয় তাঁর। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
2021-2022 সালের সমীক্ষা অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রায় ৬২ শতাংশ মহিলা কৃষি কাজের সঙ্গে প্রতক্ষ্য এবং পরোক্ষ ভাবে জড়িত। তারই জল জীবন্ত প্রমাণ রাজা রাম ত্রিপাঠির কোম্পানি মা দন্তেশ্বরী হারবাল গ্রুপ। মা দন্তেশ্বরী হারবাল গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার ₹25 কোটি ছাড়িয়েছে। রাজারাম ত্রিপাঠীর সাথে ৭০০টি আদিবাসী পরিবার 1000 একর জমিতে জৈবিক পদ্ধতিতে যৌথ চাষ করছে। এর মধ্যে বেশিভাগই মহিলা।
সংসারের চালাতে এবং স্বনির্ভর হওয়ার জন্য রাজারাম ত্রিপাঠীর এই কোম্পানিতে যোগ দিয়েছেন বহু মহিলা। তাঁদের কথায় রুজি রোজগারের পথ দেখিয়েছেন ডঃ ত্রিপাঠী
বর্তমানে ডঃ ত্রিপাঠির কাছে রয়েছে মোট ৯ টি ফার্ম হাউস। ১১০০ একর জমির ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে কৃষির ইমারত। কৃষিকাজের জন্য ৭ কোটি টাকার একটি হেলিকপ্টারও কিনেছেন। ১১০০ একর জমির চাষ এবং কোম্পানি নিয়ে তাঁর বার্ষিক টার্নওভার 25 কোটি টাকার বেশি। ১০ টিরও বেশি দেশে ভেষজ হলুদের গুঁড়া, আমলাসহ বিভিন্ন ধরনের ভেষজ পণ্য প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করছে এই কোম্পানি।
কারোর জীবনে সাফল্য সহজে আসে না। অনেক কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য এর সিঁড়ি পার করে তবেই মেলে সাফল্যতা। এই পথে সঙ্গী হয় বিভিন্ন চরাই- উতরাই। তারই শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত ডঃ রাজা রাম ত্রিপাঠী।