গ্রামে গঞ্জে অজস্র বাড়ির পুকুর-ডোবা। বাড়ির মহিলারা যদি পুরুষদের সাথে মাছ চাষের বিষয়ে সম্যক ধারণা রাখেন, তবে সে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হোক, কিংবা বাড়ির পুকুরে একটু বাড়তি যত্ন নিয়ে চাষ, সব ক্ষেত্রেই ফলন বাড়বে নিশ্চিত। আসলে বাড়ির পুকুরগুলো নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণে চাষের মাধ্যমে যেমন নজরে থাকে তেমনি গৃহস্থ লোকেদের দুবেলা মাছের যোগান দিয়ে পুষ্টির দিকটাও নিশ্চিত করা যায়। চাকরির সূত্রে হলদিয়ার বিভিন্ন এলাকায় নারীদের এরকম সব ভূমিকা লক্ষ্য করেছি, যা হয়তো অনেক সময়ে চোখের আড়ালে থেকে গেছে। কিন্তু মাছ চাষ কিংবা মৎস্য উদ্যোগে এই সব মৎস্য কন্যাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মৎস্য চাষে নারীর অবদান (Contribution of women in fish farming) -
বিভিন্ন সময়ে হলদিয়ার মাছ চাষের খবরে পুরুষ মাছ চাষির নামই আমরা প্রায় শুনি। সেই সব পুরুষ চাষির কাজের নেপথ্যে রয়েছেন পরিবারের নারীরা। না শুধু অনুপ্রেরণায় নয়, পুরোপুরি কাজে হাতে হাত দিয়ে বাণিজ্যিক মাছের চাষ করছেন সেই সব মহিলারা। অভূপূর্ব কর্মক্ষম ও সৃজনশীল উদ্যোগের ছোঁয়া পাওয়া যায় এই সব মাছ চাষের ক্ষেত্রে।
বছর তিনেক আগে হলদিয়া ব্লকে প্রথম “ফিশারী ফার্ম স্কুল” এর মতো এক প্রশিক্ষণ শিবির হয়েছিল। উদ্দ্যেশ্য ছিল স্বামী- স্ত্রী বা পরিবারের লোকজন নিয়ে একসাথে এক প্রশিক্ষণ। বেশ সাড়াও পাওয়া গেছিল। মাছ চাষিদের পরিবারের লোকজন একসাথে এই শিবিরে এসেছিলেন। তখনই খেয়াল করলাম, আমরা এমন প্রশিক্ষণ আনুষ্ঠানিক ভাবে করলেও আসলে এনারা পরিবার নিয়েই চাষে যুক্ত রয়েছে এবং এটাও খেয়াল করলাম যেই সব পরিবারের মাছ চাষে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ রয়েছে। তাদের উৎপাদন যেমন বাড়ছে, তেমনি ওনারা নতুন নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে বেশ আগ্রহী। পরিবার ভিত্তিক মাছ চাষ হলদিয়ার এক অন্যতম বৈশিষ্ট। আর এই পরিবার ভিত্তিক চাষের কেন্দ্রে রয়েছেন বাড়ির মহিলারা অর্থাৎ এই সব মৎস্য কন্যারা।
বসানচক গ্রামের শরত চন্দ্র ভৌমিক- এর স্ত্রী ও মেয়ে ওনার মাছ চাষের নিত্য সঙ্গী। স্ত্রী বন্দিতা ভৌমিক ও মেয়ে পিউ ভৌমিক। যখন মাছ ধরা হয় তখন ওনার মেয়ে খাতা কলম হাতে মাছের সংখ্যা ও ওজনের হিসেব রাখে। আর ওনার স্ত্রী পুরোপুরি স্বামীর সাথে হাত লাগান মাছ চাষের যাবতীয় কাজে। এমনকি পুকুরে নেমে মাছ বাছা-ধরাতেও বেশ পারদর্শী। রুই, কাতলা মৃগেলের যেমন চাষ আছে, তেমন প্রায় হারিয়ে যাওয়া দেশি পাবদা মাছের সফল মিশ্র চাষ করছেন। মনিপুরের স্টেট ফিশ পেংবা মাছের চাষ প্রথম করেন। এছাড়া রয়েছে আমুর মাছ। আর এই সব চাষে বেশ উৎসাহ যোগায় ওনার স্ত্রী। এমনকি ব্লকে এসে অন্যন্য পুরুষ মাছ চাষিদের সাথে মাছ চাষের প্রশিক্ষণও নেন বন্দিতা। স্বামীর সাথেই নিজি হাতে মাছ চাষের কাজ গুলো বেশ দক্ষ হাতেই সামলান তিনি। ক্ষতিকারক রাসায়নিক প্রয়োগ করে মাছ চাষে উৎপন্ন মাছ যে স্বাস্থেরপক্ষে ক্ষতিকর সে বিষয়ে বেশ সজাগ বন্দিতা। বলেন-“এই মাছ আমার বাচ্চারাও তো খায়, তাছাড়া জৈব চাষে কম খরচে লাভজনক মাছের উৎপাদন করা যায় সহজেই”। আসলে চাষে মহিলারা সচেতন হলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাছ চাষের কথা সহজেই বোঝানো যায়, তার অন্যতম প্রমান এই ভৌমিক পরিবার।
সেরকমই বিষয়ে লক্ষ্য করা যায়, বসানচক গ্রামের তরুন নবীণ মাছ চাষি শুভ্রজ্যোতি সাহুর মাছের খামারে। মাছ চাষে সব সময়ের দেখ ভাল করে তার মা। মাছের খামারে দুজন লোক রাখা আছে ঠিকই কিন্তু তাদের নির্দেশ দিয়ে কাজ করান শুভ্রজ্যোতির মা নন্দরানী সাহু। অবসরে পাড়ের সব্জী চাষের দেখভালও করেন তিনি। সারাক্ষণ মাছের খামার আগলে বসে আছেন এই মহিলা। পিতৃহারা কম বয়সী শুভ্রজ্যোতির মাছ চাষের প্রধান গুরু তার মা। বিভিন্ন প্রায় হারিয়ে যাওয়া মাছের সফল চাষ হয়েছে এদের খামারে। দেশী মাগুর, টেঙরা, পাবদা মাছের মিশ্র চাষ রয়েছে। শিক্ষামূলক ভ্রমণে মাছ চাষিদের দল এসে ঘুরে দেখে যান এনাদের মাছের খামার।
দ্বারিবেড়িয়া গ্রামের প্রতিমা মন্ডল বর্মন হল বছর সাতাশের গৃহবধূ। রাজ্যসেরা মাছ চাষি “মীণমিত্র” পুরস্কার প্রাপক নারায়ন বর্মনের বৌমা। শ্বশুর মশায়ের মাছ চাষের কাজে হাত লাগান এই বধূ। নারায়ন বাবুর স্ত্রী, ছেলে বৌমা সকলে মিলেই প্রায় ৫ হেক্টর জলাশয় দেখভাল করেন। এখন মাছ চাষের পরিধি আরো বাড়ছে। ব্লকের পরিবারভিত্তিক মাছ চাষের ফার্ম স্কুলে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন নারায়ন বাবুর ছেলে ও বৌমা। পরিদর্শনের সময়ে ফার্মে গেলে বোঝা যায় বেশ অভিঙ্গতা অর্জন করেছেন তারা। দ্বারিবেড়িয়া গ্রামের নারায়ন বর্মনের মাছের খামার বেশ সাজানো গোছানো।
আবার অরূপ মন্ত্রী ও পঞ্চানন মন্ত্রী ভাতৃদ্বয়ের গল্প বেশ রোমঞ্চকর। পঞ্চানন হল বড় ভাই। ওনার স্ত্রী সুমিত্রা প্রায় ছেলের মতোন দেবরকে মানুষ করেছেন। খুব হত দরিদ্র পরিবার ছিল এই দুই ভাইয়ের সংসার। মাছ চাষ করে এখন এক স্বচ্ছল পরিবারে পরিণত হয়েছেন। ধীরে ধীরে মাছ চাষের ক্ষেত্রও বাড়িয়েছেন। পঞ্চানন মন্ত্রীর স্ত্রী মাছ চাষে সরাসরি ভাবে যুক্ত থেকে এই অগ্রগতি করাচ্ছেন। এখন দুই ভাই ও ওনাদের স্ত্রী মাছ চাষে এক বড় ভূমিকা পালন করছেন, কিন্তু রয়েছেন নেপথ্যে। ভাই অরুপ মন্ত্রী ২০১৯ সালে সিফা-ভুবনেশরে সেরা মাছ চাষির পুরস্কারও পান। রুই, কাতলা মাছের যেমন ব্যাপক উৎপাদন করছেন, তেমনি নতুন মাছ “পেংবা” ও “আমুর”-এর চাষে ভাল ফলন পেয়েছেন। মাছ কে কখন খাবার দিতে হবে বা পরিচর্যার বিষয়ে যেমন দক্ষ হাতে সামলান সুমিত্রা দেবী, তেমনি মাছ ধরা বা অন্য সময়ে কাজে নিযুক্ত লোকেরদের খাওয়া দাওয়া বিষয়েও দেখভাল করেন। কিন্তু লাজুক সুমিত্রা দেবী কখনই প্রথাগত মাছ চাষের প্রশিক্ষণে আসেননি, যখনই এসেছেন ওনার স্বামী বা দেবর। বাড়বাসুদেব পুরের সুদীপ বিকাশ খাটুয়া। ওনার পরিবারে সকলেই মহিলা। স্ত্রী, বৌদি মাছের খাবার নিজেই তৈরি করেন। তাছাড়া বাড়িতেই রঙীন মাছের একটা ছোট্ট ফার্ম করেছেন।
বৈজ্ঞানিক মাছ চাষে আগ্রহী মহিলা -
আবার মহিলাদের কিছু দল আছে যারা আবার বৈজ্ঞানিক মাছ চাষে বেশ আগ্রহী। বড়বাড়ি গ্রামের তুঙ্গ পাড়ার মহিলারা যেমন পাড়ায় বৈজ্ঞানিক চাষের জন্য হলদিয়া ব্লক মৎস্য দপ্তরে এসে আহ্বান জানিয়ে যান। বিকেলে বাড়ির উঠানে ঘরোয়া বৈঠক বসান, পুকুরের জল নিয়ে আসেন সব পরীক্ষা করিয়ে জেনে নিতে। বেশ আগ্রহী তারা, কিভাবে চাষ করলে এই সব পুকুরে বেশ ভালো মাছের উৎপাদন করা যাবে সেই বিষয়ে। দলের সদস্য নিলিমা তুঙ্গ সহ প্রায় সকল মহিলা সদস্য বেশ সামাজিক কাজের মতো পাড়ার পুকুরের মালিকদের উৎসাহিত করে। পয়লা-আষাঢ় জলাভূমি রক্ষা করার মতো বার্তা নিয়ে আলোচনা সভারও আয়োজন করেন এই মহিলারা। দপ্তরের আধিকারিক হিসেবে ওনাদের এই প্রয়াসে সামিল হই, বেশ উৎসাহিত লাগে এই সব মৎস্য কন্যাদের সাথে। যারা নিজে তো চাষ করেন, তার সাথে এলাকার অন্যান্যদের উৎসাহিত করে চলেছেন।
এদিকে চাউলখোলা গ্রামের সোপান, সপ্তদ্বীপা ও সহসা স্বনির্ভর দল নিজেদের বাড়ির পুকুরগুলিতে সেই ঘরোয়া ভাবে চাষের পাশাপাশি মৎস্য দপ্তরের বিভিন্ন জনসচেতনতা মূলক কর্মসূচীতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করে। প্রায় বছর ইলিশ মাছ রক্ষার র্যালিতে এই মহিলারা গলা মিলিয়ে হাটা দেয়। বৃষ্টির সন্ধ্যাতেও হলদিয়ায় মেলায় মাছ চাষ নিয়ে আলোচনা সভায় উপস্থিত হন। এনাদের মধ্যে শেফালী দলুই মান্না অনেক এগিয়ে। মহিলাদের দলকে সংগঠিত করে এলাকায় বৈজ্ঞানিক মাছ চাষে যেমন উৎসাহিত করেন, তেমনি বিভিন্ন কর্মসূচীতে সবাইকে একসাথে একত্রিত করেন। পুকুরের জল নিয়ে পৌছে যান অফিসে, পরীক্ষা করিয়ে মাছ চাষের পরামর্শ নেন। এনাদের দেখে এলাকার অন্যন্য মহিলারাও বেশ উৎসাহিত হচ্ছেন সেটা বেশ লক্ষ্য করা যায়।
আবার দ্বারিবেড়িয়া গ্রামের শুভ্রা কান্ডার আর এক মৎস্য কন্যা। একটি পুকুর দলগতভাবে চাষাবাদ করছিলেন, কিন্তু হঠাৎ মাছের আঁশের উপকরন তৈরি করতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন । মাছের মূল্যসংযোজন পণ্য উৎপাদন এর প্রশিক্ষন নিতে একা মহিলা জুনপুটে ছুটে গেলেন । এখন বাড়ির পুকুরে মাছ চাষের দেখভাল যেমন করেন তেমনি শখে বানিয়ে ফেলেন মাছের আঁশের দুল, হার। অফিসে এসে সেই গুলো দেখিয়েও নিয়ে যান শুভ্রা কান্ডার। বলেও রেখেছেন ব্লকের অন্যন্য মহিলারা যদি শিখতে চায় তবে তিনি শেখাতেও রাজি।
আবার চাউলখোলা গ্রামের সুব্রত মাইতি কই মাছের চাষ শুরু করেন। তারপর মাছের কৃত্রিম প্রজনন করা শুরু করেন। তার কাজের সর্বক্ষনের সঙ্গী ওনার স্ত্রী। এমনকি মাছ চাষের প্রশিক্ষণ নিতে স্বস্ত্রীক ভুবনেশ্বরের মৎস্য গবেষনা কেন্দ্রে যান। বর্তমানে নীল বিপ্লব প্রকল্পে মাছের হ্যাচারী তৈরি করছেন।
আসলে আমরা যদি আরো ভাল করে লক্ষ্য করি তবে দেখব, আমাদের এলাকার আশে পাশে এমন অনেক নারী-ই রয়েছেন লোকচক্ষুর আড়ালে, যারা গ্রামীণ এলাকায় বিভিন্নভাবে জলজ চাষের সাথে যুক্ত। অনেক সময়ে গ্রামীণ মহিলারা তাদের সীমিত শিক্ষায় থেকেও খালে বিলে পুকুরে মাছ চাষ ধরা বিক্রি ওনেক রকম পেশায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হচ্ছেন।
মহিলা কৃষক আরতী বর্মন-এর কাহিনী -
সুযোগ পেলে নারীরাও যে পুরুষের সমান ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে এগিয়ে যেতে পারে তা অনেক ক্ষেত্রেই প্রমাণিত। তবে এই সব মহিলাদের থেকে অনেক এগিয়ে তিনি একজন নারী মৎস্য উদ্যোক্তা, নামটি হল আরতী বর্মন। মাছ চাষের মাধ্যমে জীবনের মোড় কেমন করে ঘোরাতে হয় তা উনি দেখিয়েছেন। উনি নেপথ্যে কখনই নয়, নিজ হাতে জাল নিয়ে নেমে যান পুকুরে। ওনার জীবন কাহিনি অন্যন্য মহিলাদের কাছে আদর্শ। খুব কম বয়সে বিয়ে হয়ে আসেন হলদিয়ায়। ওনার মুখে শোনা খুব কষ্টে সংসার চালাতেন। বাড়ির পুকুরে প্রথম মাছ চাষ শুরু করেন, চাষে লাভ পেতে থাকেন। অক্লান্ত পরিশ্রম আর কর্মনিষ্ঠায় ধীরে ধীরে মাছ চাষের আওতা বাড়াতে থাকেন। এখন বর্তমানে প্রায় শুধু হলদিয়ায় নয়, তমলুক, মহিষাদল ব্লকেও ওনার মাছ চাষ হয়। একেবারে আধুনিক পদ্ধতিতেই মাছ চাষ করেন। ১ কেজি ওজনের কাতলা মাছ ছেড়ে চাষ করেন। রুই, মৃগেল , গলদা বিভিন্ন মাছের নিবিড় পদ্ধতিতেই চাষাবাদ করেন। পুকুর পাড়েই মাছ বিক্রি হয়ে চলে যায় ভীন রাজ্যে। তিন ছেলে বড় হয়েছে, মায়ের সাথে চাষে হাত লাগান। বড় যৌথ পরিবারকে মাছ চাষের মতোই একা হাতে ধরে রেখেছেন। শুধু হলদিয়ায় নয়, সারা রাজ্যে আরতী বর্মন মহিলাদের কাছে এক আইকন।
আরও পড়ুন - মালটা ফলের চাষ করে আজ সাফল্যের পথে কৃষক সুনীল বরন তালুকদার
তাই এই সব মৎস্যকন্যাদের কাহিনী অতল নিথর জলের তল থেকে খুঁজে বের করতে নিজের বাড়ির মহিলাদের দিকে প্রথম তাকাতেই হয়। সেখানেও লুকিয়ে রয়েছে নিজের ‘মৎস্য-কন্যা’, যারা প্রতিদিন কত রকমের মাছের পদের রান্না সাজিয়ে অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।
আরও পড়ুন - Banana farming, agri-textile bag: এগ্রি টেক্সটাইল ব্যাগেই দাগহীন কলা চাষে অভাবনীয় সাফল্য