অ্যাজোলা (Azolla) এক ধরনের ভাসমান ফার্ন (বিভাগ Pteridophyta, বর্গ Salviniales, গোত্র Azollaceae) যা পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা দ্রুত হারে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এবং এটি সাধারনত গ্রামাঞ্চলের বহু জলাশয়েই প্রচুর পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায়।
কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে এই ফার্নটির উপকারিতা বা ভূমিকা সম্পর্কে অনেকেই না জানার কারণে অ্যাজোর ব্যবহার সেভাবে প্রচলিত নয়। এমনকি অনেক সময়ই কৃষকরা ধান জমিতে দাঁড়িয়ে থাকা জড়ো আজোলা থাকলে তাকে অবাঞ্চিত উপদ্রব মনে করে তা মেরে ফেলতে চায়।
অথচ বাস্তবে ফসলের উপর এর অনেক উপকারী প্রভাব রয়েছে। আলোতে আশ্রয় করে থাকা নীল সবুজ শেওলা, সায়ানোব্যাকটেরিয়া (Anabaena azollae) সরাসরি বাতাস হতে হেক্টর প্রতি প্রায় ২৫ কেজি নাইট্রোজেনকে আবদ্ধ করতে পারে।
ফলে ধান জমিতে অ্যাজোলার উপস্থিতি মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে গাছের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং একইসাথে এর ফলে মাটিতে বাইরে থেকে নাইট্রোজেন ঘটিত সার প্রয়োগের পরিমাণও কমিয়ে ফেলা যায়। অ্যাজোলায় রয়েছে অশোষিত প্রোটিন (প্রায় ২০%-এর অধিক), বিভিন্ন প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড (উচ্চমাত্রার লাইসিন) সহ ভিটামিন A ও B এবং ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের মতো খনিজ লবণ।
ফলে যেকোন গবাদি পশুর জন্য এটি একটি উন্নত মানের পুষ্টিকর খাদা রূপে ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার শুরুনো অ্যাজোলা ফ্রেক্স পোলট্রির খাবার এবং সবুজ অ্যাজোলা মাছেরও পুষ্টিকর খাবার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। জীবাণু সারের পাশাপাশি জলাশয়ে বিভিন্ন ক্ষতিকারক ভারী ধাতুর প্রভাব প্রশমনের জন্যও অ্যাজোলা Bio-scavenger-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আবার আজোলা দিয়ে অতি সহজে খুব কম সময়ের মধ্যে উন্নত মানের কম্পোস্ট সার তৈরি করাও সম্ভবপর। অর্থাৎ কৃষিক্ষেত্রে অ্যাজোলার এক বহুমুখী ব্যবহারিক গুরুত্ব রয়েছে এবং একে খুব সহজে অল্প জায়গায় নূন্যতম খরচে উৎপাদন করাও সম্ভবপর।
অ্যাজোলা অঙ্গজ ও যৌন উভয় ধরনের প্রজননেই সক্ষম। অঙ্গজ প্রজননে কান্ডের গোড়ার বয়স্কতম পার্শ্বশাখাটি খন্ডিত হয়ে তা থেকে নতুন উদ্ভিদ জন্মায়। অনুকূল পরিস্থিতিতে উদ্ভিদ দ্বিগুণ হতে সময় লাগে প্রায় ৩ দিন। মুখ্য রেণুধর এ উদ্ভিদ ক্ষুদ্র লিঙ্গধর পর্যায়ের সঙ্গে প্রত্যাবৃত হয়।
এতে দু প্রকার স্পোরোকার্প থাকে ক্ষুদ্রাকার মেগাস্পোরোকার্প (স্ত্রী) ও বৃহৎ মাইক্রোস্পোরোকার্প (পুং) এবং এগুলি উষ্ণমন্ডলে শীতকাল বা বসন্তের শুরুতে পার্শ্বশাখার বয়স্কতম (প্রথম) পাতার কক্ষে জন্মে। আলোককাল ও তাপমাত্রা রেণু উৎপাদন প্রভাবিত করে। মেগাস্পোরোকার্প ও মাইক্রোস্পোরোকার্প সর্বদা সজোড় ও পাশাপাশি থাকে।
সারা বছরই পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যাজোলার চাষ সম্ভব। এজন্য ১০০ সেমি গভীর ও আলোময় একটি পুকুরই যথেষ্ট। প্রতিদিন হেক্টর প্রতি ১০ কেজি ইউরিয়া ও ৫ কেজি মিউরেট অব পটাশের দ্রবণ পানিতে প্রয়োগে হেক্টর প্রতি ১.০-১.৫ টন তাজা অ্যাজোলা ফলানো যায়। পানিতে প্রতিদিন তরল সারের পরিবর্তে পাতায় সার স্প্রে করা অধিকতর ফলপ্রসূ।
জৈৰ সবুজ অ্যাজোলা উৎপাদন ও পুথিগত খাদ্যগুণাবলী
সাধারণত দেখা যায় যে অ্যাজোলা ৩ থেকে ৪ দিনেই প্রায় দ্বিগুন হয়ে যায়। এর উৎপাদন প্রতি বর্গমিটারে সাধারণত ভাবে ৭০০ গ্রাম হয়। অ্যাজোলা (শুকনো) -এর বিশ্লেষণে দেখা গেছে এতে প্রোটিন ২৫-৩৫%, ১০-১৫% অন্যান্য খনিজ লবণগুলি যথাক্রমে ক্যালসিয়াম - ৬.৭%, ফসফরাস ০.৬৯%, লৌহ - ৭.৩% ও ম্যাঙ্গনীজ ০.২০% থাকে।
আরও পড়ুনঃ গ্রামীন উন্নয়নে অর্থকরী দুটি সম্ভবনাময় প্রকল্পের দিশা
পশুখাদ্য হিসাবে অ্যাজোলার ব্যবহার
অ্যাজোলা গরু ও মহিষের একটি উত্তম খাদ্য। এর অতিরিক্ত প্রোটিন এবং কম লিগুমিন থাকার কারনে আজোলা গবাদি পশুদের তাড়াতড়ি হজম হয়ে যায়। অ্যাজোলা কৃত্রিম কনসেনট্রেট খাবারের সঙ্গে ১ঃ১ অনুপাতে মিশিয়ে গরু মহিষ কে খাওয়ানো যেতে পারে। আজোলা খাওয়ালে গাভীর দুধের গুণগত মান ও পরিমান বৃদ্ধি পায়।
হাঁস-মুরগীর খাদ্য হিসাবে অ্যাজোলার ব্যবহার
হাঁস - মুরগী ও কোয়েলকে অ্যাজোলা সরাসরি অথবা খাদ্যশস্য এবং রন্নাঘরের বর্জ্য পদার্থের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। গৃহপালিত হাঁসদের টাটকা অ্যাজোলা সরাসরি খাওয়ানো যেতে পারে। ভেজা অ্যাজোলা ২০% থেকে ৩০% কনসেনট্রেট খাবারের পরিবর্তে ঘরোয়া পদ্ধতিতে দেওয়া যেতে পারে। হাঁস অ্যাজোলা ক্ষেতে খুব পছন্দ করে। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে চাষ করা পাখিদের ক্ষেত্রে অ্যজোলা ২০০ গ্রাম প্রতি পাখিকে কৃত্রিম খাদ্যর সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যায়।
সবুজ সার হিসাবে অ্যাজোলার ব্যবহার
খারিফ ও রবি দুই খন্দেই এটি সহজে বেশী পরিমানে সবুজসার হিসাবে উৎপাদন ও ব্যবহার করা যায়। এটি ধান ক্ষেতের ছোট ছোট আগাছা দমন করে।এটি শস্য বৃদ্ধির জন্য নাইট্রোজেনের উৎস হিসাবে কাজ করে ও কিছু মাত্রায় রাসায়নিক নাইট্রোজেন সারের ব্যবহার কমাতে সাহায্য করে। এটি দস্তা, লোহা, ম্যাঙ্গানীজ কে দ্রবীভূত করে ধান গাছের কাজে লাগায়। চারা বৃদ্ধি সহায়তা করে। এটি সেচকৃত জমির জলের বাষ্পীভবন কমায়।
বাড়ীতে অ্যাজোলা চাষ
বাড়ী ঘরে খুব সহযেই অ্যাজোলা চাষ করা যায় এবং একই গর্তে একই পদ্ধতিতে বার বার অ্যাজোলা চাষ করে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই প্রচুর অ্যাজোলা উৎপাদন করা যায়।
আরও পড়ুনঃ সম্ভাবনাময় তন্তুজাতীয় ফসল পাট
চাষের পদ্ধতি
প্রথমে ২ মি লম্বা, ১মি চওড়া এবং ২০ সেমি গর্ত করতে হবে। তারপর একটা পলিথিন সিট দিয়ে, যার দৈর্ঘ্য ২ মি ৬ সেমি এবং প্রস্থ ১ মি ৬ সেমি, গর্ভের মাপ মতো ওর উপর বসিয়ে দিতে হবে যাতে গর্তের মধ্যে জল দিলে মাটিতে ট্রেনে না যায়। এবার গর্ভের মধ্যে ১০ সেমি গভীরতা পর্যন্ত জল ঢালতে হবে। তবে জল ঢালার আগে গর্ভের চারপাশের পলিখিনকে কাদা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে যাতে বাতাসে এদিক ওদিক না সরাতে পারে। এই জলের মধ্যে ১২ গ্রাম এস এস পি, ১২ গ্রাম এম ও পি. শুকনো গোবর ১০০ গ্রাম এবং অ্যাজোলা ৩০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। এই ভাবে ১৫ দিন রেখে দিলে অ্যাজোলা কয়েক গুন বেরে যাবে এবং মাসে ২ বার করে উৎপাদিত অ্যাজোলা জমিতে প্রয়োগ করা যাবে।
জমিতে অ্যাজোলা চাষ
জমিতে সহজেই অ্যাজোলা চাষ করা যায়। নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে অ্যাজোলা চাষ করে অল্প কয়েক দিনে প্রচুর অ্যাজোলা উৎপাদন করা যায়।
চাষের পদ্ধতি
১) প্রথমে জমিকে একরূপে সমান করে নিতে হবে, যাতে কোন জায়গায় উঁচু নিচু না থাকে।
২) জমিকে ২০-২৫ মি লম্বা এবং ৫ মি গ্রন্থে ভাগ করে নিতে হবে এবং প্রতিটা প্লটকে ভালো ভাবে আল দিয়ে বেঁধে দিতে হবে যাতে প্রয়োজন মতো জল ভেতোরে ঢুকানো ও বের করা যেতে পারে ।
৩) এবার প্রতিটা প্লট বা ভাগে ১০ সেমি জল আটকাতে হবে এবং এই জলে ৭/৮ কেজি অ্যাজোলা, ১০-১২ কেছি গোবর এবং ১০০ গ্রাম এস এস পি যোগ করতে হবে।
(৪) এই ভাবে ১৫ দিন পর পর উৎপাদিত অ্যাজোলা প্রয়োজন মতো ব্যবহার করা যেতে পারে।
অ্যাজোলা উৎপাদনের জন্য কতগুলি বিষয় মাথায় রাখা দরকার
যে স্থানে অ্যাজোলা বেড করা হবে তা অবশ্যই সমান করে নিতে হবে। ধারাবাহিক ভিত্তিতে জলের যোগানের জন্য বেডগুলোকে অবশ্যই জলের উৎসের কাছাকাছি রাখতে হবে। অল্প ছায়া যুক্ত জায়গায় এই বেড রাখার জন্য আদর্শ।
মেঝেয় যাতে কোন সূঁচালো পাথর, মূল বা কাঁটা না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ তাতে বেডগুলো ফুটো হয়ে যেতে পারে। প্রতি ১৫ দিন অন্তর ১ কেজির মতো গোবর ১০ গ্রাম সুপার ফসফেটের মিশ্রণ প্রয়োগ করলে অ্যাজোলার বৃদ্ধি ভালো হবে।
অন্য কোন বর্জ্য বা জলজ আগাছা দেখলেই তা নিয়মিত সরিয়ে ফেলতে হবে। অ্যাজোলা বেডে ভরে গেলে প্রতি স্কোয়ার মিটারে ২০০ গ্রাম মতো অ্যাজোলা প্রতিদিন বা একদিন অন্তর একদিন সরিয়ে ফেলতে হবে।
তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াগের বেশি উঠে গেলে অবশ্যই সেড লাগালে ভালো হবে। সেকারণেই একটু অল্প জায়গায় বেডগুলো রাখলে ভালো হয়। জলের pH ৫.৫-৭-এর মধ্যে রাখতে হবে। মোটামুটি ২-২.৫ কেজি মতো মাটির বদলে নতুন মাটি প্রতি ৩০ দিন অন্তর পাল্টাতে হবে। ২৫-৩০% জল নতুন জল দিয়ে প্রতি ১০ দিন অন্তর পাল্টাতে হবে। প্রতি ছয় মাস অন্তর আগের জল ফেলে দিয়ে নতুন অ্যাজোলা ও মাটি দিয়ে পুনরায় চাষ শুরু করতে হবে।
অ্যাজোলা হতে কম্পোস্ট সার উৎপাদন
১) প্রথমে একটি গর্ত তৈরি করতে হবে যার মাপ হবে- ১.৫ মিX ১মিX ০.৫মি. (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা) এবং গর্তের মেঝে কালো পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
২) এবার গর্তটা অ্যাজোলা দিয়ে ভর্তি করে দিতে হবে।
৩) এরপর সাধারণ পলিখিন সিট দিয়ে গর্তটি ঢেকে দিতে হবে।
৪) পাঁচদিন অন্তর নাড়া দিতে হবে ও অল্প অল্প জলের ছিটে দিতে হবে।
৫) পনেরো দিন পরে পড়ে যাওয়া (কালো রঙের) অ্যাজোলা বার করে নেওয়া যাবে।
৬) ছায়াতে শুকিয়ে নিয়ে আর্দ্রতা ২০-৩০% করে নিতে হবে।
অ্যাজোলা মজুত রাখা এবং খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করার পদ্ধতি
অ্যাজোলা রৌদ্রে শুকনো অথবা দলাপাকানো (গুলির আকারে) এবং সাইলেজ (শুকনো প্রাণী খাদ্য) করা অবস্থায় খাওয়ানো যেতে পারে।বেশি ভেজা থাকলে একটি মেঝেতে কয়েক ঘণ্টা ছাড়িয়ে রাখলে শুকিয়ে যায়ে। রৌদ্রে শুকনো এবং গুঁড়ো করা অ্যাজোলা বেশিদিন রাখা যায় এবং খুব সহজেই কনসেনট্রেট খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যায়ে। যখন পুকুরে পরিমিত জল সরবরাহ থাকে, তখন অ্যাজোলা বেশি করে বিভাজন করিয়ে শুকিয়ে ও জমিয়ে রাখা যায় ।
অ্যাজোলার চৌবাচ্চা (ক্ষেত্র) তৈরী করতে কত খরচ প্রয়োজন
সারা বছরের গোখাদ্য পেতে হলে দুটি চৌবাচ্চা করা দরকার জাতে খরচ হবে প্রায় ১৫০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা । সবুজ সার হিসাবে অ্যাজোলা যেমন ব্যবহার করা যায়, সেই কারনে একে কার্যকারী জৈবসার বলে এবংদীর্ঘদিন ধরেই চিরাচরিত পদ্ধতিতে ধানক্ষেতে জৈবসার বা সবুজসার রূপে ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে উৎকৃষ্ট মানের পশুখাদ্য হিসাবেও অ্যাজোলার গুরুত্ব অপরিসীম। ক্ষুদ্র চাষীদের ক্রমদ্ধমান পশুপালনের জন্য গো-খাদ্য হিসাবে অ্যজোলার ব্যবহারের গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে।
লেখক- ওসমান আলি, সুমন্ত পণ্ডা, দেবলীনা রায়, মহঃ মাহমুদুল হাসান মিদ্যা