পান (Betel Vine) হল অত্যন্ত সুখী, সংবেদানশীল, বহুবর্ষজীবি অর্থকরি ফসল। লতানো এই ফসলটির প্রয়োজন ছায়াযুক্ত আর্দ্র পরিবেশ। সাধারণত বাঁশ, কাঠ, খড়, দড়ি ইত্যাদি দিয়ে যে বরজ তৈরী করা হয় তা ২ - ৩ বছর খুব একটা মেরামত করার প্রয়োজন হয় না, কিন্তু বাঁশ, কাঠ প্রায় প্রতি বছরই পাল্টাতে হয়। তাছাড়াও এর জন্য দক্ষ শ্রমিক লাগে ফলে খরচ বাড়তে থাকে। আবার দক্ষ শ্রমিকের অভাবে বা সময়মতো না পেলে বরজ মেরামতি বন্ধ থাকে ও ফলন মার খায়।
কম খরচের বাঁশের কাঠামোর ওপর শেডনেটের আচ্ছাদন (Shade Net) ব্যবহার করে চাষিরা এই সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে পারেন। শেড নেটের এই উন্নত বরজে পান গাছের মাথার ওপরে বিছানো থাকে স্প্রিঙ্কলারের ল্যাটেরাল পাইপ যার সাহায্যে সেচ দেওয়ার সাথে সাথে তরল সার ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা যায়। এরফলে পানের গুণমান ও বাজারদর ভালো পাওয়া যায়।
প্রথাগত পানের বরজে ঋতুভিত্তিক পরিচর্যা ও ছাউনি মেরামতির খরচ বেশী আবার কলসি, বালতি ও ঝারি দিয়ে জল সেচ দিতে হয়। অপরদিকে শেডনেটের বরজে উন্নত সেচ ব্যবস্থা থাকায় গাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনায় ও শস্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান সম্মত পদক্ষেপ নিতে সুবিধা থাকায় বার্ষিক লাভের পরিমান ৪ - ৫ গুণ বেশি পাওয়া যায়। আবার বাঁশের বদলে লোহার স্ট্রাকচার তৈরি করে শেডনেটের আচ্ছাদন দিলে ঝড় বৃষ্টিতে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে।
অল্প কথায় শেডনেটের বরজের সুবিধা -
-
ঋতুভিত্তিক বরজ মেরামতির প্রয়োজন নেই।
-
ঝড় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতির সম্ভাবনা কম।
-
সঠিকভাবে অলো-বাতাস চলাচল করে, যা পানের বৃদ্ধি সহায়ক।
-
মাইক্রো ইরিগেশন পদ্ধতিতে সেচ প্রদান উৎকৃষ্ট গুণমানের পাতা উৎপাদন করে।
-
রোগ পোকার উপদ্রব কম।
-
প্রাথমিক খরচ বেশি হলেও আদতে লাভজনক।
-
সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পাওয়া যেতে পারে।
আরও পড়ুন - এই মরসুমে চিচিঙ্গা চাষ করে আয় করুন অতিরিক্ত অর্থ
রোগের আক্রমণ ও তার প্রতিকার (Disease Management) -
১) গোড়া পচা ও পাতা পচা -
ছত্রাকঘটিত এই রোগের আক্রমণের ফলে আক্রান্ত পাতাগুলো কিছুটা কম উজ্জ্বল ও নিষ্প্রভ হয়ে যায়। আর মাটির সংলগ্ন কাণ্ডে দু’টো গাঁটের মাঝে মাঝে কালো দাগ দেখা যায়। আক্রান্ত ডাঁটা পচে যায় এবং ডাঁটার ওপরের অংশ ঢলে পড়ে শুকিয়ে যায়। ছত্রাক মাটি থেকে কাণ্ডে প্রবেশ করে এই রোগ হয়। আক্রান্ত পাতার কিনারার দিকে থেকে গোলাকার গাঢ় বাদামি বা কালো রঙের ভেজা ভেজা পচা দাগ দেখা যায়। দাগগুলি দ্রুত বাড়তে থাকে এবং গোটা পাতাটি নষ্ট হয়ে যায়। গাছের নীচের দিকের পাতাগুলি বেশি আক্রান্ত হয়। আর বর্ষাকালীন সময়ে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়।
প্রতিকার -
বর্ষাকালে প্রতি মাসে এক বার ১% বোর্দো মিশ্রণ দিয়ে গাছের গোড়া ভিজিয়ে দেওয়া উচিত। এ ছাড়া, কপার অক্সিক্লোরাইড (৪ গ্রাম) বা ০.৫% বোর্দো মিশ্রণ ১৫ দিন অন্তর পাতার নীচের দিকে স্প্রে করতে হবে।
২) স্ক্লেরোসিয়াম জনিত গোড়া পচা রোগ (Rootrot) -
সাধারণত জ্যৈষ্ঠের প্রথম থেকে আষাঢ়-শ্রাবণ মাস পর্যন্ত এই রোগের প্রকোপ দেখা যায়। মাটি সংলগ্ন ডাঁটা ভেজা ভেজা মতো হয়ে পচে যায়, গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ে এবং গাছ ঢলে শুকিয়ে যায়। পচা জায়গার ওপর সাদা তুলোর মতো ছত্রাকের আবরণ দেখা যায়।
প্রতিকার -
আক্রান্ত পাতা ৬’’-৯’’ মাটি সমেত তুলে ফেলে পুড়িয়ে বা গভীর গর্ত করে পুঁতে দিতে হবে। এ ছাড়া প্রতি ১০০ বর্গমিটার জায়গায় ব্রাসিকল ২০% গুঁড়ো ২৫০ গ্রাম হারে মাটিতে ভালো ভাবে ছড়িয়ে দিয়ে সামান্য জল দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। অথবা ৭৫% ব্রাসিকল ৫ গ্রাম প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে পাতার গোড়ায় মাটি ও মাটি সংলগ্ন কাণ্ডটি ভালো ভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।
৩) পাতায় দাগ ধরা রোগ -
পাতায় কালো বা বাদামি রঙের অসংখ্য দাগ দেখা যায়। লতার নীচের দিকের পাতায় প্রথমে দেখা যায় পরে উপরের পাতাও আক্রান্ত হয়। দাগগুলি ঘিরে থাকে হলুদ আভা। অপেক্ষাকৃত গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এই রোগ লতার কাণ্ডে আক্রমণ করে থাকে। কাণ্ডের সবুজ ত্বকের নীচে গোলাকার ছোট দাগ পড়ে। পরে অনুকূল আবহাওয়ার কারণে দুই বা ততোধিক দাগ একত্রে মিলে কাণ্ডের চারিদিকে ছড়িয়ে যায়। দাগগুলি শেষে ফেটে গিয়ে ফোঁটা ফোঁটা আঠাও বেরোতে পারে। সাধারণত বর্ষার প্রারম্ভে বা শেষে এই রোগের প্রকোপ বাড়ে।
প্রতিকার -
প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসাবে বর্ষা শুরুর আগে কপার অক্সিক্লোরাইড ৪ গ্রাম / লিটার বা ০.৫% বোর্দো মিশ্রণ জলে গুলে ডাঁটায় ও পাতায় ভালো ভাবে স্প্রে করতে হবে। ২০ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।