২০২০ সাল এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী সমস্ত বিশ্বের মধ্যে একমাত্র ভারতেই পতিত জমির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি প্রায় ২৬,১৬৪ হেক্টর*I এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিং জেলার মধ্যে এই পতিত জমির পরিমাণ ১০,৮৩১.৫৫ হাজার হেক্টর# (মিরিক, কালিংপং ও সুখিয়াপোখ্রি ব্লক এ) Iআর " সম্পদের" সঠিক ব্যবহার যে দেশ,রাজ্য, জেলা যদি না করে তবে সেই এলাকার অর্থনীতি ভেঙে পড়বে এটাই স্বাভাবিক l মানুষ কর্মহীন হতে বাধ্য l সেই দেশ, বা রাজ্যের মানুষ অন্য কোন দেশে,বা রাজ্যে দক্ষ কিংবা অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে পরিযায়ী (MIGRATE) হবে এটা বাস্তব সত্য l দার্জিলিংসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার জেলাগুলিতে অধিকাংশ গরিব মানুষ দেশ অথবা রাজ্যের বাইরে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। দার্জিলিং জেলার ও বিভিন্ন ব্লক গুলিতে অধিকাংশ মানুষই দেখা যায় অন্য রাজ্যে, বিশেষতঃ আরব দেশগুলোতে ও পশ্চিম মধ্য প্রাচ্যের দেশ গুলিতে কাজ করতে যায় তাদের জীবন যাপনের তাগিদে l কিন্তু আমাদের দেশকে বলা হয় কৃষিনির্ভর ও খাদ্যে নির্ভরশীল একটি দেশ l অর্থাৎ খাদ্যের অভাব নেই, আর সবুজ বিপ্লবের প্রভাবে দেশ অনেকটাই "অর্থনৈতিক ভাবে মজবুত " l সত্যি কি তাই!?
কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে গোটা বিশ্বের অর্থনীতির একটি বিশাল পরিবর্তন হয়েছে l অনেক দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাই আজ ভেঙে পড়েছে, ভারতবর্ষের অর্থনীতি এর ব্যতিক্রম নয় l ২০২০ সাল এর **ফুড সিকিউরিটি ইন্ডেক্স (Food security index) যেখানে ১১৩ টি দেশের মধ্যে ৬৮ স্থান ভারতের সেখানে যা তথ্য দেখানো হয়েছে ১৩০ কোটি মানুষের দেশে সেটা সত্যি চিন্তার বিষয়! আসলে গরীব ও ধনী মানুষের মধ্যে যে অর্থনৈতিক পার্থক্য রয়েছে সেটা বড্ড ভয়াবহ l একটা গরীব মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আর একটা ধনী মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আকাশ পাতাল পার্থক্য আছে সেটা এই তথ্যসূত্র থেকেই আভাস পাওয়া যায় l যে ভাবে নিত্যদিনের খাদ্য দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে এই আশঙ্কা করা অমূলক নয় যে আগামী দশকে আরো গরীব মানুষ আরো গরীব এর পাশাপাশি অভুক্ত অবস্থায় থাকবে l
এছাড়া বিশ্ব ব্যাংক ভারতকে সতর্ক করছে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে গরীব মানুষ সংখ্যাটা প্রায় ৩০ কোটির কাছাকাছি যাবে যারা দিনে এক বেলার খাবার যোগান দিতে পারবেন না। আমাদের সাধারণ ও গরীব মানুষের খাদ্যের অভাব আছে জন্যই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে প্রাইমারি স্কুলের এক বেলা কিছুটা খাবার বা মিলের সংস্থান করা হয়েছে l
সুতরাং এটা নিয়ে গর্বিত হওয়ার থেকে চিন্তিত ও যত্নশীল হওয়া ভালো যে খাদ্যের স্বনির্ভর আমরা মনে করলেও সেই সবুজ বিপ্লবের সুফল বেশিরভাগ গরীব মানুষ পায়নি ,বরং এখন সেটা কুফল এর দিকেই এগুচ্ছে l ফসলে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহারের ফলে প্রায় সমস্ত খাদ্য ও পানীয় মধ্যে বিষ ঢুকে গেছে l জমিতে ফসলের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে l মাটি তার ‘জৈব মান’ (organic value) হারিয়ে ফেলেছে তাই " স্বজাতীয় স্বাদ ও গন্ধ হীন" খাদ্য উৎপাদন করে মানুষকে বিষের সাথে বিভিন্ন "রোগ ব্যাধি " উপহার দিয়েছে l প্রায় প্রতিটি পরিবার আজ রোগগ্রস্ত l এইদিকে বিশ্ব উষ্ণায়ন এর প্রভাবে আগামী শতকে " চাষির ফলন" আরো কমবে এটা বিজ্ঞানীরা বলতে শুরু করেছেন,বিশেষত "ধান,গম,উৎপাদন এর ক্ষেত্রে l
তাই সময় এসেছে " বিকল্প " কিছু ভাবার যেখানে চাষির খরচ কম হবে ও সেই উৎপাদন শেষে চাষী লাভবান থাকবেন এবং এমন বিষমুক্ত খাদ্য উৎপাদন হবে যা দেশের খাদ্যাভাব মিটিয়ে বিশ্বের চাহিদা মেটাতে পারে l
সেক্ষেত্রে "স্কন্দ জাতীয়" ফসল গুলি উল্লেখযোগ্য l এগুলি মধ্যে এমন কিছু যেমন- কাসাভা (শিমুল তরু),(শিমুল আলু) যা অতিরিক্ত তাপমাত্রা সহনশীল, সেচ লাগে না বললেই চলে, রাসায়নিক সার ব্যবহার করার তেমন কোন প্রয়োজন নেই l কাসাভা থেকে বিভিন্ন খাবার তৈয়ার করা যেতে পারে, এর থেকে সবজি, চাল থেকে শুরু করে নুডুলস রুটি সব কিছুই বানানো যেতে পারে l যেখানে সাধারণ আলু যেখানে ১৮ ভাগ শর্করা ও ১৬.৩% স্টার্চ যোগান দেয়, সেখানে কাসাভা আলু ৪০% শর্করা ও ৯০% স্টার্চ যোগান দেয়। আর কাসাভা আলুতে রয়েছে প্রচুর পরিমান ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ক্লুড ফাইবার ও ভিটামিন সি এর উপাদন বিভিন্ন পুষ্টি গুণে সমৃদ্ধ এই খাবার আফ্রিকা মহাদেশ ছাড়াও,আমেরিকা ,চীন ভিয়েতনাম,মায়ানমার, সহ বিভিন্ন দেশের মানুষ ও পশুর খাদ্য হিসেবে যথেষ্ট সমাদৃত l
আরও পড়ুনঃ মৎস্যমন্ত্রীর নিরলস পরিশ্রমে সুরক্ষিত হতে চলেছে ১৫ লক্ষ মৎস্যজীবীর জীবন
দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি ব্লক এ রানীগঞ্জ পানিসালি গ্রাম পঞ্চায়েত এর ৪ টি মৌজার পতিত জমিতে কিছু চাষি সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে এই চাষ করছেন বিগত ১০-১২ বছর ধরে l এখানে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ চাষি সাফল্যের সঙ্গে আনুমানিক ৫৫ থেকে ৬০ হেক্টর জমিতে কাসাভা চাষ করেছেন l শিমুল আলু চাষ এই জেলার মূলতঃ পাহাড়ি ও পাহাড় সংলগ্ন বিভিন্ন ব্লকের বাসিন্দারা পূর্বপুরুষ ধরেএই চাষ অল্প বিস্তর করে থাকেন, মূলত নেপালি, আদিবাসী ও ভুটান থেকে আগতআদিবাসী মানুষজন এই চাষ করে থাকেন I
স্বনামধন্য বিজ্ঞানী ডক্টর কাঞ্চন কুমার ভৌমিক বলেন ,(সিনিয়র সায়েন্টিস্ট এন্ড ন্যাশনাল এক্সপার্ট ,NRLM ,Govt। of India) কাসাভা চাষের সম্ভাবনা ভারতে প্রচুর। এই এলাকায় এটা চাষীদের একটি প্রধাণ ও বিকল্প চাষ হিসেবে চাষীরা চাষ করার উদ্যোগ নিলে তারা লাভবান হবেন "I
এই এলাকার বাসিন্দা ও চাষি শ্রী চেতরাজ ছেত্রী জানান," কোন রাসায়নিক সার ছাড়াই বিঘা প্রতি ২০ থেকে ২৮ মন অব্দি ফলন তারা এখন পান l তাদের কোনো "কীটনাশক " ব্যবহার করতে হয় না, সেই কারণে এই ফসলের তেমন কোনো রোগ ব্যাধি নেই l এমনকি অতিরিক্ত কোনো জল সেচের ও প্রয়োজন পড়ে না l
যদিও ফসল বাজারজাত করার সমস্যা এখানে রয়েছে যেটা অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও হয় তবু সম্পূর্ণভাবে জৈব একটি খাদ্য যা সারা বিশ্বের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষের খাদ্য সহায়ক যা দার্জিলিং জেলার একটি ব্লকে কিছু চাষির ব্যাক্তিগত উদ্যোগে চাষ হচ্ছে এটা সত্যি একটা ভালো খবর! পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিতে কাসাভা চাষযোগ্য পতিত জমিতে যদি এই শিমুল আলু চাষের উদ্যোগ নেওয়া যায় তবে তা বিশেষ লাভজনক হতে পারে এবং এই ব্লকের অন্যান্য এলাকাগুলোতে আরো চাষ বৃদ্ধি করা যেতে পারে ।
আরো ভালো ভাবে বলতে গেলে কেবলমাত্র শারীরিক শ্রম এর মাধ্যমে এই ১৫০ থেকে ২০০ জন চাষি মিলে প্রায় ৬০-৭০ লক্ষ টাকার সম্পূর্ণ জৈব খাদ্য পণ্য উৎপাদন করেন প্রতিবছর যার ভূগর্ভস্থ জল, ও রাসায়নিক কোনো কিছুরই এর প্রয়োজন হয় না ।
আমি মনে করি আজ এঁদের উদ্যোগের শুধু প্রয়োজন সঠিক বাণিজ্য করনের দিশা ও সরকারি সুযোগ সুবিধা সংক্রান্ত যোগাযোগ যা নাবার্ড দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন ফারমার্স প্রডিউসার কোম্পানি মাধ্যমে কিংবা ফারমার্স প্রডিউসার অর্গানাইজেশন এর মাধ্যমে সম্ভব l
-শ্রী অমরজ্যোতি রায় (Professional freelance writer, Krishijagran and Agriculture world)
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ডক্টর কাঞ্চন কুমার ভৌমিক (Senior scientist and national expert, NRLM,Govt.of India) ও মিস্টার কৌশিক দাস, বি, টি, এম,নক্সালবাড়ি,ফাঁসি দেওয়া)
@এই চাষ সম্মদ্ধে আরো বিস্তারিত জানতে চোখ রাখুন "কৃষিজাগরণ" এর আগামী খবরগুলিতে….
তথ্য সূত্র:
#https://economictimes.indiatimes.com/news/politics-and-nation/wb-govt-has-only-22k-acres-of-non-farm-land/articleshow/1835831.cms?from=mdr
*(https://www.google.com/amp/knoema.com/atlas/topics/Land-Use/Temporary-crops-and-meadows/Fallow-land%3fmode=amp)
**https://en.m.wikipedia.org/wiki/Global_Food_Security_Index