কৃষিজাগরন ডেস্কঃ রেশম চাষের প্রসারে ও উৎপাদনে ভারতবর্ষের স্থান চীনের পরেই পৃথিবীতে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী হলেও সিল্কের রকমফেরে বরাবরই আমরা সেরা এবং আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির সাথে ওতঃপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সিল্ক বা রেশম।
এই সবরকমের সিল্ক বা রেশম একমাত্র আমাদের দেশেই উৎপাদিত হয় যার মধ্যে মুগ রেশম ভৌগলিকভাবে মুগা ভারতের এবং অসম রাজ্যের সম্পদ বলে আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃতি পেয়েছে। সাম্প্রতীক কালে আমাদের রাজ্যের কুচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলার মুগার চাষ করা হচ্চে এবং ফলও খুব ভালো। মুগার সোনালী উজ্জ্বল রং-এর জন্য ও এর স্থায়িত্বের কারনে এর চাহিদা পৃথিবী ব্যাপী। মুগা পৃথিবীর দুর্লভ রেশমের মধ্যে একটি।
ভারতে রেশম শিল্পের সর্বোচ্চ সংস্থা হল- কেন্দ্রীয় রেশম পর্ষদ । আমাদের রাজ্যে বহরমপুর ও কর্নাটকের মাইসোর শহরে সেরিকালচার গবেষনা কেন্দ্র এবং যোরহাট-এ অবস্থিত মুগা ও এরি গবেষনা ও প্রশিক্ষন সংস্থা এবং রাঁচি তে আছে তসর গবেষনা ও প্রশিক্ষন সংস্থা।
আরও পড়ুনঃ রাহুলের নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী করার আরজি কংগ্রেসের
রেশমতন্তু বা সূতো রেশন মতের লার্ভার লালাগ্রন্থি থেকে নিংস্বৃত প্রোটিন-জাতীয় তন্তু । রেশম পোকা বা পলুর ইংরাজী নাম silkworn বা রেশমকীট। মুগা প্রজাতির রেশমকীট থেকে পাওয়া যায় মুগা সিল্ক। অসমে মুগাকীটের পালন প্রবম কোথায় আরম্ভ হয়েছিল তা বলা কঠিন যদিও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে মুগার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়-এটি ৩২১খৃষ্ঠপূর্বের কথা । অহম যুগে এর প্রচলন বৃদ্ধি পায় এবং তা অহম রাজপরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অসমের ভৌগলিক অবস্তান ও জলবায়ু মুগা পালমের জন্য সবচেয়ে উপযোগী যদিও পাশ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে বিশেষ করে আমাদের রাজ্যের কোচবিহার,আলিপুরদুয়ার ,জলপাইগুড়ি ও কালিম্পং জেলায় ব্যাপকভাবে এর চাষ এখন প্রসারিত।
মুগা রেশমকীট নির্দিষ্ট কিছু উদ্ভিদের পাতা খায়-যেমন সোয়ালু এছাড়াও কিছু গেটন পোষক উদ্ভিদতও আছে –দিগলতে , গানসরাই এবং মেজাংকারী । মেজাংকারী গাছে মুগাপালনের ফলে উৎপাদিত সিল্কের রং সোনালী রং এর পরিবর্তে সাদা হয় এবং এটি মেজাংকারী সিল্ক নামে পরিচিত –এবং এটিকে সর্বোকৃষ্ট বলে গন্য করা হয়।
মুগা রেশমকীটের জীবনচক্র চারটি দশার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়- ডিম ,লার্ভা বা পলু ,পিউপা এবং মথ। সোনালী হলুদবর্ণ প্রদানকারী মুগা রেশমকীট অর্ধগৃহপালিত কারন লার্ভা দশা সম্পন্ন হবার পর তারা পোষক উদ্ভিদ বেয়ে নীচে নেমে আসে এবং এই পরিপক্ক পলুমুগ চাষী সংগ্রহ করে থাকেন ও তাঁর নিজেদের গৃহেই গুটি বা কোকুন বুননের জন্যে রাখেন। মূলত সোম ও সোয়ালু গাছেই প্রতিপালন করা হয় । একটি স্ত্রী মথ ১৫০-২০০ ডিম দেয় । স্ত্রী মুগা মথকে সোমগাছের ডালে বেঁধে দেওয়া হয় ডিম পাড়ার জন্য –লার্ভাগুলি পরে সোম বা সোয়ালু গাছে ছেড়ে দেওয়া হয় প্রতিপালনের জন্য । মুগা লার্ভার একটি বিশেষ স্বভাব হল পোষক উদ্ভিদে পাতা না থাকলে দলবাদ্ধভাবে গাছের নীচে নেমে আসে । পোষক উদ্ভিদের নীচের দিকে গাবিবাদ্ধ (অসমীয়াতে)বাঁধা হয় যা মূলত কলাগাছের বাকল দিয়ে তৈরী। গারীবান্ধ বাঁধার ফলে মুগা লার্ভা নীচে নামতে পারেন। এই সময়ে চাষীরা চালত্রি (বাঁশ দিয়ে তৈরী ত্রিভুজাকৃত যন্ত্রবিশেষ ) এর মাধ্যমে একগাছ থেকে অন্য গাছে স্থানান্তর করে। লার্ভা দশা অসপন্ন হবার পর পরিপক্ক লার্ভা সন্ধ্যাবেলায় গাছের নীচে নেমে আসে এবং তখন মুগা চাষীরা পলু সংগ্রহ করে শুকনো সোম বা কাঁঠাল পাতা দিয়ে তৈরী জালিতে রেখে গুটিকা কোকুন বুননেড় উদ্দেশ্যে । কোকুনগুলি সোনালী হলুদ বর্নের হয় । কোকুন বা গুটি সংগ্রহ করে ভিড় বা ভাংরী নামক যন্ত্রের সাহায্যে গুটি কাটাই বা রিলিং করে মুগা চাষী সোনালী মুগা সূতো আহরন করেন। ডিম উৎপাদনের উদ্দেশ্যে রাগ কোকুন বা গুটি থেকে মথ বেরিয়ে আসে ও প্রজননের মাধ্যমে পুনরায় জীবনচক্র সম্পন্ন করে।
এক কিলো গ্রাম মুগ সুতোর দাম প্রায় পাঁচ হাজার টাকা । এর থেকেই আমরা মুগার মূল্যায়ন করতে পারি কিছুটা । উৎপাদনের দিক থেকে অসমের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার যোরহট ,শিবসাগর,ডিব্রুগড় এবং কামরুপ জেলাতে সর্বাধিক উৎপাদন হয়-এর মধ্যে কামরুপ জেলার শুয়ালকুচি হল বিশ্বের সর্ববৃহৎ রেশম উৎপুাদনকারী গ্রাম (আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে )। যোরহাট জেলার লাভোইগড়ে মূল গবেষনা ও সম্প্রসারন কেন্দ্র অবস্থিত। আমাদের কোচবিহার জেলায় তারই আঙ্চলিক গবেষনা কেন্দ্র ।কোচবিহার,কালিম্পং,আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়িতে অনুকূল তাপমাত্রা (২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি) ও আপেক্ষিক আদ্রতা (৬৫-৯৫ শতাংশ) মুগা পালনের খুবই সহায়ক। এখনও দূষনের মাত্রা ও তাপমাত্রার হেরফের এই জায়গাগুলিতে সহনীয় মাত্রায় থাকা একটু সুবিধা দান করে এই চাষকে।
আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির সাথে রেশমের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ।সর্বোপরি-রেশমচাষে মূলত কৃষি নির্ভর উদ্যোগ যার মধ্যে খাদ্য গাছের পালন ও রেশমকীট নলেন অর্ন্তভুক্ত । এই শিল্পে নিযুক্ত মানুষের সংখ্যা কোনো অংশেই ফেলা যায় না। মৃত পিউপাগুলি শুকিয়ে মাছের বিশেষ করে মাগুর,শিঙি , কই, চিতল ,পাবদা ও ট্যাংরার উরকৃষ্ট খাবার অনুপাত হিসাবে ব্যবহার হয়। চিরায়ত ঐতিহ্যপূর্ন সিল্কের জন্য বিস্তৃত হোক রেশম চাষ বা সেরিকালচার যা গ্রামীন বিকাশের সহায়ক।
ড়ঃপ্রতাপ মুখোপাধ্যায় ,অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিজ্ঞানী,ICAR-CIFA)
দীপক কুমার পাল,সেরিকালচার M.SC চতুর্থ সেমিস্টার