তরমুজ নামটা শুনলেই আবালবৃদ্ধবনিতার জিভে জল চলে আসতে বাধ্য। এই ফল এতটাই সুমিষ্ট যে, পাতে পড়লে এক নিমেষে সব শেষ! গ্রীষ্মকালীন এই ফলের চাষ আমাদের রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল, অর্থাৎ পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, বীরভূমে প্রচুর পরিমাণে হয়। মজার বিষয়, এই ফল অত্যন্ত রসালো হলেও, এর চাষে প্রয়োজন রুখা-শুখা জমি। তাই বাঁকুড়া, বীরভুমের, পুরুলিয়ার রুক্ষ, শুষ্ক মাটি এই ফলের চাষের জন্য আদর্শ বলে বিবেচিত হয়। তরমুজে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। এই ফল খাওয়ার ফলে দেহের অক্সিডেটিভ স্ট্রেসজনিত রোগ হ্রাস পায়। তরমুজ নিয়ম করে খেলে প্রোস্টেট ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সার ও ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
চোখের জ্যোতি প্রখর করতে তরমুজের কোনও বিকল্প নেই। তরমুজ রাতকানা রোগের নিরাময়ক হিসাবেও অত্যন্ত জনপ্রিয়। তরমুজে প্রচুর জল এবং সামান্য মাত্রায় ক্যালরি থাকায় পেট ভর্তি করে তরমুজ খেলেও ওজন বাড়ার ভয় থাকে না। চিকিৎসকদের মতে তরমুজ নিয়মিত খেলে উচ্চ রক্তচাপও কমে যায়।
পুষ্টিকর তরমুজ- Watermelon nutrients:
জলের পরিমাণ তরমুজে অত্যন্ত বেশি। এর ৯২ শতাংশই জল। মাত্র ৬ শতাংশ চিনি এবং ২ শতাংশ অন্যন্য উপাদান নিয়ে এই ফলের বাকিটা গড়ে ওঠে। ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ এই ফল শরীরে জলের অভাব অনেকাংশে দূর করে। তরমুজে আছে পর্যাপ্ত ভিটামিন এ, সি, পটাশিয়াম ও আঁশ। তরমুজ ভিটামিন ‘বি৬’-এর অন্যতম সেরা উৎস হিসাবে গবেষণায় প্রমাণিত। মস্তিষ্কের কার্যক্রম সচল রাখতেও এই ফলের জুড়ি মেলা ভার।
তরমুজ চাষের পদ্ধতি- (Cultivation Process)
১. জমি তৈরি -
প্রয়োজন মতো চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। জমি তৈরির পর সার প্রয়োগ করে চারা লাগানো উচিত।
২.বীজ বপন সময় -
ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত আবহাওয়া তরমুজ চাষের উপযোগী। বীজ বোনার জন্য ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম পক্ষ সর্বোত্তম।
৩.রোপণ পদ্ধতি -
সাধারণত মাঠে সরাসরি বীজ বপন পদ্ধতি প্রচলিত থাকলেও এখন আগে চারা তৈরি করে জমিতে চারা রোপণ করাই উত্তম।
৪. বীজ বপন -
সাধারণত প্রতি সারিতে ৪-৫টি বীজ বপন করা হয়। বপনের ৮-১০ দিন আগে জমি তৈরি করে মাটিতে সার মিশাতে হয়। দু মিটার দূরে দূরে সারি করতে হয়। প্রতি সারি ৫০ সেমি. প্রশস্ত ও ৩০ সেমি. গভীর হওয়া বাঞ্চনীয়।
৫. চারা রোপণ -
বীজ বপণের চেয়ে তরমুজ চাষের জন্য চারা রোপণ করা উত্তম। এতে বীজের অপচয় কম হয়। চারা তৈরির জন্য ছোট ছোট পলিথিনের ব্যাগে বালি ও পচা গোবর সার ভর্তি করে প্রতি ব্যাগে একটি করে বীজ বপন করা হয়। ৩০-৩৫ দিন বয়সের ৫-৬ পাতাবিশিষ্ট একটি চারা মাঠে রোপণ করা হয়।
৬. বীজের পরিমাণ -
প্রতি একরে ৩৫০-৪০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
৭.সার প্রয়োগ -
তরমুজের জমিতে নিম্নোক্ত হারে সার প্রয়োগ করা যেতে পারে-
সারঃ একর প্রতি
গোবর/কম্পোস্ট ৮ টন সব
টিএসপি ৪০ কেজি সব
মুক্তাপ্লাস (জিংক সালফেট) ৫ কেজি সব
ম্যাগপ্লাস (ম্যাগনেসিয়াম সালফেট) ৯-১০ কেজি সব
হেসালফ (৮০% সালফার) ৩ কেজি সব
কার্বোফুরান/ফিপ্রোনিল জাতীয় দানাদার ১০-১২ কেজি সব
পরবর্তী পরিচর্যা হিসাবে -
১ম কিস্তি- (চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর)- ইউরিয়া- ৪০ কেজি- এমপি ৩২ কেজি
২য় কিস্তি- (প্রথম ফুল ফোটার সময়)- ইউরিয়া- ২৫ কেজি- এমপি ৩২ কেজি
৩য় কিস্তি- (ফল ধারণের সময়)- ইউরিয়া- ২৫ কেজি- এমপি ৩২ কেজি
৪র্থ কিস্তি- (ফল ধারণের ১৫-২০ দিন পর)- ইউরিয়া- ২৫ কেজি- এমপি ৩২ কেজি
৮. বীজের অঙ্কুরোদগম – (Seed Germination)
শীতকালে খুব ঠাণ্ডা থাকলে বীজ ১২ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে গোবর মাটির ভেতরে কিংবা মাটির পাত্রে রক্ষিত বালির ভেতরে রেখে দিলে ২-৩ দিনের মধ্যে বীজ অঙ্কুরিত হয়। বীজের অঙ্কুর দেখা দিলেই বীজ তলায় অথবা মাঠে স্থানান্তর করা ভালো।
৯. অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা -
শুকনো মৌসুমে সেচ দেওয়া খুব প্রয়োজন। গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। প্রতিটি গাছে ৩-৪টির বেশি ফল রাখতে নেই। গাছের শাখার মাঝামাঝি গিটে যে ফল হয় সেটি রাখতে হয়। চারটি শাখায় চারটি ফলই যথেষ্ট। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ৩০টি পাতার জন্য মাত্র একটি ফল রাখা উচিত।
১০.পরাগায়ন -
সকালবেলা স্ত্রী ও পুরুষ ফুল ফোটার সাথে সাথে স্ত্রী ফুলকে পুরুষ ফুল দিয়ে পরাগায়িত করে দিলে ফলন ভালো হয়।
১১.তরমুজের পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন( paste control)
১.পাতার বিটল পোকা -
প্রথম দিকে পোকাগুলোর সংখ্যা যখন কম থাকে তখন পোকা ডিম ও বাচ্চা ধরে নষ্ট করে ফেলতে হবে। পোকার সংখ্যা বেশি হলে রিপকর্ড ১০ইসি/ রিজেন্ট ৫০ এসসি ০১ মিলি/লিটার মাত্রায় অথবা মিপসিন ৭৫ ডব্লিউপি ২.৫গ্রাম/লিটার বা হেক্লেম ৫ এসজি ১০ গ্রাম/১০লিটার মাত্রায় যেকোন একটি ৫-৭ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।
২.জাব পোকা -
এ পোকা গাছের কচি কাণ্ড, ডগা ও পাতার রস শুষে খেয়ে ক্ষতি করে। এ পোকা দমনের জন্য হেমিডর অথবা প্রিমিডর (ইমিডাক্লোপ্রিড) ৭০ ডব্লিউজি ০২গ্রাম/১০লিটার অথবা নোভাস্টার (বাইফেনথ্রিন+এবামেকটিন) ৫৬ ইসি/টলস্টার ২.৫ ইসি ০২ মিলি/লিটার স্প্রে করতে হবে।
৩.ফল ছিদ্রকারী পোকা -
স্ত্রী পোকা ফলের খোসার নিচে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কীড়াগুলো বের হয়ে ফল খেয়ে নষ্ট করে ফেলে এবং ফলগুলো সাধারণত পচে যায়। এ পোকা দমনের জন্য রিপকর্ড/রিজেন্ট/হেক্লেম স্প্রে করতে হবে। ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪.লাল মাকড়/হলুদ মাকড় -
চেনার উপায় : এরা দেখতে অতি ক্ষুদ্র। পাতার নীচে থাকে।
ক্ষতির ধরণ : পাতার রস চুষে খায়। পাতা কুঁচকে শুকিয়ে যায়। পরে পাতা ঝড়ে পরে। কুশির বৃদ্ধি থেমে যায়।
আক্রমণের পর্যায় : বাড়ন্ত পর্যায়
ফসলের যে অংশে আক্রমণ করে : পাতা
দমন ব্যবস্থা :
১। সালফার জাতীয় বালাইনাশক (যেমন হেসালফ ৮০% ডিএফ, কুমুলাস ৮০% ডিএফ, ম্যাক সালফার ৮০ ডব্লিউপি, থিয়োভিট ৮০ ডব্লিউজি প্রতি লিটার পানিতে ২গ্রাম হারে মিশিয়ে) ১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করুন।
২। ইন্ট্রাপিড ১০এসসি/ নোভাস্টার ৫৬ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০২মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। অথবা পাইমেট্রজিন/ মিথাইল আইসোপ্রোকার্ব/ এবামেকটিন জাতীয় মাকড়নাশক স্প্রে করতে হবে।
৫.থ্রিপস -
চেনার উপায় : এরা দেখতে অতি ক্ষুদ্র। পাতার উপরে থাকে।
ক্ষতির ধরণ : পাতার রস চুষে খায়। পাতা কুঁচকে শুকিয়ে যায়। পরে পাতা ঝড়ে পরে। কুশির বৃদ্ধি থেমে যায়।
আক্রমণের পর্যায় : বাড়ন্ত পর্যায়
ফসলের যে অংশে আক্রমণ করে : পাতা
আরও পড়ুন: Sustainable Agriculture System: সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থা: বর্তমান ও ভবিষ্যতের সম্পদ
দমন ব্যবস্থা :
ইন্ট্রাপিড ১০এসসি/ নোভাস্টার ৫৬ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০২মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। অথবা পাইমেট্রজিন/ মিথাইল আইসোপ্রোকার্ব/ এবামেকটিন জাতীয় মাকড়নাশক স্প্রে করতে হবে।
৬.কাণ্ড পচা রোগ -
এ রোগের আক্রমণে তরমুজ গাছের গোড়ার কাছের কাণ্ড পঁচে গাছ মরে যায়। প্রতিকারের জন্য ৪ গ্রাম হেমেনকোজেব অথবা একরোবেট এমজেড+ডিফেন্স ৩৫এসসি ০১মিলি/ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫-৭ দিন পর পর গাছে স্প্রে করতে হবে। অথবা কোগার (এজক্সিস্ট্রবিন+সিপ্রোকোনাজল) ২৮ এসসি ০১মিলি/ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫-৭ দিন পর পর গাছে স্প্রে করতে হবে।
৭.ফিউজেরিয়াম উইল্ট রোগ -
এ রোগের আক্রমণে গাছ ঢলে পড়ে মারা যায়। জল নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করা হলে এ রোগের প্রকোপ কম থাকে। রোগাক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
১২.ফসল সংগ্রহ – (Harvesting)
জাত ও আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে তরমুজ পাকে। সাধারণত ফল পাকতে বীজ বোনার পর থেকে ৮০-১১০ দিন সময় লাগে। তরমুজের ফল পাকার সঠিক সময় নির্নয় করা একটু কঠিন। কারণ অধিকাংশ ফলে পাকার সময় কোনো বাহ্যিক লক্ষণ দেখা যায় না। তবে নীচের লক্ষণগুলো দেখে তরমুজ পাকা কি না তা অনেকটা অনুমান করা যায়-
১.ফলের বোঁটার সঙ্গে যে আকর্শি থাকে তা শুকিয়ে বাদামি রং হয়।
২.খোসার উপরে সূক্ষ লোমগুলো মরে পড়ে গিয়ে তরমুজের খোসা চকচকে হয়।
৩.তরমুজের যে অংশটি মাটির ওপর লেগে থাকে তা সবুজ থেকে উজ্জল হলুদ রংঙের হয়ে ওঠে।
৪.তরমুজের শাঁস লাল টকটকে হয়।
১৩.ফলন (Production)
সযত্নে চাষ করলে ভালো জাতের তরমুজ থেকে প্রতি হেক্টরে ৫০-৬০ টন ফলন পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন: Anjeer Farming process: ওষধি ফল আঞ্জির চাষ করে হয়ে উঠুন লাভবান