পুরুলিয়ায় লাল-কাঁকুরে মাটিতে চিনাবাদাম ফলিয়ে আয়ের দিশা দেখছেন কৃষকরা। জেলার পুরুলিয়া ব্লকের পাশাপাশি রঘুনাথপুর, ঝালদা, মানবাজার, হুড়া, নিতুড়িয়া এলাকায় প্রচুর জমিতে চিনাবাদাম চাষ শুরু হয়েছে। প্রতিটি ব্লকে গড়ে তিনশো কৃষক চিনাবাদাম চাষ করছেন বলে কৃষিদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে। যেসব কৃষক চিনাবাদাম চাষে উদ্যোগী হয়েছেন, কৃষিদপ্তরের পক্ষ থেকে তাঁদের বীজ, সার, কীটনাশকের পাশাপাশি বিজ্ঞানসম্মত চাষ পদ্ধতির প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরুলিয়ার যে আবহাওয়া তাতে একটু পরিচর্যা করলে এই জেলায় চিনাবাদামের খুব ভালো ফলন হতে পারে। চিনাবাদাম চাষের জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া প্রয়োজন। সেইসঙ্গে ২১-২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও ৫০০-১২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত চিনাবাদাম চাষের পক্ষে আদর্শ। জমিতে জল দাঁড়ানো কিংবা তুষারপাত চিনাবাদাম মোটেই সহ্য করতে পারে না।
সব মাটিতেই চিনাবাদাম চাষ হলেও বেলে ও দোঁয়াশ মাটি এই চাষের পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী। মাটির পিএইচ মাত্রা ৬-৭-এর মধ্যে থাকলে ভালো। জমি তৈরির সময় মাটিতে চুন ও জৈব পদার্থ মেশাতে হবে। চিনাবাদামের ফুল মাটির উপরে ফোটে, কিন্তু শুঁটি গঠন হওয়ার পর মাটির নীচে চলে যায়। সেখানেই শুঁটি পুষ্ট হয়ে বাদামে পরিণত হয়। সেকারণে জলনিকাশি ব্যবস্থাযুক্ত ঝুরঝুরে মাটিতে চিনাবাদাম চাষ ভালো হয়।
বীজের অঙ্কুরোদগমের ৪-৫ দিন পর শিকড় বের হয়। ১২-১৫দিন পর অর্বুদ তৈরি হয় শিকড়ে। একটি গাছে ৮০০-৪০০০ পর্যন্ত অর্বুদ হতে পারে। তবে, বোনার ৮০ দিনের পর থেকে অর্বুদের সংখ্যা কমতে থাকে। ফুল ফোটার ২৫দিনের মধ্যে শুঁটির ভিতরে ছোট শস্য এবং ওপরের খোসা গঠিত হয়। ৬০ দিনের মধ্যে ভিতরের শস্য এবং ওপরের খোসা হলুদ হয়ে যায় অর্থাৎ ফসল কাটার উপযুক্ত হয় বলে জানিয়েছেন পুরুলিয়ার নিতুড়িয়া ব্লকের সহকারি কৃষি অধিকর্তা পরিমল বর্মন। িতনি জানিয়েছেন, জমিতে চুন প্রয়োগ করলে চিনাবাদাম গাছে অর্বুদ ও শুঁটির গঠন ভালো হয়। চিনাবাদামের শুঁটি গঠন ও বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আলফা এনএএ। একরে ১৬০০ কেজি জৈবসার প্রয়োগ করে ৩-৪বার জমি ভালোভাবে চাষ দিয়ে মাটি হাল্কা ও ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। যেহেতু চিনাবাদামে ঢলে পড়া রোগের আশঙ্কা থাকে, তাই ১০০কেজি পচা গোবর সার বা কেঁচো সারের সঙ্গে এক কেজি ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি ও সিউডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স মিশিয়ে এক সপ্তাহ আর্দ্রতাযুক্ত জায়গায় রেখে শেষ চাষের সময় জমিতে ছিটিয়ে দিতে হবে।
এক একর জমিতে চিনাবাদাম চাষ করতে হলে খোসা সহ ৫০ কেজি এবং খোসা ছাড়ানো ৩০ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। খোসা ছাড়ানো বীজ-ই বপন করা উচিত, তাতে অঙ্কুরোদগম তাড়াতাড়ি হয়। ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি ও সিউডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। প্রতি কেজি বীজের ক্ষেত্রে ৫ গ্রাম মাত্রায় এক লিটার জলে মিশিয়ে সেই দ্রবণে তিন ঘণ্টা বীজ ভিজিয়ে রাখতে হবে।
রবি মরশুমে চিনাবাদাম চাষ করলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বীজ বুনতে হবে। এছাড়া খরিফ মরশুমে চাষের জন্য মে-জুন মাসে এবং প্রাক-খরিফ মরশুমে চাষের জন্য ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে বীজ বসাতে হবে। একক ফসল হিসেবে চাষ করলে দাঁড়ানো জাতের ক্ষেত্রে সারি থেকে সারি ২৫ সেন্টিমিটার এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব রাখতে হবে ১৫ সেমি। ছড়ানো জাত হলে সারি থেকে সারি ৪৫ সেন্টিমিটার এবং গাছ থেকে গাছ ১৫ সেমি দূরত্ব রাখতে হবে। মিশ্র ফসল হিসেবে গম, তিল, অড়হরের সঙ্গে চিনাবাদাম চাষ করা যায়। পর্যায়ক্রমে চিনাবাদাম চাষ করলে জমির উর্বরতা বাড়ে। ৫ সেন্টিমিটার গভীরে বীজ বুনে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া উচিত।
চিনাবাদামের উন্নত জাতের মধ্যে রয়েছে একে-১২-২৪, টিএমভি ৭, টিএমভি ১০, টিজি ৩৮ প্রভৃতি। এক একর জমিতে চিনাবাদাম চাষের জন্য ১৫০০ কেজি গোবর সার, ১৫০ কেজি নিমখোল প্রয়োগ করতে হবে। রাসায়নিক সারের ক্ষেত্রে ১৫কেজি ইউরিয়া, ১০০কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট, ২৪ কেজি মিউরিয়েট অফ পটাশ, ২০০ কেজি জিপসাম প্রয়োগ করতে পারলে ভালো। চিনাবাদাম চাষে অনুখাদ্য হিসেবে একরে ৮ কেজি জিঙ্ক সালফেট, ২ কেজি বোরন, ৪০০ গ্রাম মলিবডেনাম দেওয়া উচিত। ফলন বৃদ্ধির জন্য বীজ বোনার ৫০দিনের মধ্যে আলফা এনএএ ২০ পিপিএম প্রতি লিটার জলে ১ মিলি আঠা সহ মিশিয়ে পাতায় স্প্রে করতে হবে। চিনাবাদাম চাষে অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা বিশেষ জরুরি। জিপসাম ও মিউরিয়েট অফ পটাশ প্রয়োগের পর গাছের গোড়ায় মাটি ধরাতে হবে। ১০-১২দিন অন্তর হাল্কা সেচ দিতে হবে। বীজ বোনার আগে একটি সেচ, ফুল আসার সময় একটি এবং শুঁটি পরিপক্ক হওয়ার সময় আর একটি সেচ দেওয়া আবশ্যিক।
সৌজন্যে - বর্তমান
- Sushmita Kundu