বিশেষজ্ঞদের মতে তুলোর পরেই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ তন্তু জাতীয় ফসল হল পাট। বিশ্বের মোট পাট উৎপাদনের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ পাট ভারতে উৎপন্ন হয়। পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ করে দক্ষিনবঙ্গের মাটির প্রকৃতি ও জলবায়ু পাটচাষের জন্য খুবই উপযোগী। আমাদের রাজ্যে পূর্বে প্রায় ১০ লক্ষ হেক্টর জমিতে পাটচাষ হত, কিন্তু এখন তা কমে ৬ লক্ষ হেক্টর হয়েছে। পাটের উপযুক্ত দাম ও পাট পচানোর জলের অভাবে এরাজ্যে পাটচাষ ক্রমশ কমে আসছে।
পাট বর্ষাকালীন ফসল। পাটশাক পুষ্টিগুণে ভরপুর। পাটশাকে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন, মিনেরালস, ফলিক অ্যসিড, প্রোটিন, লিপিড, অ্যালকালয়েডস রয়েছে। পাটশাকে প্রচুর ক্যারোটিন ও ভিটামিন সি থাকায় এটি মুখের ঘা , রাতকানা ও অন্ধত্ব দূরীকরণে সহায়তা করে। পাট তন্তু থেকে তৈরি করা সামগ্রী যেমন ব্যাগ, টুপি, জুতো, পাপোশ, কারপেট ইত্যাদি পরিবেশবান্ধব সামগ্রী হিসেবে প্লাস্টিকের সামগ্রীর পরিবর্ত হিসেবে ব্যবহারের চল ইদানিং বেড়েছে। পাটের আঁশের গুনমান ও আন্তর্জাতীক মানের হয়েছে। তাই বর্তমানে উন্নত বিজ্ঞানসম্মত পাটচাষ করে লাভের মুখ দেখতে পারেন চাষিভাইরা।
পাটের বিভিন্ন জাত নির্বাচন
সাধারণতঃ প্রশম নবীন পলিমাটি হওয়ায় দক্ষিণবঙ্গে মূলতঃ মিঠা পাটের চাষ-ই ভাল হয়। নীচে তালিকায় কিছু উন্নত মিঠাপাটের জাত উল্লেখ করা হল।
জাত |
বোনার সময় |
বৈশিষ্ট্য |
ফলন / বিঘা |
JRO-৫২৪ (নবীন), JRO-৭৮৩৫ (বাসুদেব), JRO-৮৪৩২ (শক্তি), S-১৯ (সুবলা) |
চৈত্রের শুরু থেকে বৈশাখের মাঝামাঝি পর্যন্ত। |
আগে লাগাবার (early showing) জাত হওয়ায় আমন ধানকে সঠিক সময় বুনতে সুযোগ করে দেয়। |
৪.৫-৫ কুইন্টাল |
JRO-৬৩২ (বৈশাখী), JRO-৩৬৯০, JRO-৬৬ (সুবর্ণজয়ন্তী) |
বৈশাখ থেকে জৈষ্ঠ |
দেরীতে বোনার উপযোগী জাত |
JRO-৬৬ – ৪.৫-৫ কুইন্টাল, বাকি ৩.৫-৪ কুইন্টাল |
জমি তৈরি :
উঁচু ও মধ্যম উঁচু জমি যেখানে বৃষ্টির জল বেশি সময় দাঁড়ায় না এবং দো-আঁশ মাটি পাট চাষের জন্য বেশি উপযোগী। বৃষ্টিপাতের পরপরই আড়াআড়ি ৫-৭ টি চাষ দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। ঢেলা গুড়ো করতে হবে এবং জমি আগাছা-মুক্ত করতে হবে।
সার প্রয়োগ :
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ (একর-প্রতি)
গোবর: ৪০০০-৫০০০ কেজি
ইউরিয়া: ৭০-৮০ কেজি
টিএসপিঃ ৪০ কেজি
এমপিঃ ৫০-৫৫ কেজি
জিপসামঃ ৪০ কেজি
দস্তা সারঃ ৪ কেজি
বোরাক্সঃ ৩ কেজি
বি:দ্র: জমিতে দস্তা ও গন্ধকের অভাব না থাকলে জিপসাম ও জিংক সালফেট ব্যবহার করার প্রয়োজন নাই। দস্তা ও টিএসপি একসাথে মিশিয়ে দেওয়া যাবে না।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি
-
গোবর সার অবশ্যই বীজ বপনের ২-৩ সপ্তাহ পূর্বে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
-
প্রয়োগকৃত গোবার সার চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
-
বীজ বপনের দিন প্রয়োজনীয় পরিমাণের ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম এবং জিংক সালফেট সার জমিতে শেষ
-
চাষের সময় মই দিয়ে মাটির সাথে ভাল করে মিশিয়ে দিতে হবে।
-
দ্বিতীয় কিস্তির (৪৫ দিনে) ইউরিয়া সার প্রয়োগের সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে রস থাকে।
-
দ্বিতীয় কিস্তির প্রয়োজনীয় পরিমাণের ইউরিয়া সার কিছু শুকনো মাটির সাথে মিশিয়ে জমিতে প্রয়োগ করা ভাল।
-
প্রয়োগকৃত ইউরিয়া সার ‘হো’ যন্ত্রের সাহায্যে অথবা প্রচলিত নিড়ানির সাহায্যে ভাল করে জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
-
ইউরিয়া সার প্রয়োগের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন প্রয়োগকৃত সার গাছের কচি পাতায় এবং ডগায় না লাগে।
বীজ বপন
সময়মত পাট বীজ বপন করা উচিত। সাধারণত ছিটিয়েই পাট-বীজ বপন করা হয়। তবে লাইন করে বপন করলে পাটের ফলন বেশি হয়।
বীজের হার
ছিটিয়ে বুনলে-৬.৫-৭.৫ কেজি/হেক্টর, লাইন করে বুনলে-৩.৫-৫.০০ কেজি/হেক্টর। লাইন করে বুনলে লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ৩০ সেমি বা এক ফুট এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৭-১০ সেমি বা ৩-৪ ইঞ্চি হতে হবে।
বীজ শোধন পদ্ধতি
একটা ঢাকনাওয়ালা কাচের, প্লাস্টিকের বা টিনের পাত্রে প্রতি ১ কেজি বীজের জন্য ৪ গ্রাম ভিটা-ভেট-২০০ (০.৪%) বীজের সঙ্গে মিশাতে হবে। পাত্রের মুখ বন্ধ করে রাখতে হবে। তারপর সমানে পাত্রটি ঝাঁকাতে হবে। শোধিত বীজ এমন পাত্রে রাখতে হবে যাতে বাতাস যেতে না পারে।
আগাছা দমন
বীজ বপনের ১৫-২১ দিনের মধ্যে ১ম নিড়ানি এবং ৩৫-৪২ দিনের মধ্যে ২য় নিড়ানি দিয়ে আগাছা দমন ও চারা পাতলা করতে হবে।
পাটের ক্ষতিকর পোকামাকড়
১. হলুদ মাকড় –
প্রতিকার –
- পরিষ্কার চাষ ও সুসম সার প্রয়োগ।
- আক্রমণ ১০ % এর বেশী হলে ২.৫ মিলি এন্ডোসালফান প্রতি লি. জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
২. বিছা পোকা বা শুঁয়ো পোকা-
প্রতিকার –
- আক্রান্ত গাছের উপরের পাতা সাদা হয়ে যায় । শুঁয়োপোকাগুলি পাতা সমেত তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
- আক্রমণ বেশি হলে ২.৫ মিলি এন্ডোসালফান প্রতি লি. জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
৩. ঘোড়া বা ছটকা পোকা-
প্রতিকার –
- নিমতেল ৪ মিলি /লি. জলে গুলে স্প্রে
- আক্রমণ বেশি হলে ২.৫ মিলি এন্ডোসালফান প্রতি লি. জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
৪. কাথারী পোকা- চারা অবস্থায় এদের আক্রমণ বেশি হয়।
প্রতিকার –
- আক্রমণ বেশি হলে ২.৫ মিলি এন্ডোসালফান প্রতি লি. জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
ফসল সংগ্রহ
১২০ দিন বয়স পার হলে যখন ফুল আসে তখন সংগ্রহের উপযুক্ত সময়।
ফসল সংগ্রহের পর করণীয়
• পাটের গাছ লম্বা, মোটা ও চিকন গুলো বাছাই করতে হবে;
• ১০ কেজি করে আঁটি করতে হবে;
• আঁটিগুলো বেশি শক্ত করা যাবে না;
• জাগের সময় মাটি, মাটির ঢেলা, ঝিগার গাছ, কলা গাছ ব্যবহার করা যাবে না;
• জাগের সময় মাটি, মাটির ঢেলা, ঝিগার গাছ, কলা গাছ ইত্যাদি ব্যবহার করা হলে আঁশের রং কালো হবে;
• জাগের সময় সিমেন্টের স্লাব ব্যবহার করা যেতে পারে;
• জাগ দেওয়ার আগে পাট গাছের গোড়া থেতলিয়ে দিতে হবে।
আঁশ সংগ্রহ
• পাটের আঁশ গাছের বাকল থেকে উৎপন্ন হয়। বাকল থেকে আঁশ সংগ্রহ করার জন্য কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়, যেমন- পচন, আঁশ ছাড়ান, ধৌতকরণ।
• উন্নত গুণাগুণ সম্পন্ন জাতের বীজ বপন করে উপযুক্ত পরিচর্যায় ফসলকে আবাদ করা হলেও আঁশ সংগ্রহ প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপের প্রতি নজর দেয়া না হলে আঁশের মান নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর হয়ে থাকে।
• অন্যদিকে, নিকৃষ্ট মানের জাত বপন করেও সংগ্রহ প্রক্রিয়াগুলো ভালোভাবে প্রয়োগ করা হলে আঁশের মান বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। সে প্রেক্ষিতে পাট বীজ বপন থেকে শুরু করে পাট বাজারজাতকরণ পর্যন্ত যে কাজগুলো করতে হয় তার মধ্যে আঁশ সংগ্রহকরণ প্রক্রিয়াকে সবচেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
আঁশ ছাড়ানো প্রক্রিয়া
পচন শেষ হলে পাট গাছ থেকে দুই প্রকারে আঁশ ছাড়ানো যেতে পারে
১. শুকনা জায়গায় বসে একটা একটা করে আঁশ ছাড়ানো যেতে পারে অথবা,
২. পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে বাঁশের আড়ার সাহায্যে এক সঙ্গে অনেকগুলো গাছের আঁশ ছাড়ানো যেতে পারে।
যে পদ্ধতিতেই আঁশ ছাড়ানো হোক না কেন আঁশ ছাড়াবার সময় গাছের গোড়ার অংশের পচা ছাল হাত দিয়ে টিপে টেনে মুছে ফেলে দিলে আঁশের কাটিংস এর পরিমাণ অর্থাৎ গোড়ার শক্ত অংশের পরিমাণ অনেক কম হয়। এ ছাড়া আঁশ ছাড়ার সময় পাট গাছের গোড়ার অংশ এক টুকরো শক্ত কাঠ বা বাঁশ দিয়ে থেতলে নিলে আঁশের কাটিংসের পরিমাণ অনেক কম হয়। দেখা গেছে গাছ থেকে একটা একটা করে আশ ছাড়ালে আঁশের গুণাগুণ ভাল হয়।
আঁশ ধোয়া
আঁশ ছাড়ানোর পর আঁশগুলোকে পরিষ্কার পানিতে ধুতে হবে। ধোয়ার সময় আঁশের গোড়া সমান করে নিতে হবে এমনভাবে আঁশ ধুতে হবে যেন কোন রকম পচান ছাল, ভাঙ্গা পাট-খড়ি, অন্য কোন ময়লা, কাদা ইত্যাদি আঁশের গায়ে লেগে না থাকে। কারণ এতে পাটের মান নষ্ট হয় এবং বাজারে এ সকল আঁশের চাহিদাও কমে যায়।
আঁশের শ্যামলা রং দূরীকরণ
অপরিষ্কার বা অনুপযুক্ত পানিতে আঁশ ধোয়ার পর যদি দেখা যায় আঁশের রং কালো বা শ্যামলা হয়ে গেছে তাহলে এক মণ পানিতে প্রায় ১ কেজি তেঁতুল গুলে সেই তেঁতুল-গোলা পানির মধ্যে আঁশগুলো ৪ মিনিট ডুবিয়ে রাখলেই আঁশের রং উজ্জ্বল হয়ে যাবে। তবে মনে রাখতে হবে, তেঁতুল এক প্রকার এসিড, তাই আঁশগুলোকে সাথে সাথে খুব ভাল করে পরিস্কার জলে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে যাতে তেঁতুলের রস আঁশের সঙ্গে লেগে না থাকে।
আঁশ শুকানো
আঁশ ধোয়ার পর খুব ভাল করে আঁশ শুকাতে হবে। আঁশ কখনও মাটির উপর ছড়িয়ে শুকানো ঠিক নয়, কারণ তাতে আঁশে ময়লা, ধুলো-বালি ইত্যাদি লেগে যায়। বাঁশের আড়ায়, ঘরের চালে, ব্রিজের রেলিং বা অন্য কোন উপায়ে ঝুলিয়ে ভালোভাবে আঁশ শুকাতে হবে। ভেজা অবস্থায় আঁশ কখনই গুদামজাত করা ঠিক নয়। কারণ এতে আঁশের মান নষ্ট হয়ে যায়।