ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থায় সবুজ বিপ্লবের ভূমিকা আজ নতুন করে বলার মতন কিছু নেই। গত শতাব্দীতে সূচনা হওয়া এই সবুজ বিপ্লব দেশের কৃষির সম্ভাবনাকে একলাফে অনেকটাই বাড়িয়ে তুলেছিল। অতিরিক্ত বিনিয়োগ ও শ্রম দিয়ে নিবিড় চাষাবাদ এবং কৃষিতে প্রযুক্তির উন্নতিকরণের ফলে গোটা দেশ বেশ কিছু সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বেঁচে যায়। ভারতবর্ষ ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হতে শুরু করে। বাইরের থেকেও আর খাদ্য আমদানি করার তেমন প্রয়োজন পড়ে না, কারণ ততদিনে দেশ নিজের খাদ্যসুরক্ষা নিজেই বুঝে নিতে শিখেছে। সবুজ বিপ্লব আমাদের দেশে খাদ্যশস্যের অভাব দূর করলে ও, এর বেশ কিছু নেতিবাচক প্রভাব আমরা এখন টের পাচ্ছি। ভূগর্ভস্থ জল কমে যাওয়া থেকে শুরু করে, জলাশয় দূষণ, জীববৈচিত্রের অবনতির মতন অস্বস্তিকর দিকগুলি নিয়ে আমাদের এখন ভুগতে হচ্ছে। অতিরিক্ত পরিমাণে সার প্রয়োগ না করলে আজকাল ফসলও ভালো ফলছে না। ঘন ঘন জলবায়ু পরিবর্তন স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে নিবিড় চাষাবাদের কু-দিকগুলির।
খরা, বন্যা, পঙ্গপালের আক্রমণের মতন বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলি বুঝিয়ে দিচ্ছে বিপদ আসন্ন। আর ঠিক এখানেই সুস্থায়ী কৃষিপ্রথার গুরুত্ব প্রসঙ্গক্রমে চলে আসে বারবার। এই ক্ষেত্রে, অন্ধ্রপ্রদেশের উদাহরণ টানা যেতে পারে। ২০১৮ সালের পেঠাই আর তিতলি ঝড়ের সময় লক্ষ্য করে দেখা গেছে, প্রাকৃতিক উপায়ে চাষ করা ফসল, অতিমাত্রায় বয়ে যাওয়া হাওয়াতেও প্রচলিত চাষবাদের ফসলের তুলনায় বেশিমাত্রায় সহ্য ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। এই তথ্য প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা অন্ধ্র সুস্থায়ী কৃষিকার্যে আরও বেশি করে মনোনিবেশ করে। গোটা দেশে যা বর্তমানে বিরল।
সত্যি কথা বলতে গেলে, কৃষকরা আবার প্রাকৃতিক নিয়মে চাষাবাদ নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। অর্গানিক ফার্মিং, এগ্রো-ইকোলজি, প্রাকৃতিক উপায়ে চাষবাস নিয়ে কৃষিকাজ করতে আসা তরুণ প্রজন্মও অনেক বেশি ওয়াকিবহাল। সুস্থায়ী কৃষিব্যবস্থার সাথে বর্তমানে ভারতে হয়ে আসা চাষাবাদের কোনও মিল নেই। মূলত অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, হিমাচলপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রে সুস্থায়ী কৃষিকার্যের প্রচলন রয়েছে। বর্তমানের কৃষি গবেষকরাও সুস্থায়ী কৃষিব্যবস্থার সুফল নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন।
সুস্থায়ী কৃষিব্যবস্থার গুরুত্ব (Importance of Sustainable farming)
সুস্থায়ী কৃষিব্যবস্থা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দুইয়েরই জন্য খুবই উপকারী হলেও, এই দীর্ঘমেয়াদি চাষাবাদের কার্যকলাপ চাষিদের কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলেছে। তবে মনে করা হচ্ছে, সুস্থায়ী কৃষিপ্রখাতেও নির্দিষ্ট কিছু শস্যের ফলন দ্রুত হবে। গবেষণায় দেখা গেছে সুস্থায়ী কৃষিব্যবস্থায় অঙ্গ হিসাবে বৃষ্টির জলে চাষাবাদ, মালচিং পদ্ধতি ও এগ্রোফরেস্টি জল সংরক্ষণে ভীষণই কার্যকর।
সুস্থায়ী কৃষিব্যবস্থার সবথেকে বড় বিষয় হল, এই প্রথায় কীটনাশক, রাসায়নিক ইত্যাদি না ব্যবহার করে চাষাবাদ। পরীক্ষা করে দেখা গেছে সুস্থায়ী কৃষিব্যবস্থায় উৎপন্ন ফসল প্রচলিত চাষাবাদের দিক থেকে অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত।
মহিলাদের প্রভাব (Women empowerment)
ভারতীয় কৃষিব্যাবস্থার সাথে দেশের ৭০% মহিলা প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত। তবে সুস্থায়ী চাষাবাদ দেশে এখনও ব্যাপক ভাবে চালু হয়নি বলে, এই ব্যবস্থায় নারীদের ভূমিকা ততটাও আশানুরূপ গড়ে ওঠেনি। প্রচলিত কৃষিব্যবস্থায় দেশের মহিলাদের ভূমিকা যেমন অসীম, ঠিক সুস্থায়ী ব্যবস্থাতেও তেমন নারীদের গুরুত্ব ধীরে ধীরে বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এই কৃষিপন্থায় মহিলাদের কাজের পদ্ধতি, আয়, ক্ষমতা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আরও গবেষণা হয় উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন: Indoor trees for good sleep শয়নকক্ষে এই গাছগুলি লাগালে কাটবে অনিদ্রা রোগ
সরকারি পদক্ষেপ (Government Initiative)
২০১৪-১৫ সাল নাগাদ থেকেই সুস্থায়ী কৃষিব্যবস্থাকে আরও বেশি ভাবে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য, National Mission for Sustainable Agriculture (NMSA) নামে এক কার্যক্রম চালু হয়। এগ্রোফরেস্ট্রি, জল এবং মৃত্তিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, জলবায়ুর প্রভাব, বৃষ্টিপাতের অঞ্চল প্রভৃতি বিষয় এই কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়। NMSA-এ কার্যক্রম ছাড়াও, প্রধানমন্ত্রী কৃষি সেচ যোজনা মাইক্রো ইরিগ্রেশন, বৃষ্টির জলের দ্বারা চাষাবাদের মতন সঠিক কৃষিপদ্ধতিগুলিকে উৎসাহ দিয়ে আসছে। কৃষিমন্ত্রকও ভীষণ রকম ভাবে সুস্থায়ী কৃষিব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত চাষিদের উৎসাহ দিয়ে চলেছে।
অন্ধ্রপ্রদেশ, সিকিমের মতন রাজ্যগুলিকে সুস্থায়ী কৃষিব্যবস্থার অগ্রগন্য বলে ধরা হয়। আশা করা হচ্ছে, সুস্থায়ী কৃষিপ্রথার ক্রমাগত বৃদ্ধিলাভ দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত দিকেও ইতিবাচক ছাপ ফেলবে। আশা করা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে সুস্থায়ী কৃষিব্যবস্থাই দেশের খাদ্যসুরক্ষাকে অনেকাংশে নিশ্চিত করবে।
আরও পড়ুন: Grape Terrace Farming - সহজ পদ্ধতিতে নিজের বাড়িতেই করুন দ্রাক্ষার চাষ