সুজলা সুফলা শস্যক্ষেত্র গড়ে তোলার জন্য জমিতে উপযুক্ত সার প্রয়োগ এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমানে চাষের ক্ষেতে রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহার ডেকে আনছে ভয়াবহ দুর্যোগ। রাসায়নিক সারের এই অনিয়িন্ত্রিত ব্যবহারে পরিবেশের যেমন ক্ষতি হচ্ছে সঙ্গে বাড়ছে রোগের প্রকোপ। মাঠের ক্ষতিকারক পোকাকে নিকেশ করা বন্ধু পোকাগুলি যাচ্ছে মরে। কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, ফসলের এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে জৈব সারই (Organic Fertilizer) আমাদের একমাত্ৰ আশ্রয়।
জৈব সার 'টেরা প্রেটা’ (Terra Pretan)
পিছিয়ে যাওয়া যাক, ৮০০০-৯০০০ বছর আগে। উদ্ভাবন হয়নি কোনও রাসায়নিক সার অথবা বিজ্ঞানীদের বানানো কোনও আধুনিক কৃষি যন্ত্র। ব্রাজিলের আমাজন অববাহিকায়, চাষ-বাসের জন্য ব্যবহৃত হত একপ্রকারের জৈব সার। টেরা প্রেটা। স্থানীয় ভাষায় যার নাম ছিল 'টেরা প্রেটা দে ইন্দিও' এই পতুর্গীজ শব্দের অর্থ হল 'কালো পৃথিবী'। এই সারের বিশেষত্ব, ফসল ফলাতে অক্ষম মাটিরও জীবনীশক্তি ফিরিয়ে দেওয়া। আমাজন উপত্যকার প্রাচীন আদিবাসী সভ্যতা, এই সার তৈরি করে যুগের পর যুগ চাষাবাদ চালিয়ে গিয়েছে। প্রাচীনতম এই সার নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের গবেষণায় উঠে এসেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। গোবর, জীবজন্তুর হাড়, মুরগির ছাঁট, মানুষের মল, কাঠকয়লা, ছাই, মাছের কাঁটা এই সার বানাতে সেইসময় ব্যবহার করা হতো। বিজ্ঞানীরা জৈব পদার্থের সংমিশ্রণ দিয়ে বানানো এই সারের নাম দেন বায়োচার (BIOCHAR).
বায়োচারের গুরুত্ব - (Importance Of Biochar)
কৃষি বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বায়োচার মাটিতে প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। খরা প্রবণ এলাকায় বায়োচারের কার্যকারিতা ভীষণই উপযোগী। জমিকে উর্বর করার সাথে সাথে, বায়োচার জমির ভারী ও বিষাক্ত ধাতুকে অনেকাংশে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। যার জন্য ফসল ফলাতে চাষিদেরও অনেক কম বাধার সম্মুখীন হতে হয়। ফসল ফলানোর অসাধারণ ক্ষমতার পাশাপাশি এই জৈব সারের আরও বেশ কয়েকটি চমকপ্রদ গুণাবলী রয়েছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক টেরা প্রেডা সার ব্যবহারের সুবিধাগুলির কথা।
টেরা প্রেডা সারের ব্যবহার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ( Important Information Regarding Terra Pretan Fertilizer and it's use)
১) বাতাসের নাইট্রোজেন এই সার মাটিতে ধরে রাখতে সক্ষম
২) এই সারের উর্বরতা বহুদিন পর্যন্ত অবিকৃত থাকে। যুগের পর যুগ এই সারের গুণ ধরে রাখার ক্ষমতা বৈজ্ঞানিকদের গ্রিন হাউস গ্যাস এবং কার্বন ডাই অক্সাইড নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে নতুন উৎসাহ দিয়েছে।
৩) বৈজ্ঞানিকদের মতে, কাঠকয়লা যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে আবদ্ধ অবস্থায় একইরকম থাকতে পারে, তাহলে এই পদ্ধতি ঠিকঠাক অনুসরণ করলে পৃথিবীতে আরও বেশি কার্বণ জমিয়ে রাখা সম্ভব।
৪) বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী, বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমিয়ে দিতে এই সারের গুরুত্ব অপরিসীম।
৫) বায়ুমণ্ডলের কার্বণ-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ আটকে এই সার পৃথিবীকে উষ্ণ হওয়ার হাত থেকেও রক্ষা করে।
বর্তমানে কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের বাড়বাড়ন্তের যুগে, টেরা প্রেডার সঠিক ব্যবহার দিতে পারে ফসল ও মাটিকে দীর্ঘায়ু। পরিবেশ বান্ধব এই জৈব সার নিয়ে গোটা পৃথিবীর কৃষিবিজ্ঞানীদের গবেষণা এখন তুঙ্গে। টেরা প্রেডার গুণ নিয়ে সন্দেহের আজ কোনও প্রশ্নই নেই। মাটিকে তিন চার গুণ উর্বর করে তোলা পৃথিবীর আদিমতম এই সার যে আগামী দিনে কৃষি জগতকে আলোড়িত করে তুলতে চলেছে, এই নিয়ে সহমত প্রত্যেকেই।