একাঙ্গী/সুগন্ধী আদা/বালি আদা (Krempferia galanga L) হল একটি ঔষধি জাতীয় ভূ-নিম্নস্থ কন্দ জাতীয় ভেষজ উদ্ভিদ। এই ঔষধি গাছটিকে গ্রামবাংলায় ভুঁই-চম্পা, চন্দ্রমূলী নামেও ডাকা হয়ে থাকে। একাঙ্গীর বিভিন্ন ধরনের ঔষধি গুণ যেমন বেদনানাশক, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট(Antioxidant), অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল(Antimicrobial), কৃমিনাশক, লার্ভানাশক প্রভৃতি আছে । এই ভেষজ উদ্ভিদ বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে কৃষকদের এনে দিচ্ছে আর্থিক লাভ |
এই ফসলটি মূলত ব্যাপকভাবে ইন্দোনেশিয়া, চিন, কম্বোডিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে হয়ে থাকে। ইদানীং ভারতবর্ষেও এর চাষ সাড়া ফেলছে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে নদিয়া, মুর্শিদাবাদ ও দক্ষিণ দিনাজপুর, হুগলি, বীরভূম জেলাতে একাঙ্গী চাষ হচ্ছে |
একাঙ্গী রফতানি করার সম্ভাবনা বিশ্ব বাজারে অনেক বেশি। একাঙ্গী এবং এর তেল চিন, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে রফতানি করা হচ্ছে। এক কেজি একাঙ্গীর বিশ্ব বাজারে মূল্য চল্লিশ হাজার টাকা। তাই এই ঔষধি চাষে কৃষক ভাইবোনরা উৎসাহিত হচ্ছে |
একাঙ্গীর চাষ পদ্ধতি:
মাটি (Soil):
উর্বর বেলে, বেলে দোঁয়াশ ও দোঁয়াশ জাতীয় মাটিতে একাঙ্গী ভাল হয়। ভিজে, স্যাঁতস্যাঁতে একটু নিচু জমিতে এর চাষ ভাল হয়। তবে জমির জল নিকাশি ব্যবস্থা ভাল থাকা প্রয়োজন। প্রয়োজনাতিরিক্ত জল জমলে কন্দ পচে গিয়ে ফসল নষ্ট হতে পারে।
চাষের জমি তৈরি :
জমি তৈরি করতে প্রথমে একটা সেচ দিয়ে, মাটিতে জো আসার পর দু’ থেকে তিনবার আড়াআড়ি চাষ করে মাটি সমান করে জমি তৈরি করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে । মাটিবাহিত রোগ থেকে ফসলকে রক্ষা করার লক্ষ্যে শেষ চাষের আগে মূল জমিতে জৈব সার/কেঁচো সার বিঘাপ্রতি ৩০-৪০ কেজি ভাল করে মিশিয়ে ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় ছড়িয়ে দিতে হবে। সঙ্গে ব্যাকটেরিয়া নাশক হিসাবে সিউডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স দিলে একই হারে দেওয়া যেতে পারে।
বীজ বা কন্দ লাগানোর সময় (Planting Time):
চৈত্র মাস থেকে জৈষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত একাঙ্গী লাগানো যেতে পারে। গোটা কন্দ থেকে ১-২টি করে চোখ রেখে টুকরো করে কেটে (আলুর মতো প্রায়) অথবা গোটা কন্দও লাগানো যেতে পারে।
বীজের পরিমাণ :
একাঙ্গীচাষে বিঘাপ্রতি ১০০ কেজি কন্দবীজ দরকার।
জাত :
রজনী, কস্তুরী, চেকুর, মারাবা প্রভৃতি জাত চাষ করা হয়।
বীজ শোধন :
কাটা অথবা গোটা একাঙ্গী কন্দবীজ ট্রাইকোডারমা ভিরিড (প্রতি লিটার জলে ৫ গ্রাম) দ্রবণে দু-মিনিট ডুবিয়ে একটু নেড়েচেড়ে নিয়ে, তুলে নিয়ে ছায়ায় শুকাতে দিতে হবে। এছাড়াও কার্বেন্ডিজিম ১২% + ম্যানকোজেব ৬৩% WP বীজশোধক হিসাবে ২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন - আপনিও কি ধুন্দুল চাষে আগ্রহী? তবে এখনই জেনে নিন সহজ চাষাবাদ পদ্ধতি
বীজবপন:
আলুর মতো সারিতে বুনতে হয় একাঙ্গী। ২০ সেমি x ১৫ সেমি অন্তর ২ সেমি গভীরতায় গর্ত করে কন্দগুলিকে পুঁতে বসাতে হবে। জমি তৈরির সময় ও বীজবপণের ঠিক আগে দেখে নিতে হবে জমিতে আগাছা যাতে না থাকে কারণ প্রাথমিক অবস্থায় নিড়ানি করা যাবে না, গাছে আঘাত লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে । পরে দু’বার কন্দ বসানোর ৪৫ দিন ও ৯০ দিন পর নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে, তারপর সার প্রয়োগ করতে হবে ।
সার প্রয়োগ :
জমি তৈরির সময় শেষ চাষের আগে গোবর সার বিঘা প্রতি ৪-৬ গরুর গাড়ি দিতে হবে। রাসায়নিক সারও দু’বার প্রয়োগ করতে হবে। কন্দ বসানোর ৪৫ দিন পর প্রথমবার ২০ কেজি ডিএপি+১০ কেজি ইউরিয়া বিঘা প্রতি হারে এবং কন্দ বসানোর ৯০ দিন পর দ্বিতীয়বার ১০ কেজি ডিএপি+৫ কেজি ইউরিয়া বিঘা প্রতি হারে প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ :
জমির এবং আবহাওয়ার পরিস্থিতি বুঝে ১৫-২০ দিন অন্তর চারবার সেচ দিতে হবে।
ফসল সংগ্রহ:
কন্দ স্থাপনের সাত মাস পর একাঙ্গী বাজারজাত করার জন্য তোলা হয়ে থাকে। কাঁচা একাঙ্গীর ফলন বিঘা প্রতি ২০০০ কেজি এবং শুকনো হলে ওজন কমে দাঁড়ায় ৬৬০ কেজি। দেখা গিয়েছে ১ বিঘা একাঙ্গী চাষে মোটামুটি ৩৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়ে থাকে এবং ২৫০ টাকা প্রতি কেজি দরে বাজারজাত করে একলাখ পঁয়ষট্টি হাজার টাকা আয় হয়। তাতে লাভ হয় এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকা প্রায়।
নিবন্ধ: রায়না ঘোষ
আরও পড়ুন - সয়াবিন চাষ করে লাভ ঘরে তুলতে পারেন কৃষকরা