চাষিরা বেশী লাভের প্রত্যাশায় ‘ইনটেনসিভ’ সবজি চাষে ঝুঁকেছেন। তবে অসময়ের সবজি চাষে রোগ পোকার আক্রমণ খুব বেশী হবার প্রবণতা থাকে। তার সঙ্গে হাইব্রিড গুলিতে সারের চাহিদা তুলনামূলক কিছুটা বেশী। চাষিরা বেশী দামের আশায় এতসব না বুঝে যথেচ্ছ কীটনাশক ব্যবহার করেন, আর সঙ্গে বেশী বেশী সার ।
সবজির পাইকারী দাম বাজারে চড়তে শুরু করলেই আমাদের রাজ্যের চাষিদের তখনকার সেই সবজির জমিতে খরচের প্রবনতাও বাড়তে থাকে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে সার ও কীট/ রোগনাশকের ব্যবহার। ফলে চাষের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে জমিতে রাসায়নিক সারের দূষণ জলে, খাদ্যেও আর পরিবেশে সেসব রাসায়নিকের কুপ্রভাব বাড়িয়ে চলে। কীট / রোগনাশকের কথা তো আরো ভয়াবহ – প্রতিটি চমৎকার চকচকে সবজির পিছনে “পেস্টিসাইড রেসিডিউ” অনেকটা। ফলে প্রতিদিন পরোক্ষে আমরাও খেয়ে চলেছি বিষ। আর পরিবেশের নানা অংশে সেসব বিষের প্রভাবের কথা বলতে গেলে আলোচনার শেষ থাকবে না।
কিছু আধুনিক প্রযুক্তির দেশীয় পদ্ধতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে পরিবেশের উপাদান গুলি ব্যবহারের মাধ্যমে। যাতে কীট / রোগ নাশক প্রয়োজন অনুসারে লাগে আই. পি. এম মেনে আবার, রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমে প্রায় ৩০% মত। এর সাথে মাটির কথা মাথায় রেখে জৈব সার ও উপাদানের ব্যবহার আমাদের পরিবেশ সুরক্ষিত রাখে।
কি কি ভাবে ‘ক্লাইমেট স্মার্ট’ সবজি চাষ?
প্লাগ ট্রে ও নেটে ভাইরাস ফ্রী নার্সারী -
প্রথমে নার্সারী দিয়ে শুরু করা যাক, কারণ বেশীরভাগ লাভজনক অসময়ের সবজিরই চারা তৈরি করে রোয়া করে চাষ করা হয়। যেমন সমস্ত কপি, টমাটো, বেগুন, লঙ্কা ইত্যাদি। আর এসব ক্ষেত্রে বিশেষ করে কপিতে বর্ষা ও পূজোর মুখে চাষে একপেশে ধ্বসা ও হলুদ হয়ে যাওয়া আর টমাটো, লঙ্কাতে শোষক পোকা জনিত ভাইরাস সমস্যায় পরবর্তীতে চাষিরা যথেচ্ছ স্প্রে করেন। তবে সমস্যার সমাধান খুব একটা হয় না। আবার বর্ষাকালে বীজতলা বা চারা তলার জন্য চাষিরা জেরবার হন। সাথে অত্যধিক স্প্রে সমস্যা তো থাকেই।
ফলে বর্তমানের পলিথীনের ছোট ‘প্লাগ’ / ‘পোর’ ফুটো সমন্বিত নার্সারী ব্যবস্থা এক স্মার্ট পদ্ধতি চারা তৈরীর ব্যবস্থাপনায়। এই ট্রেতে মাটির বদলে নারকেলের ছোবরা থেকে তৈরি মিডিয়াম ‘কোকোপিট’ ব্যবহার করে একটি করে বীজ ফেলে সুন্দর সুস্থ চারা করা যায়। বাইরে বর্ষা হলেও ট্রেগুলি আচ্ছাদনের মধ্যে বা বাঁশ দিয়ে তৈরি ঘরোয়া পরিকাঠামোয় পলিশীট ঢেকে রাখা সম্ভব। আর এর সঙ্গে শোষক পোকা রোধক ইনসেক্ট ফ্রী ৪০-৫০ মেশ নেটের মধ্যে প্রাথমিক নার্সারী পর্য্যায় টুকু ফসলের অতিবাহিত হলে পরবর্তীতে বাহক দ্বারা ভাইরাস আক্রমণ অনেকটা এড়ানো যায়। ফলে রাসায়নিক বাঁচিয়ে সুস্থ সবল চারা বেশী লাভের বাজার ধরতে চাষিকে এগিয়ে রাখে। এই রকম ট্রে তে নার্সারী বা বীজতলা আর উপরে পলিশীট আর পাশে নেট দিয়ে পরিকাঠামো চাষিরা সহজেই বানিয়ে দুর্দান্তভাবে সবজির বীজতলাকে স্মার্ট রূপ দিতে পারেন।
শেড নেট ও পলি হাউসে সবজি –
গরমের সময় টমাটো, ধনেপাতা বা পালং খোলা মাঠে চাষে অসুবিধা অনেক। তবে বর্তমানের নানা উন্নত জাত ও হাইব্রিডে গরমে চাষ সম্ভব হলেও গুনমানকে ধরে রাখতে ও রোগপোকা ঠেকাতে স্প্রে করতে হয় বেশী। তার বদলে বর্তমানে উপলব্ধ ৫০% সবুজ শেডনেটের আচ্ছাদন উপরে ফুট আটেকে বাঁশ দিয়ে ঢাকার ব্যবস্থা করে এই সব সবজি চাষ খুব ভালো ভাবে করা সম্ভব। সরকারী অনুদান ব্যবস্থাও এতে চালু আছে ফলে জি. আই. পাইপ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী শেড-নেট হাউসে সবজি চাষ এখন চাষিদের কাছে এক ক্লাইমেট স্মার্ট প্রযুক্তি হয়ে উঠেছে।
একই কথা খাটে পলিগ্রীন হাউসের ক্ষেত্রে। এতে পুঁজি ও অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকলে পুরো হাইটেক বা কম খরচে পাশে খোলা ‘ওপেন ভেন্টিলেটেড’ পরিকাঠামোতে অসময়ের প্রায় সবরকম সবজি চাষ আর উচ্চ আয়ের সবজি যেমন ক্যাপসিকাম করা সম্ভব। আর এতে ড্রিপ ব্যবস্থায় জলসেচ থাকলে রাসায়নিক সারের অপব্যবহার ও অপচয় অনেকটা কমাবার সঙ্গে কীট / রোগনাশক স্প্রেও যথাযথ দেওয়া সম্ভব। আর চাষিদের লাভের দিকটা তো ছেড়েই দিলাম। এই রাজ্যের প্রায় প্রতি জেলাতেই সফল চাষিদের কাহিনী না হয় পরে আলোচনায় থাকবে।
আরও পড়ুন - আধুনিক কৃষিতে জৈব আচ্ছাদনের ব্যবহার (Organic Mulching In Modern Agriculture)
পলি মাল্চিং ও দেশীয় ব্যবস্থায় মাল্চে সবজি –
পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চল বাদে বাকী সব জায়গায় সবজি চাষে আগাছা একটি বড় সমস্যা। আর আজকের বাজারে সবজি থেকে লাভ পেতে চাষিরা ঘাড়ের উপর ঘাড়ে ফসল ফলাতে অভ্যস্ত। সেচ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এখন জমি খালি পড়ে থাকে কই? তবে আগাছানাশে বেশী শ্রম খরচ কমাতে আর লাভের কড়ি গুনতে চাষিরা জমিতে ‘টোটাল উইড কিলার’ দিয়ে দেন বছরে প্রতি মরশুমের শুরুতেই। ফলে জমির অবস্থা যে কি হচ্ছে আর পরিবেশে মিশছে বিষ। আগাছার সমস্যা রোধে ‘মাল্চিং’ এক কার্যকরী ‘ক্লাইমেট স্মার্ট’ পদ্ধতি। সবজি চাষে চারা বা বীজ বসানোর আগে উঁচু বেডে জমি ভাগ করে বেডের উপর পলিশিটের মাল্চ পেতে দিলে আগাছার সমস্যার সাথে জলসেচ কম লাগে, তাপ নিয়ন্ত্রিত হয় সাথে রোগ পোকাও কম লাগে। বর্তমানে পলি মাল্চের উপর ফুটো করে সেই স্থানে চারা ও বীজ লাগিয়ে সুন্দর মাল্চের উপর সবজি চাষ সম্ভব হচ্ছে। খুব বর্ষাকাল বাদে শীতে ও গ্রীষ্ম - প্রাক গ্রীষ্মে মাল্চিং এক কার্যকরি পদ্ধতি। তবে বর্ষাতে উঁচু জমিতে একটু উঁচু করে মাল্চিং করে জল নিকাশী ভালোভাবে করলে চমৎকার স্মার্ট পদ্ধতিতে আগাছার সমস্যা মিটিয়ে সবজি পাবেন। বিশেষ করে এই মাল্চে কনজারভেশন হবার জন্য উৎপাদনও দেড়গুণ বেড়ে যায়। আর এর সাথে ড্রিপ ব্যবস্থা চালু থাকলে দুগুন ফলন অনায়াসে সম্ভব।
পলিমাল্চ সম্ভব না হলে প্রাক গ্রীষ্মের জমিতে বাওয়া সবজি বা শীতের সবজিতে খড় বা ফসলের অবশেষ ইত্যাদি দিয়ে মাল্চেও বেশ কিছুটা লাভ পাওয়া সম্ভব।
লেখক : ড: শুভদীপ নাথ (সহ উদ্যানপালন অধিকর্তা, উত্তর ২৪ পরগনা)
আরও পড়ুন - খরা প্রবণ অঞ্চলে আচ্ছাদন ব্যবহার করে কিভাবে করবেন ফসল এর অধিক উৎপাদন