আমাদের দেশের অতি জনপ্রিয় ও নিত্যাবশ্যকীয় সব্জি হলো বেগুন, যা প্রায় সারাবছর উৎপাদিত হয় |বাজারে এই সব্জির চাহিদা রয়েছে প্রায় সারাবছর | বেগুনের বাঁকা ডগাওয়ালা ছিদ্রকারী পোকা থেকে বাঁচাতে কীটনাশকটি বাছতে হাবুডুবু খেতে হয় কৃষকদের। ওই কীটনাশক বেগুনের মধ্যে দিয়ে পরোক্ষভাবে মানব শরীরে ঢুকে মারাত্মক ক্ষতি করে।
বেগুনের সবচেয়ে ক্ষতিকারক রোগগুলির মধ্যে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা অন্যতম। ক্ষতিকর পোকা ব্যবস্থাপনার জন্য অতীতে শুধু রাসায়নিক ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। গত কয়েক বছরে বেগুন চাষের কীটপোকা কৃষি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে | কীটনাশক কোম্পানিগুলি একের পর এক বেগুন পোকা ধ্বংসের জন্য কীটনাশক বাজারে আনছে | ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, উৎপাদন খরচ বাড়ছে, মাটির উর্বরতা ও ফলন কমছে। অথচ, প্রত্যেকটি কীটনাশক কিছুদিন কাজ করার পর তা পোকাদের সহনশীল হয়ে উঠছে | আবার এই বিষ পরোক্ষভাবে মানবদেহে ক্যান্সার পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে |
জৈবিক দমনের মাধ্যমে শুধু নির্বাচিত ক্ষতিকর পোকা ব্যবস্থাপনা সম্ভব হয় এবং কোনো পোকার মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতাও উৎপন্ন করে না। সম্প্রতি বেগুনের ওই পোকা রোধে আবিষ্কার হয়েছে সোলার সিস্টেমে ফেরোমন ট্রাপ বা ফেরোমেন ফাঁদ (pheromone trap) | আজকের এই নিবন্ধে, এই পদ্ধতির ব্যাপারে আলোচনা করা হবে, যা কৃষকভাইদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় |
ফেরোমন ট্র্যাপ বা ফেরোমেন ফাঁদ পদ্ধতি (How to set-up pheromone trap):
রাতে দশ কাঠা জমির জন্য একটি অথবা এক বিঘা জমিতে দু’টি ফেরোমন ফাঁদ জমির দুই প্রান্তে টাঙিয়ে দেওয়া যায়। এই ফাঁদে পড়ে ওই পোকার বংশবৃদ্ধি রদ করা সম্ভব। সেই সঙ্গে রোজ কীটনাশক স্প্রে না করে সাত বা দশদিন অন্তর কীটনাশক স্প্রে করলেই চলবে। বা কোনও কীটনাশক ব্যবহার ছাড়াই বেগুন ফলানো সম্ভব। এভাবে বেগুন চাষের খরচ যেমন কমবে তেমন রক্ষা পাবে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যাবহার। রক্ষা পাবে মানুষের শরীর। তবে ফোরোমন ফাঁদের ক্ষেত্রে ফানেল ট্র্যাপে পোকা পড়লেও তার পরিমাণ খুব বেশি হয় না। সে জায়গায় অত্যাধুনিক ফানেল ট্র্যাপ হিসেবে বাজারে সহজ প্রযুক্তির সোলার লাইট যুক্ত ট্র্যাপ এসেছে। এতে একটি পলিথিন পাত্রের উপর সোলার সেল যুক্ত আলোর ব্যাবস্থা ও সঙ্গে দু’টি ফেরোমন কিওর থাকছে। ফসলে ক্ষতিকারক কীটগুলি সূর্য ডোবার পরেই আপনা আপনি জ্বলে ওঠে। ওই আলোয় আকৃষ্ট হয়ে পোকার দল এসে সোলার লাইটের নিচে রাখা কেরোসিন বা অল্প কীটনাশক রাখা পাত্রে এসে পড়ে ও মারা যায়। এতে তেমন প্রচুর পরিমাণ বিষের দরকার হয় না।
ফাঁদ পরিবর্তনের সময়:
সাবধানতা ও যত্নের সাথে ব্যবহার করলে এ ধরনের একটি ফাঁদ ২-৩ মৌসুম পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। অতিরিক্ত বৃষ্টি, রোদ বা বাতাসে ফাঁদ নষ্ট হতে পারে। সেক্ষেত্রে দেরি না করে জমিতে নতুন ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার জন্য ব্যবহৃত অধিকাংশ ফেরোমন টিউব/টোপ/ এ সাধারণত ৩ মিলিগ্রাম পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থ থাকে। এসব ফাঁদ দেড় থেকে ২-৩ মাস কার্যক্ষম থাকে, সেজন্য ২ থেকে ৩ মাস পর ফাঁদ পরিবর্তন করা দরকার। একটি বেগুন মৌসুমে প্রায় ২টি ফাঁদের প্রয়োজন হয়।
আরও পড়ুন - ICAR কৃষকদের জন্য প্রচলন করল প্রোডাকশন টেকনোলোজি মোবাইল অ্যাপ
ফাঁদের রক্ষনাবেক্ষন (pheromone trap maintenance):
-
জমিতে ফাঁদ স্থাপনের পর, নিম্নলিখিত জিনিসগুলির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে,
-
প্রতিদিন ফাঁদ পর্যবেক্ষণ করতে হবে
-
২-৩ দিন পর পর সাবানের জল পাল্টে দিতে হবে
-
ফাটা বা ছিদ্রযুক্ত ফাঁদ পাল্টিয়ে নুতন ফাঁদ প্রতিস্থাপন করতে হবে
-
গাছের বৃদ্ধির সাথে তাল রেখে ফাঁদটিকেও ক্রমান্বয়ে ওপরের দিকে তুলতে হবে
-
এই পদ্ধতি ব্যবহার করে কৃষকরা খুবই উপকৃত হয়েছেন | শুধু বেগুন না অন্যান্য চাষে পোকা মারতে ও বংশবৃদ্ধি রোধে সফল হয়েছেন | ফলত, চাষে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রয়োগ কমছে | মাটির জৈবিক গুণাবলী ও উর্বরতা বজায় থাকে |
নিবন্ধ: রায়না ঘোষ
আরও পড়ুন - শ্রী পদ্ধতিতে ধান চাষ, রুখবে জলের অপচয়