পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বারাকপুর -১ ব্লকের অন্তর্গত বাসুদেবপুর নেতাজি গ্রামের গৃহবধূ রেহেনা বিবি আজ এলাকার অন্যান্য মহিলাদের কাছে তাঁর নেতৃত্ব এবং সফল উদ্যোগীর জন্য বাস্তবিক অর্থেই রোল মডেল - কিন্তু এই জায়গায় পৌঁছানো মোটেও সহজ কাজ ছিল না। প্রান্তিক কৃষক পরিবারের সন্তান রেহেনার শৈশব অতিক্রান্ত হয়েছে নিদারুন দারিদ্রের মধ্যে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিবাহ হয় বেসরকারি কর্মী আব্দুল শরীফের সাথে - কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠূর পরিহাস - দুটো সন্তান হওয়ার পর স্বামী ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যান। শুরু হয় এক বিধবা মায়ের জীবন-সংগ্রাম। আজ আমরা বলবো রেহানার এই সংগ্রাম কাহিনী।
জীবিকার তাগিদে রেহেনা একদিন ভাটপাড়া পৌরসভার প্রতিনিধির কাছ থেকে শোনে মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কথা। এরকমি একটি মিটিং থেকে রেহেনা জানতে পারে মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন করলে সরকারি পরিষেবার মাধ্যমে জীবিকা বিকাশ কার্যক্রম নেওয়া সম্ভব। কয়েক দিনের মধ্যেই রেহেনার উদ্যোগে তৈরি হলো ১৮-জনের "বন্ধু ক্ষুদ্র সঞ্চয় গোষ্ঠী" (SHG)। স্বাভাবিকভাবেই রেহেনা এই গোষ্ঠীর অন্যতম পদাধিকারী নির্বাচিত হয়। কিন্তু শুরুতে একজন সংখ্যালঘু বিধবা মায়ের পক্ষে বহির্জগতে এসে গোষ্ঠীর কাজ করা বেশ সমস্যায় ছিল, কিন্তু বাঁচার তাগিদে কোনো সমস্যাই আর সমস্যা হয় দাঁড়ায় নি। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে থাকে রেহেনা।
কিন্তু গোষ্ঠী তো তৈরি হলো, গোষ্ঠীর গতিশীলতা আসবে কি করে ?? ভাবতে থাকে রেহেনা। আর এই সময় প্রতিবেশী এক কৃষক ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারে রিলায়েন্স ফাউন্ডেশনের টোল ফ্রি হেল্পলাইন নম্বর ১৮০০ ৪১৯ ৮৮০০ -র কথা। শুরুতে একটু ইতস্ততঃ করলেও একদিন হেল্পলাইনে যোগাযোগ করে রেহানা গোষ্ঠীর নিয়ম গুলি জেনে নেয়। আলোচনায় উদ্বুধ্ব হয়ে নিয়মিত হেল্পলাইনে যোগাযোগ করে এবং ফাউন্ডেশনের রিসোর্স পার্সন রাজকুমার লস্কর দশ সূত্র অনুসারে গোষ্ঠী পরিচালনার বিষয়গুলি বিস্তারিত ভাবে জানায়।
সেইমতো কিছুদিন চলার পর রাজকুমার বাবুর নির্দেশমতো সংখ্যালঘু দপ্তরে লোনের জন্য আবেদন করে এবং ৩.৬০ লক্ষ টাকা সংখ্যালঘু লোন পায় এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগ পরিকল্পনা করে রেহেনা ৩৬,০০০/- টাকা লোন নেন এবং একটি বাড়িতে টেইলারিং ইউনিট বসান । দলের বাকি সদস্যরা ১৫,০০০/- থেকে ২০,০০০/- টাকা লোন নেন এবং প্রত্যেকেই পশুপালন, ছোট দোকান, এবং বিভিন্ন কৃষি ও ও-কৃষি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এভাবে প্রত্যেকেই কোনো না কোনো আয় রোজগারী কাজের সাথে যুক্ত হয় - ভালোভাবেই চলছিল গোষ্ঠীর পরিচালনা এবং জীবিকা। কিন্তু করোনা ভাইরাস হঠাৎই পরিস্থিতি বদলে দেয়, সদস্যরা চিন্তায় পরে যায় লোন শোধ কিভাবে হবে !! কিন্তু সকলেই খুব আত্মবিশ্বাসী ছিল, কারণ তাদের পাশে আছে রিলায়েন্স ফাউন্ডেশন। রেহেনা আবার যোগাযোগ করে হেল্পলাইনে এবং জানতে পারে তিন মাস লোন মোরাটোরিয়াম এর বিষয়। রিলায়েন্স ফাউন্ডেশনের প্রস্তাব মতো তাঁরা ব্যাংক এর সাথে যোগাযোগ করে মোরাটোরিয়াম এর সুবিধা নেয়। আজ পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক, বন্ধু গোষ্ঠীর গতিশীলতার চাকা আবার সচল হয়েছে, রেহেনা আজ বড়বাজার এর সাথে যোগাযোগ করে থান কাপড় নিয়ে এসে বাড়িতে চুড়িদার, নাইটি, বেবি ফ্রক বানিয়ে স্থানীয় দোকানে বিক্রি করছে। পাশাপাশি এলাকার মহিলাদের মধ্যেও রেহেনার জনপ্রিয়তাও লক্ষণীয় - যা তাঁকে উদ্যোগী করতে অনেকটাই সাহায্য করেছে। আজ রেহেনা মাসিক প্রায় ৭০০০/- টাকা রোজগার করছে, পাশাপাশি বন্ধু গোষ্ঠীর কিছু সদস্যকেও আংশিক সময়ের কর্মী করে নিজের ব্যবসায় কাজে লাগিয়েছে। রেহেনার মেয়ে এ বছর মাধ্যমিক পাশ করেছে, ছেলেও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে - সন্তানদের কাছে আজ সে এক আদর্শ মা। গোষ্ঠীর বাকি সদস্যরাও কিছু না কিছু আয় রোজগাড়ি কাজ করে মাসে ৩০০০/- টাকা গড়ে রোজগার করছে। ব্যবসার পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতার-ও প্রকৃষ্ট উদাহরণ বন্ধু গোষ্ঠীর সদস্যরা। লকডাউন এর সময় রেহেনেরা প্রায় ৬০০০০/- টাকার ফেস মাস্ক তৈরি করেছে। ভাটপাড়া অঞ্চলে "বন্ধু ক্ষুদ্র সঞ্চয় গোষ্ঠী" আজ একটি আদর্শ দল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
রেহেনাদের কথায় " গ্রাম বাংলার মায়েরা আজও ঘর-গৃহস্থালির কাজেই আবদ্ধ থাকে - পরিবারকে আর্থিক ভাবে সাহায্য করা তাঁদের কাছে স্বপ্ন। কিন্তু রিলায়েন্স ফাউন্ডেশন এর সহায়তায় আমরা এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছি। রিলায়েন্স ফাউন্ডেশন আজ প্রকৃত অর্থেই আমাদের "বন্ধু"।
তথ্য সংগ্রাহক - প্রদীপ পান্ডা (কর্মকর্তা, রিলায়েন্স ফাউন্ডেশন)
Image source - Reliance foundation
Related link - (Reliance Foundation) রিলায়েন্স ফাউন্ডেশনের সহায়তায় সফল মহিলা কৃষক লতা হালদার