অত্যন্ত সুস্বাদু ফল হল বাতাবি লেবু। খেতে রসালো এই ফল ছেলে থেকে বুড়ো সকলেরই অত্যন্ত প্রিয়। চিনি-নুন সহযোগে বাতাবি লেবু খেতে আট থেকে আশি সকলেই ভালোবাসে। বাতাবিলেবুর বাজারে চাহিদা থাকায়, এই লেবুর চাষ চাষিরা বেশ উচ্চাশার সঙ্গেই করেই থাকেন। অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর এই ফল ভিটামিন-সি-এর অভাব দূর করে সাথে সাথে দাঁত, মাড়ি ও পেশীও মজবুত করে। দেহের রোগ ক্ষমতা বাড়ানোর সাথে সাথে এটি দেহের ক্ষত নিরাময়েও সাহায্য করে। বাণিজ্যিক ভাবে এই চাষ করে বহু কৃষক লাভবানও হচ্ছেন। আসুন জেনে নেওয়া যাক, বাতাবি লেবু চাষের কৌশল--
মাটি ও জলবায়ু (Soil and Climate)
হালকা দো-আঁশ থেকে পলি দো-আঁশযুক্ত, সুনিষ্কাশিত ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মাটি বাতাবি লেবু চাষের জন্য খুব ভালো বলে বিবেচিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু বাতাবি লেবু চাষের জন্য বেশি উপযোগী।
জমি নির্বাচন ও তৈরি (Land Preparation)
বাতাবি লেবুর চারা রোপণের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে। জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে সমতল ও আগাছামুক্ত করে চারা রোপণের জন্য গর্ত তৈরি করতে হবে।
বংশ বিস্তার (Breed)
গুটি কলম, জোড় কলম ও চোখ কলমের সাহায্যে বাতাবিলেবুর বংশবিস্তার হয়। সাধারণত ৮-১০ মাস বয়সের বাতাবি লেবুর চারা বডি ও গ্রাফটিংয়ের জন্য আদিজোড় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রোপণের জন্য সোজা ও দ্রুত বৃদ্ধি সম্পন্ন চারা বা কলম রোপণ করা হয়।
রোপণ পদ্ধতি (Plantation)
সমতল জমিতে বর্গাকার অথবা আয়তাকার পদ্ধতি অথবা পাহাড়ি জমিতে কন্টুর পদ্ধতিতে বাতাবি লেবুর চারা/কলম রোপণ করা হয়।
রোপণের সময় (Planting Time)
মধ্য জ্যৈষ্ঠ-আশ্বিন (জুন-সেপ্টেম্বর) মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়।
সার প্রয়োগ (Fertilizer)
প্রতি গর্তে জৈব সার ১০-১৫ কেজি, টিএসপি-২৫০ গ্রাম এবং এমপি ২৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হয়। সারগুলো ভালো করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। সার একেবারে গাছের গোড়ায় না দিয়ে ভালোভাবে গাছের ডালপালা বিস্তার লাভ করেছে সে এলাকার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। উল্লেখিত সার সমান তিন কিস্তিতে মধ্য মাঘ থেকে মধ্য ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারি), মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য জ্যৈষ্ঠ (মে) ও মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য কার্তিক (অক্টোবর) মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
আগাছা দমন (Weed Management)
গাছের গোড়ায় আগাছা জন্মালে তা তুলে ফেলতে হবে। কারণ এরা খাদ্য ও জল গ্রহণে অংশীদার হয় এবং গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি অব্যাহত করে। চারা রোপণের পর প্রথম দিকে গাছের গোড়ার মাটি ঝুরঝুরে রাখলে নতুন চারা দ্রুত বাড়তে পারে। তাই সেচ দেওয়ার পর জমিতে জো এলে হালকাভাবে কুপিয়ে জমির চটা ভেঙে দিতে হবে। এতে মাটির জল ধারণ ক্ষমতা বেড়ে যাবে এবং গাছ সহজে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারবে।
জল ও সেচ নিকাশ (Irrigation)
ফুল আসা ও ফল ধরার সময় জলের অভাব হলে ফল ঝরে পড়ে। চারা লাগানোর সময়, সার দেওয়ার পর এবং খরার সময় ১০-১৫ দিন পরপর সেচ দিতে হবে। বাতাবি লেবু জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। বর্ষার সময় গাছের গোড়ায় যাতে জল জমতে না পারে সেজন্য নালা করে জল নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থা (Disease Control)
গামোসিস
গামোসিস বাতাবি লেবু গাছের একটি মারাত্মক রোগ। গাছে আক্রমণ হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই এ রোগ গাছের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে গাছের অংশবিশেষ অথবা সম্পূর্ণ গাছটিও প্রায়শই এর ফলে মারা যায়।
রোগের লক্ষণ
এ রোগের আক্রমণে আক্রানত্ম অংশের বাকল থেকে প্রচুর আঠা নির্গত হয়। রোগাক্রান্ত কাণ্ড ও বাকল বাদামি রঙের হয়ে যায় ও আঠা ফোঁটা আকারে বের হতে থাকে। আক্রান্ত অংশে ১-৩ মিলিমিটার চওড়া ফাটল দেখা যায়।
দমন ব্যবস্থা
আক্রান্ত শাখা কেটে ফেলে অথবা আক্রান্ত অংশ চেঁছে ফেলে বর্দোপেস্ট বা ম্যাক্রপ্যাঙ পেস্টের মতো করে লাগাতে হবে। গাছকে সবসময় সবল ও সতেজ রাখতে হবে। স্যাঁতসেঁতে মাটি, অতিরিক্ত সেচ এবং জলাবদ্ধতা পরিহার করতে হবে। জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা ও সেচের জল গাছের কাণ্ড স্পর্শ করা থেকে বিরত রাখা ভালো।
ডাইব্যাক
এ রোগের প্রধান লক্ষণ হলো গাছে ধীরে ধীরে সজীবতা হারায়, ফলন কমে যায়, গাছের পাতা ও ডগা শুকিয়ে নিচের দিকে নামে এবং পরবর্তীতে গাছ মারা যায়।
দমন ব্যবস্থা
এ রোগ দমনের জন্য রোগ প্রতিরোধী জাত আদিজোড়া হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। মাটি সুনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। সুষম সার ব্যবহার ও জল সেচ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সুস্থ ও সবল গাছ রোপণ করতে হবে। আক্রান্ত শাখা বা ডাল কেটে ফেলা এবং কর্তিত অংশে বর্দোপেস্ট লাগানো ভালো। আক্রান্ত অংশে ডাইথেন এম-৪৫ (০.২%) এবং বর্দোমিশ্রণ (১%) স্প্রে করতে হবে।
পোকামাকড় দমন ব্যবস্থা (Pest Control)
পাতার ছোট সুড়ঙ্গ পোকা
এ পোকার ক্ষুদ্র কীটগুলি পাতার উপত্বকের ঠিক নিচে আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গ করে সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে। এতে পাতা কুঁকড়ে বিবর্ণ হয়ে শুকিয়ে ঝরে যায়।
আরও পড়ুন: Easiest way of Fish Preservation Process : সহজে শিখে নিন শুঁটকি প্রস্তুতকরণ পদ্ধতি
দমন ব্যবস্থা
গাছে নতুন পাতা গজানোর সময় রগর বা রঙিয়ন বা পারফেকথিয়ন ৪০ ইসি ২ মিলিলিটার হারে প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে। নতুন পাতা গজানোর সময় ম্যালাথিয়ন বা সুমিথিয়ন ১ মিলিলিটার হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর ২ বার স্প্রে করতে হয়।
লেবুর প্রজাপতি
এ পোকা পাতা খেয়ে ফেলে। এ জন্য ফলন ও গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
দমন ব্যবস্থা
ডিম ও কীট ক্ত পাতা সংগ্রহ করে মাটির নিচে পুঁতে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। সুমিথিয়ন ৫০ ইসি বা লিবাসিড ৫০ ইসি ২ মিলিলিটার প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর প্রয়োগ করে এ পোকা দমন করা যায়।
ফল সংগ্রহ (Harvest)
ফলের উপরিভাগ খসখসে থেকে পরিবর্তিত হয়ে কিছুটা তেলতেলে ভাব এবং ফল হলুদে বর্ণ ধারণ করলে ফল সংগ্রহ করা যায়। সঠিক যত্ন নিলে গাছপ্রতি গড়ে ৫০-৫৫টি ফল পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন: Rabbit rearing at home: জেনে নিন বাড়িতে খরগোশ পালনের পদ্ধতি