আখের রস সকলেরই খুব প্রিয় পানীয়। বাজারে ব্যাগ হাতে সবজি বা অন্যান্য সামগ্রী কিনতে গিয়ে আখের রস পেলে এমন কোনও বাঙালি পাওয়া যাবে না, যিনি এক গ্লাস আখের রস আস্বাদন না করে ফিরে আসবেন। ছোট থেকে বড় সবারই অত্যন্ত প্রিয় এই আখ। খরিফ মরসুমের অন্যতম অর্থকরী ফসল হল এই আখ। চিনি, গুড় পরবর্তী খাদ্য পণ্য এই আখের থেকেই তৈরী হয়। আখ চাষ করে বর্তমানে বহু চাষি লাভবান হচ্ছেন। কৃষিকার্যে নতুন যারা যোগ দিয়েছেন, সেইসব কৃষকরাও আখ চাষ করে লাভবান হতে পারেন। চিনি, গুড় এবং রসের গোটা বছর চাহিদা থাকায় আখ চাষ অর্থনৈতিক ভাবে অত্যন্ত লাভবান চাষ বলে বিবেচিত হয়। তাই নির্দ্বিধায় আখ চাষ করে অন্যান্য ফসলের থেকে দ্বিগুণ অর্থ আয়ও করতে পারেন। সংস্কৃত শব্দ 'ইক্ষু' থেকে আখ শব্দের উৎপত্তি। বর্ষজীবি একটি উদ্ভিদ হল এই আখ। প্রথাগত চাষ ছাড়াও আধুনিক প্রযুক্তি টিসু কালচারের মাধ্যমে আখের প্রচুর পরিমাণে চাষ হচ্ছে।
আখ রোপনের সময় (Planting)
মূলত অক্টবর-নভেম্বর মাসে এবং মার্চ-এপ্রিল মাসে আখ জমিতে রোপন করা হয়। হেমন্তকালে আখের ফলন সবথেকে ভালো হয়।
বীজ নির্বাচন:
আখগাছের গোড়ার দিকে যত দূর পর্যন্ত শিকড় বের হয় সেই অংশ বাদ দিয়ে উপরের অংশের পুরোটাই বীজ আখ হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে উপরের দিকে ১/৩ অংশই বীজ আখ হিসাবে সবচেয়ে উপযোগী। ৯ মাস বয়সী আখের ডগার দিকের ১/৩ অংশ এবং ৬-৮ মাস বয়সের আখের মাঝের অংশ বীজ আখ হিসাবে খুবই উপযোগী। বীজ আখ তাজা, সতেজ চোখ যুক্ত এবং রোগ -পোকা মুক্ত হয়। রোগাক্রান্ত জমি থেকে কখনই বীজ আখ সংগ্রহ করা যাবে না। আখে লাল দাগ দেখা গেলে বীজ আখ হিসাবে ব্যবহার করা ঠিক নয়। এছাড়া ফুল এসে যাওয়া আখ এবং মুড়ি আখ কখনই বীজ আখ হিসাবে ব্যবহার করা উচিত হবে না। বীজ আখ জমি থেকে কেটে নেওয়ার ২৪-৪৮ ঘন্টার মধ্যে হাপরে বা সরাসরি জমিতে বসাতে হবে।
বীজ শোধন (Seed Purification)
বীজ আখ বসানোর আগে তিনটি চোখ আছে এমন ৩০-৪৫ সেমি লম্বা আখের টুকরোগুলি ২৪ ঘন্টা ধরে পরিষ্কার জলে ভিজিয়ে রাখলে ভালো কল বেরায়। কার্বেনডাজিম ৫০ % ডবলু. পি ২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে বীজ আখ ২০ মিনিট ভিজিয়ে রেখে শোধন করা হয়।
জমি (Land)
এঁটেল দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি আখের জমি হিসাবেও আদর্শ। উঁচু কিংবা মাঝারি উঁচু জমি দেখে আখের জমি নির্বাচন করা উচিত। খেয়াল রাখতে হবে জমি যাতে একটু ঢালু প্রকৃতির হয়।
জমি তৈরী (Land Preparation)
আখ চাষ করতে হলে ৪-৫টি চাষ ও মই দিয়ে জমি আগের থেকে খুব ভালো করে তৈরী করে নিতে হবে। ৯-১০ ইঞ্চি গভীর নালা তৈরি করা আখ ক্ষেতের পক্ষে আবশ্যক। নালার ভেতর বেসালডোজ সার ছিটিয়ে দিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দেওয়া উচিত।
আখের চারা তৈরী:
এক একর জমির জন্য ৪-৫ ইঞ্চি আকারের ০.০২ মিলিমিটার পুরু ১২ হাজার ব্যাগ (ওজনে প্রায় ৮ কেজি) প্রয়োজন হয়। ৫০ ভাগ বেলে দো-আঁশ ও ৫০ ভাগ গোবর বা কম্পোস্ট সার মিশ্রিত করতে হবে। উঁইপোকা ও মাজরা পোকা দমনের জন্য ২৫০ গ্রাম লরসবান বা ডারসবান এবং ১ কেজি ফুরাডান ৫জি মাটির মিশ্রণের সাথে মেশাতে হবে। মিশ্রিত ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে ব্যাগের ৩-৪ ভাগ ভরতে হবে। চোখের ওপর ১ ইঞ্চি এবং চোখের নিচে ২ ইঞ্চি আখ রেখে তৈরি বীজখণ্ডগুলো একটি করে পলিব্যাগে চোখ উপর দিকে রেখে খাড়াভাবে স্থাপন করতে হবে। যাতে বীজখণ্ডটি ব্যাগের উপর থেকে আধা ইঞ্চি নিচে থাকে। ব্যাগের বাকি অংশ মাটি দিয়ে ভরে চাপ দিয়ে ব্যাগের মাটি এঁটে দিতে হবে। ব্যাগের মধ্যে যাতে অতিরিক্ত জল জমে চারা পচে না যায়, সে জন্য ব্যাগের তলায় ২-৩টি ছিদ্র করতে হবে। এ জন্য ব্যাগে মাটি ভরার আগেই কাগজ ছিদ্র করার পাঞ্চিং মেশিন ব্যবহার করা যেতে পারে।
রোপণ পদ্ধতি: (Planting process)
সনাতন পদ্ধতিতে আখ রোপণ:
এ পদ্ধতিতে আখের বীজখণ্ডগুলো সরাসরি মূল জমিতে রোপণ করা হয়। ভালোভাবে জমি তৈরির পর কোদাল বা লাঙল দিয়ে নালা করে নালার ভেতর বেসালডোজ সার ছিটিয়ে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দুই বা তিন চোখবিশিষ্ট বীজখণ্ড সরাসরি মাথায় মাথায় স্থাপন করে তার উপর প্রায় ২ ইঞ্চি মাটির আবরণে ঢেকে দিতে হবে। বীজ খণ্ডগুলোকে নালায় এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে চোখগুলো দুই পাশে থাকে। মাটিতে জো বেশি থাকলে বা আগাম রোপণে বীজখণ্ডের ওপর মাটি কম এবং জো কম থাকলে বা শীতের সময় বীজখণ্ডের ওপর মাটি বেশি দিতে হবে।
আরও পড়ুন: Profitable Mushroom Farming - দারিদ্র দূরীকরণে দিশা দেখাচ্ছে মাশরুম, চাষে আয়ের সম্ভবনা প্রচুর
এ পদ্ধতিতে আখের চারা তৈরি করে চারাগুলো মূল জমিতে নালার ভেতর রোপণ করা হয়। আখের চারা তৈরির জন্য বেশ কয়েকটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এরমধ্যে পলিব্যাগে চারা তৈরি, বীজতলায় চারা তৈরি এবং গাছচারা তৈরি পদ্ধতি প্রধান। চারা তৈরির জন্য বীজখণ্ডগুলো বিশেষ যত্নের সাথে তৈরি করা হয়। উৎপাদিত চারা স্টকলেস চারা করে সহজেই কম খরচে ধানের চারার মত দূর-দূরান্তে পরিবহন করা যায়।
চারা উৎপাদনের সময়:
শ্রাবণ- আশ্বিন মাস চারা উৎপাদনের সবথেকে ভালো সময়। এসময় তাপমাত্রা বেশি থাকায় চারা বেশি গজায়। আশ্বিনের পরে অঙ্কুরোদগম কমে এবং চারা উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে। আশ্বিন মাসে চারা উৎপাদন করে শীতের পরেও জমিতে রোপণ করা যায়।
সার প্রয়োগ (Fertilizer):
চাষের সময় জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য হেক্টরপ্রতি ১৫ টন পচা গোবর সার প্রয়োগ করে ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর ফসফেট, জিঙ্ক, জিপসাম, ম্যাগনেসিয়াম এবং এক-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া ও অর্ধেক পটাশ প্রয়োগ করে কোদাল দিয়ে হালকাভাবে কুপিয়ে সার ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এক-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া ও পটাশ সার আখের কুশি উৎপাদনের সময় ১২০-১৫০ দিনের মধ্যে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। বাকি এক-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া ও পটাশ সার প্রথম উপরি প্রয়োগের এক মাস পরেই দ্বিতীয় দফায় উপরি প্ৰয়োগ করতে হবে।
আরও পড়ুন: Elephant Apple Farming: চালতা চাষ করে হয়ে উঠুন সম্ভাবনাময় চাষি