জৈব কৃষি (Organic Cultivation) একটি সার্বিক উৎপাদন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, যা জৈব বৈচিত্র্য, জৈবিক চক্র এবং মাটির জৈবিক কার্যকলাপ সহ কৃষি বাস্তু শাস্ত্র বৃদ্ধি করে। আন্তর্জাতিক জৈব কৃষি আন্দোলন ফেডারেশন (IFOAM)- এর মতে জৈব কৃষি একটি কৃষি ব্যবস্থা, যা পরিবেশগত ভাবে, সামাজিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে খাদ্য, তন্তু, কাঠ ইত্যাদি উৎপাদনকে উন্নীত করে। ইউনাইটেড স্টেট্স কৃষি দপ্তর (USDA) আবার জৈব কৃষিকে (Smart Farming) সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে – একটি পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থা, যা জিব বৈচিত্র্য, জৈবিক চক্র এবং মাটির জৈবিক কার্যকলাপ বাড়ায়।
আধুনিক কৃষি ব্যবস্থায় উৎপাদন বেড়েছে অথচ প্রতিদিন ক্রমাগত মাটির উর্বরতা ও উৎপাদিকা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক –এর বহুল ব্যবহার ছাড়া উন্নতমানের ফলন পাওয়া সম্ভব নয়, চাষিদের এই বদ্ধমূল ধারণা এবং সময়ের অগ্রগতি, এই দু’য়ের কারণে এগুলির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। উচ্চমাত্রায় এই রাসায়নিকগুলির লাগামছাড়া ব্যবহারের ফলে মাটি ও কৃষি পণ্যের উপর তার কুপ্রভাব পড়েছে। সাথে সাথে পরিবেশ ও জৈব বৈচিত্র্যের ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে। দশ হাজার বছরের কৃষিতে ন’হাজার ন’শো বছরে মাটির জৈব পদার্থ ৫ – ৩.৫ শতাংশে নেমে এসেছিল। গত ১০০ বছরে তা আরো হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে ০.৫ – ১ শতাংশে নেমে এসেছে বর্তমান কৃষি ব্যবস্থায়। এ কারণে, মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা ঠিক রাখতে, রাসায়নিকগুলির বহুল ব্যবহারে পরিবেশ দূষিত হওয়া রোধ করতে, পৃথিবীর বুকে নিরাপদ জীবন-যাপন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও মাটির গুণাগুণ বজায় রাখার জন্যে জৈব কৃষি একান্ত প্রয়োজন। সর্বোপরি, আমাদের নির্মল পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বাঁচার জন্যে পরিবেশবান্ধব কৃষি আবশ্যকীয়ভাবে দরকার। আর পরিবেশবান্ধব কৃষির বাস্তবায়ন করতে হলে জৈব কৃষির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
জৈব চাষে কোন রাসায়নিক পদার্থ (বিশেষত: কৃষিবিষ) ব্যবহার করা হয় না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে সনাতন পদ্ধতিতে চাষবাস করতেন তা ছিল সম্পূর্ণভাবে জৈব উপাদান নির্ভর। বর্তমানে অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা ক্রমশই হ্রাস পেতে চলেছে। এর ফলে রোগ পোকার আক্রমণ যেমন বাড়ছে তেমনই ফসল তার নিজস্ব স্বাদ-গন্ধ হারাচ্ছে। তাই জৈব কৃষির লক্ষ্য হল মাটির জৈব পদার্থ বাড়ানো, উৎপাদিত ফসলের উৎকর্ষতা ও খাদ্যগুণ ধরে রাখা, খাদ্য ও জলে কৃষিবিষের অবশেষ কমানো, কৃষকের সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও কৃষি খরচ কমানো। সংরক্ষনশীল ও সুস্থির কৃষিই হল জৈব চাষের লক্ষ্য।
বিভিন্ন প্রকার জৈব সারের প্রস্তুত প্রণালী :
(ক) খামার জাত সার (Farm Yard Manure) :
কৃষি খামারের বিভিন্ন প্রকার পশুপাখির মলমূত্র ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থগুলি একত্রে মিশিয়ে ও পচিয়ে যে সার প্রস্তুত করা হয়, তাকে খামারজাত সার বলে।
প্রস্তুত প্রণালী :
গোয়ালের কাছাকাছি উচু স্থানে একটি ৩ মিটার × ১.৫ মিটার × ১ মিটার আয়তনের গর্ত খুঁড়তে হবে। এরপর গর্তটিকে সমান চারভাগে ভাগ করে দিতে হবে। এরপর গর্তটিকে সমান চারভাগে ভাগ করে খামারের আবর্জনা ও পশুপাখির মলমূত্র যেকোন একটি অংশে ফেলে যেতে হবে। মাঝে মাঝে গোমূত্র ও জল ছিটিয়ে ৪০-৫০ শতাংশ আর্দ্রতা বজায় রাখতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় খামারজাত সার তৈরি করতে প্রায় তিনমাস সময় লাগে। এই সারের সঙ্গে গর্ত পিছু ৩০-৪০ কিগ্রা সিঙ্গল সুপার ফসফেট মিশিয়ে দিলে সারের গুণাগুণ ও সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
(খ) কম্পোষ্ট বা আবর্জনাসার :
বিভিন্ন প্রকার নরম ও সবুজ আগাছা, ফসলের অবশিষ্টাংশ,গাছের ঝরাপাতা, তরিতরকারি, খড়কুটো, কচুরিপানা প্রভৃতি একত্রে মিশিয়ে পচিয়ে যে ধূসর বর্ণের সার তৈরি হয় তাকে কম্পোস্ট সার বলে। কম্পোস্ট সার তৈরির সময় সারের মান উন্নত করার জন্য সাধারণত সিঙ্গল সুপার ফসফেট প্রয়োগ করতে হয়। সাধারণত ৩ মিটার × ১.৫ মিটার × ১মিটার আয়তনের গর্তে ৬০ কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট প্রয়োগ করা যেতে পারে।
(গ) কেঁচোসার :
একটি বড়ো কেঁচো তার শরীরের ওজনের সমপরিমাণ জৈব পদার্থ খেয়ে থাকে। কেঁচোর পৌষ্টিকনালীর মধ্যে বসবাসকারী অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া ও অ্যাকটিনোমাইসিটিস জৈব পদার্থকে দ্রুত ভেঙ্গে উদ্ভিদের গ্রহণযোগ্য অবস্থায় নিয়ে আসে।
আরও পড়ুন - নারকেল ছোবড়া থেকে তৈরি সারে বাড়ছে মাটিতে পুষ্টিবিধায়ক পদার্থ (Cocopeat Usage)
প্রস্তুত প্রণালী :
কেঁচোসার তৈরির জন্য ছায়াযুক্ত উঁচু জায়গার প্রয়োজন হয়। সাধারণত ২ মিটার * ১মিটার * ১ মিটার গভীর গর্ত করা হয়। একে ভার্মি বেড বলে। গর্তের তলায় পাথরকুঁচি, ভাঙা ইঁটের টুকরো বা বালি বিছিয়ে ১৫-২০ সেমি দোঁয়াশ মাটির আস্থরণ দিয়ে ১০০-১৫০ টি কেঁচো ছেড়ে দেওয়া হয়। এর উপর ৫-১০সেমি উঁচু গোবর ছড়িয়ে তার উপর ১০ সেমি শুকনো পাতা, ফসলের অবশিষ্টাংশ, খড় প্রভৃতি দেওয়া হয়। এই ভাবে ৩-৪ দিন অন্তর অর্ধপচিত খামারের আবর্জনা, সবুজ পাতা, ফসলের অবশিষ্টাংশ, ডালপালা, সবজির খোসা প্রভৃতি ৫ সেমি পুরু স্তর দেওয়া হয় যতক্ষননা ভর্তি হয়। ভার্মিবেডের উপর পুরানো চটের বস্তা চাপা দিয়ে প্রতিদিন মাঝে মাঝে জল ছিটিয়ে দেওয়া হয়। ভার্মিবেডের সারের রঙ কালচে বাদামী হলে জল ছিটানো বন্ধ করতে হবে। প্রায় ৬ সপ্তাহে কেঁচোসার তৈরি হয়।
সাধারনত এই ধরনের ভার্মিবেডে ১০-৮০ হাজার কেঁচো ও মাসে ১০ কুইন্টাল কেঁচোসার তৈরি হতে পারে। কেঁচোসারের প্রয়োগমাত্রা হচ্ছে ২ মে. টন প্রতি হেক্টরে (সেচসেবিত অঞ্চলে), বৃষ্টিনির্ভরচাষে ০.৭৫-১.০০ টন এবং খরা প্রবণ এলাকায় ০.২৫-০.৩০ টন।