উদ্ভিদ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে টমেটো একটি ফল হলেও, সবজি হিসেবেই সারা বিশ্বে টমেটো পরিচিত। সবজি এবং সালাদ হিসেবে ভিটামিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ টমেটোর বেশ চাহিদা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষীদের জন্য এটি একটি বিশেষ অর্থকরী সবজি। সবজি হিসাবে এর ব্যবহার ছাড়াও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পেও এর ব্যবহার সুবিদিত। দেশের বাজারের চাহিদা মিটিয়ে টমেটো রপ্তানিরও প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। রান্নার উপকরণ হিসেবে এবং খাবারের সাথে টমেটো সসও বেশ প্রচলিত।
আর বছরব্যাপী এই চাহিদার কারণেই হাইড্রোপনিক বা অ্যাকোয়াপনিক পদ্ধতিতে চাষকৃত ফসলের বেশিরভাগই টমেটো। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষকৃত টমেটো আকার আকৃতি এবং রঙ হয় অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কম সময় ও স্থানের মধ্যে বেশি ফলন পাওয়া যায়। ফলের মান ভালো হওয়ার কারণে দামও পাওয়া যায় ভালো।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে টমেটো চাষে ব্যাপক লাভজনক হওয়ার দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। আসুন জেনে নেই হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে টমেটো চাষের জন্য কি কি করণীয়
চারা উৎপাদন -
হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে টমেটোর চারা উৎপাদনের জন্য প্রথমে বীজকে একটি প্লেটে খবরের কাগজ/টিস্যু পেপার বিছিয়ে তার উপর বীজ ঘন করে ছিটিয়ে রাখতে হবে। এরপর বীজের উপর হালকা পানি ছিটিয়ে দিয়ে ভিজিয়ে পেপার দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। বীজ অঙ্কুরিত হওয়া শুরু করলে বীজকে স্পঞ্জ ব্লকের গর্তে স্থাপন করতে হবে। তারপর স্পঞ্জ ব্লককে পানির ট্রেতে ভাসিয়ে রাখতে হবে। যখন চারা ২-৩ পাতা অবস্থায় আসবে তখন থেকে প্রতি দিন ট্রেতে ১০-২০ মি.লি. খাদ্য উপাদান দ্রবণ “এ” এবং “বি” যোগ করতে হবে এবং ds/m ০.৫-০.৮ এর মধ্যে রাখতে হবে।
চারা রোপণ পদ্ধতি (Plantation) -
ক. চারা লাগানোর ট্রের সাইজ বিভিন্ন মাপের হতে পারে। এটি ট্রের ধারকের (স্ট্যান্ড) ওপর অনেকটা নির্ভর করে। সাধারণত ৩ মি X ১ মি মাপের ট্রে হলে ব্যবস্থাপনা ভালোভাবে করা যায়। আকার অনুযায়ী তার ভিতর পরিমাপ মতো পানি নিতে হবে। পানির গভীরতা ৬-৮ সেমি হতে হবে। পানিতে প্রতি ১০০ লিটার পানির জন্য ১ লিটারে খাদ্য উপাদান দ্রবণ A এবং ১ লিটার খাদ্য উপাদান দ্রবণ B যোগ করতে হবে। দ্রবণ মিশানোর সময় প্রথমে খাদ্য উপাদান দ্রবণ A যোগ করে পানিতে ভালভাবে মিশিয়ে নিতে হবে এবং পরে খাদ্য উপাদান দ্রবণ B যোগ করে ভালভাবে মিশাতে হবে। দ্রবণের মিশ্রণ তৈরির পর ট্রের উপর কর্কশিট স্থাপন করতে হবে। প্রতিটি গাছ থেকে গাছ এবং সারি থেকে সারি ৩০ সেমি দূরে দূরে রাখতে হবে এবং কর্কশিটের উপর এই দূরত্ব অনুযায়ী ছোট্ট গর্ত করতে হবে। তারপর প্রতিটি গর্তে ১টি করে সুস্থ সবল চারা রোপণ করতে হবে।
খ. প্লাস্টিক বালতিতে টমেটোর চারা রোপণ (Tomato in hydroponic method) -
ট্রেতে চারা লাগানো ছাড়া বালতিতেও টমেটো উৎপাদন করা যায়। প্রথমে বালতি ভালভাবে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। বালতির উপর ৬-৮ সেমি জায়গা ফাঁকা রেখে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি দিয়ে পূর্ণ করতে হবে। এরপর প্রতি ১ লিটার পানির জন্য ১০ মি.লি. দ্রবণ “এ” এবং ১০ মিলি দ্রবণ “বি” যোগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে দ্রবণ যোগ করার সময় প্রথমে দ্রবণ “এ” এর পরে দ্রবণ বণ “বি” মিশাতে হবে। একটি কর্কশিট বালতির মুখে স্থাপন করে প্রথমে তা দাগ দিয়ে তার চেয়ে সামান্য ছোট করে কেটে নিতে হবে। এরপর তার উপর মাঝ বরাবর ১টি এবং পাশে আরও ২-৩ টি গর্ত করতে হবে যাতে পাত্রের ভিতর বাতাস চলাচল করতে পারে।
বালতির উপর গোল করে কাটা কর্কশিট স্থাপন করতে হবে এবং এর মাঝের ছোট গর্তে ১টি করে চারা লাগাতে হবে। চারা রোপণের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন দ্রবণ ও গাছের গোড়ার মাঝে ২.৫৪ সে.মি. বা ১ ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা ফাঁকা থাকে কিন্তু শিকড় যেন দ্রবণ পর্যন্ত পৌঁছায়। এবার বালতিটিকে আলো ও বাতাস চলাচল করে এমন স্থানে স্থাপন করতে হবে।
অন্যান্য ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যা -
চারা গাছের বৃদ্ধির সাথে সাথে তার খাদ্যের প্রয়োজনীয়তাও বাড়ে। সাধারণত ১৫-২০ দিন পর অল্প পরিমাণ ১০% খাদ্য উপাদান সমেত দ্রবণ যোগ করতে হয়। গাছের বৃদ্ধির সময় উপরের দিকের পাতা হলুদ হয়ে গেলে ৫ গ্রাম EDTA আয়রন ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ১০০ লিটার পানির জন্য ২০০ মিলি হারে প্রয়োগ করতে হবে। গাছে ফুল আসা শুরু হলে গাছের খাবার দ্রবণের মাত্রা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতি ১০০ লিটার পানিতে ১০০ মিলি নিউট্রিয়েন্ট সলিউশন A এবং ১০০ মি.লি. নিউট্রিয়েন্ট সলিউশন B দ্রবণ যোগ করতে হবে। এ সময় দ্রবণের EC ২.০ থেকে ২.৫ এবং pH ৬.০-৬.৫ এর মধ্যে বজায় রাখতে হবে। গাছের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির সাথে সাথে তাকে সোজা করে দাঁড়িয়ে রাখতে গাছের গোড়ায় উল্লম্বভাবে (খাড়া) রশি বেঁধে রাখতে হবে।
রোগ ও পোকার আক্রমণ এবং প্রতিকার -
এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে সাধারণত রোগ এবং পোকার আক্রমণ খুবই কম হয়। তবে মাঝে মাঝে লাল মাকড়সা, সাদা মাছি, থ্রিপস এবং জাব পোকার আক্রমণ দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রতি ১ লিটার পানিতে ১ মিলি ভারটিমেক (লাল মাকড়ের জন্য), ১ মিলি এডমায়ার (থ্রিপস এবং জাব পোকার জন্য) এবং কমপক্ষে ২ মিলি ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর স্প্রে করলে এদের দমন করা যায়।
ফসল সংগ্রহ -
সময়মত গাছের ফল সংগ্রহ করলে উপরের দিকে ফল বেশি আসে। সাধারণত চারা রোপণের ১৫-২০ দিনের মধ্যে ফুল আসতে শুরু করে এবং ফুল ফোঁটার ৪৫-৬০ দিনের মধ্যে টমাটো সংগ্রহ করা যায়। ফলের ঠিক নিচে ফুল ঝরে পড়ার পর যে দাগ থাকে ঐ স্থানে লাল রঙ দেখা দিলেই ফল সংগ্রহ করতে হবে।
সপ্তাহে একবার ফল সংগ্রহ করাই ভালো। বোঁটাসহ ফল সংগ্রহ করে ছায়াযুক্ত ঠাণ্ডা জায়গায় সংরক্ষণ করে বাজারজাত করা ভালো।
আরও পড়ুন - পান চাষ করে এক বিঘা বরজ থেকে লাভ করুন চল্লিশ হাজার টাকা (Betelvine Cultivation)