প্রকৃতির অকৃপণ দানে আমরা চিরকালই সমৃদ্ধ। প্রাণধারণের উপকরণ ছাড়া আমাদের সাবলীল জীবনযাপন সম্ভব হয়েছে প্রকৃতির আনুষঙ্গিক দানে – তাই প্রকৃতির কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। খাদ্যের পরে আচ্ছাদন সরবরাহ করেছে প্রকৃতি – সেই গুহাবাসী আদিম মানুষের যুগ থেকেই। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি আমাদের বসনভূষণের চাহিদাও মিটিয়েছে – আমাদের প্রসাধন সামগ্রী যুগিয়েছে, এমনকি বিলাসবহুল জীবনের সামগ্রীও পেয়েছি আমরা প্রকৃতির দানে। গাছের বাকল থেকে পরিধেয়ের চাহিদা শুরু, এরপর কৃষিজীবী মানুষ কর্ষণের মাধ্যমে কার্পাস তুলো চাষের সাহায্যে বস্ত্র বয়ন করেছে, ক্রমে জীবনে যখন প্রাচুর্য এসেছে, বিলাসময়তার দিকটিও ধীরে ধীরে আভাষিত হয়েছে। এর থেকেই হয়তো আমরা সুতি বস্ত্র থেকে সিল্ক বা রেশম বস্ত্রের দিকে আকৃষ্ট হয়েছে। প্রাকৃতিক এইসব তন্তুর সাথে সাথে গবেষণার ফলশ্রুতি হিসাবে আমরা পেয়েছি অনেকগুলি কৃত্রিম তন্তুও। কিন্তু সমস্ত প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম তন্তুর মধ্যে চিরকালীন ও চিরন্তন হল রেশম। সামান্য এক পোকা যে লাবণ্যে তুল্যমূল্য রেশমের উৎস – তা জানতে বিশ্ববাসীর সময় লেগেছে বহু বছর। এই উৎপাদনের রহস্য নিজেদের মধ্যে বহুকাল গোপন রেখেছিল চীনারা। আজ সারা পৃথিবীতে চীনের পরেই আমাদের দেশ শুধু দ্বিতীয় বিশ্বসেরাই নয়, অন্যতম যে চারধরণের সিল্ক পাওয়া যায়, অর্থাৎ মালবেরী, তসর, মগা, এরি- তার সবকটি একমাত্র আমাদের দেশেই উৎপন্ন হয় আর কোথাও একসাথে তা হয় না এবং যে রেশম বস্ত্রগুলি আন্তর্জাতিক খ্যাতিলাভ করেছে – বেনারসি, কাঞ্জিভরম (বা কাঞ্চীপুরম), বোমকাই, ইক্কত, বালুচরী, মুর্শিদাবাদ, ধর্মাভরম, পাটোলা, পৈঠানি ইত্যাদি – সেগুলি আজ আমাদের শিল্পীরাই কেবল বানান।
রেশম মথের খাদ্যনালীর উভয় পাশে একজোড়া রেশমগ্রন্থি থাকে, যেগুলিকে পরিবর্তিত লালাগ্রন্থিও বলা যেতে পারে। ক্রমশই যখন পূর্ণতা লাভ করে তখন স্পিনারেট (Spinneret) দিয়ে তরল রেশম নির্গত হয় ও সঙ্গে সঙ্গে বায়ুর সংস্পর্শে আসামাত্র শুকিয়ে রেশম বা সিল্ক সুতোয় পরিণত হয়। রাসায়নিক দিক থেকে এই সুতো প্রোটিন তন্তু, যাতে দুরকম প্রোটিন মিশ্রিত থাকে- কেন্দ্রীয় অংশটি ফাইব্রয়েন (Fibroin) ও তাকে ঘিরে থাকে সেরিসিন (Sericin, C30 H50 N10 O16 C30 H46 N10 O12) – এই দুটি প্রোটিনের মিশ্রণই রেশমের জৌলসের প্রধান কারণ।
রেশম চাষ যা সেরিকালচার নামে পরিচিত, তাঁর পর্বগুলি হল পোষক উদ্ভিদের চাষ (তুঁতজাত রেশম বা Mulberry Silk – একমাত্র তুঁতগাছের পাতা খেয়ে থাকে)। রেশম মথ প্রতিপালন, রেশমগুটি থেকে রেশমতন্তু নিষ্কাশন, রেশম সংগ্রহ ও উক্ত রেশমকে পরিশুদ্ধ করে বিলিং করা পর্যন্ত সামগ্রিক পদ্ধতি রেশম চাষ বা সেরিকালচার নামে পরিচিত। আমাদের দেশে চাররকমের রেশম দেখতে পাওয়া যায়, অর্থাৎ মালবেরী, এরি, মুগ ও তসর (বা কোসা)। প্রথমটি তৈরি হয় বমবিক্স বর্ণের রেশম পোকার গুটি থেকে, যে পোকা মালবেরী বা তুঁত গাছের পাতা খায়। দ্বিতীয়টি তৈরি হয় ফিলোসেমিয়া বর্ণের রেশম গুটি থেকে, যারা ক্যাসটর বা রেড়ী বা এরন্ড গাছের পাতা খায়, অ্যানথেরিয়া অ্যাসামেনসিস বর্ণের রেশম গুটি থেকে পাওয়া যায়, যারা সোম ও শোয়ালু গাছের পাতা খায়, এবং চতুর্থটি অ্যানথেরিয়া মাইলিট্টা বর্ণের, অর্জুন গাছের পাতা এদের প্রিয় খাবার।
মালবেরী (Mulberry) সিল্কের বমবিক্স মথ একচক্রী (বছরে একবার ডিম পাড়ে)- আমাদের রাজ্যে কালিম্পং জেলায় এর চাষ ভালো হয়, রঙ সাদা ও উপবৃত্তাকার। যেগুলি দ্বিচক্রী বা বহুচক্রী – সেগুলির চাষ আমাদের রাজ্যে মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, ২৪ পরগণা (উত্তর ও দক্ষিণ), পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূম, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়াতে হয়, এরা সাধারণত সোনালী বর্ণের হয়। যেহেতু তুঁতজাত রেশম তুঁতগাছের পাতা খায়, তাই বিজ্ঞান-ভিত্তিক উপায়ে উন্নতমানের তুঁতগাছের চাষ এই রেশম চাষের এক অন্যতম অধ্যায়।
রেশম মথের পরীক্ষিত ডিম নিয়ে রেশমপালন শুরু হয়, সাধারণত সরকারী বীজাগার থেকে সংগ্রহ করাই শ্রেয়। ডিম ফোটানো থেকে শুরু করে পাঁচটি পর্যায়ে লার্ভা অবস্থা অতিক্রম করার পর রেশম পোকা বা পোলু গুটি তৈরি করে। গুটিবদ্ধ অবস্থায় রেশম পিউপা বা কীটগুলিকে গরম জলে সেদ্ধ করে রিলিং বা সুতো ছাড়ানো হয় এবং পড়ে তা গোটানো হয়। এগুলি রিল্ড সিল্ক বা র-সিল্ক নামে পরিচিত। রিলিং করার সময়ে কিছু সুতো পরিত্যক্ত হয়, যাকে চশম বলে। মথ যদি গুটি থেকে কোনভাবে বেরিয়ে যায়, তবে রিল্ড সিল্ক পাওয়া যায় না। কাটা গুটিগুলিকে লাটকোয়া বলে, লাটকোয়া কাটাই করে যে সুতো পাওয়া যায়, তাকে মটকা বলে। চশমকে পাকিয়ে যে রেশম উৎপন্ন হয়, স্পান সিল্ক (Span silk) বলে। ১ কেজি রিল্ড সিল্ক তৈরি করতে ২৫০০০ গুটির প্রয়োজন পড়ে।
পৃথিবীর মধ্যে ভারতবর্ষই একমাত্র দেশ যেখানে সব ধরণের রেশম চাষ হয়। যেমন, তুঁত রেশম, তসর, মুগা এবং এরি – যদিও তুঁত রেশমই সর্বাধিক পরিচিত এবং মোট সিল্ক উৎপাদনের শতকরা ৮০ ভাগই তুঁত রেশম। মুখ্য তুঁত রেশম উৎপাদনকারী রাজ্যগুলি হল – কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ ও জম্মু-কাশ্মীর এবং তসর রেশমের জন্য – ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ। এগুলিকে গ্রীষ্মমন্ডলীয় তসর বলে। এছাড়াও আছে ওক তসর, যা হিমালয়বেষ্টিত রাজ্যগুলি যেমন উত্তরাখন্ড, মণিপুর, নাগাল্যান্ডে উৎপাদিত হয়।
এছাড়াও রয়েছে লোটাস সিল্ক, অর্থাৎ পদ্ম থেকে তৈরি রেশম, যা মায়ানমার এবং এখন ভিয়েতনামে প্রস্তুত করা হয়। পদ্মের কান্ড থেকে প্রাপ্ত আঁঠালো তন্তু থেকে রেশম প্রস্তুত করা হয় সম্পূর্ণভাবে হস্তের মাধ্যমে, মেশিনের মাধ্যমে এই সিল্ক প্রস্তুত/বুনন সম্ভব হয় না। লোটাস সিল্ক বিরলতম সিল্কের প্রজাতির মধ্যে পড়ে এবং এর মূল্যও সাধারণ সিল্কের তুলনায় অনেকটাই বেশী। আমাদের দেশে কৃষকরা এই লোটাস সিল্ক প্রস্তুত করে নিজেদের আয় বৃদ্ধি করতে পারেন। পদ্ম আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে চাষ হয়, পদ্মফুল বাজারে রপ্তানি করা হলেও তার কান্ড কিন্তু বর্জ্য রূপে ফেলে দেওয়া হয়, তন্তু তা থেকে সংগ্রহ করা হয় না। অপরদিকে সনাতনী হিন্দু ধর্মের রীতি অনুযায়ী, সন্ধিপূজায় মা দুর্গাকে ১০৮ টি পদ্ম নিবেদন করা হয় এবং পূজা পরবর্তীকালে এই পদ্মগুলি অবহেলা ভরে জলাশয়ে অথবা অন্য জায়গায় নিক্ষেপ করা হয়। অথচ এই ফেলে দেওয়া পদ্মগুলির কান্ড থেকে যে কত মূল্যবান রেশম তন্তু প্রস্তুত করা যায়, তা প্রায় অনেকেরই অজানা। সুতরাং, ব্যবহৃত পদ্ম ফেলে না দিয়ে তা থেকে কীভাবে রেশম প্রস্তুত করা যায়, তা বিশেষজ্ঞের থেকে শিখে নিয়ে নিজের আয় বৃদ্ধির কথা ভাবতেই পারেন কৃষক।
রেশম চাষ মূলত কৃষিনির্ভর উদ্যোগ – এর মধ্যে খাদ্যগাছের চাষ এবং রোমকীট পালন অন্তর্ভুক্ত, যা থেকে রেশমগুটি ও সিল্ক পাওয়া যায়। রেশম শিল্পের প্রধান দিকগুলি হল - খাদ্যগাছের চাষ ছাড়া রেশমকীটকে খাইয়ে কোকুন বা গুটি তৈরি এবং এগুলি থেকে কাটাই করে রেশমসুতো তৈরির মাধ্যমে সিল্ক সামগ্রী বানানো। আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে সিল্ক/রেশম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এই শিল্পে নিযুক্ত মানুষের সংখ্যা ৭৫ লক্ষেরও বেশী, যার মধ্যে বহু সংখ্যক মহিলা রয়েছেন। এই চাষে কোন অংশই ফেলা যায় না, মৃত পিউপা মাছের উৎকৃষ্ট খাবার হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
নিবন্ধ - ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিজ্ঞানী, ICAR – CIFA (www.cifa.in)
দীপক পাল – এমএসসি, সেরিকালচার (চতুর্থ বর্ষ)