শিরানামটি পড়ে অনেকে হয়তো অবাক হচ্ছেন, অনেকে নাক সিটকাচ্ছেন, আবার অনেকে হয়তো ভাবছেন এ আবার হয় নাকি কখনো? হ্যাঁ, হয়। এই আমাদের কলকাতাতেই বিধাননগরের দুটি বাড়িতে বৃষ্টির জল খাওয়া ও রান্নার কাজে ব্যবহার হচ্ছে গত ২০০৮ সাল থেকে। এখানে আমরা এই বিষয় নিয়েই আলোচনা করব।
বৃষ্টির জল সংরক্ষণ -
ভারতে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১১৭০ মিলিমিটার, আর কলকাতায় ১৬৪০ মিলিমিটার। সারা বছরের মধ্যে বর্ষা ঋতু মাত্র চার মাসের মতো। এর মধ্যে আবার বেশির ভাগ বৃষ্টিপাতই ১০০ ঘণ্টার মধ্যে হয়ে যায়। এর থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, বৃষ্টিপাত ঋতুনির্ভর।
উদাহরণ হিসাবে, বিধাননগরের সেক্টর ১, ২ এবং ৩ নম্বরের বাড়িগুলোর ছাদ থেকে যদি বৃষ্টির জল ধরা যায়, তবে ২৫০৬ মিলিয়ন লিটার জল পাওয়া যেতে পারে। যদি বর্ষার মধ্যে না সংরক্ষণ করা যায় তবে, এই বিশাল পরিমাণ জল ড্রেন, নালা, নদী দিয়ে সমুদ্রে চলে যাবে। এই বিশাল জলরাশি সংরক্ষণ করা যাবে কোথায়? আমাদের বাড়ির ছাদের ওপর কিছুটা, বাড়ির মধ্যে ঘেরা কোন স্থানে কিছুটা, আর বাকিটা মাটির তলার বিশাল জলভাণ্ডারে। বাড়ির ছাদ থেকে বৃষ্টির জল ধরার পদ্ধতিকে বলা হয় রেইনওয়াটার হারভেস্টিং। অর্থাৎ, বৃষ্টির জল সংগৃহীত করা। ছাদ থেকে বৃষ্টির জল কীভাবে সংরক্ষণ করা যায়, সেই ব্যাপারটাই আলোচনা করব।
আমরা বাড়ির বর্তমান নকশাতে বৃষ্টির জল ধরার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করলে সেই জল ছাদ থেকে গড়িয়ে নিকাশি পাইপ দিয়ে নেমে আসবে। আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী একটা বা সমস্ত নিকাশী পাইপগুলি একত্র করে বৃষ্টির জল সংগ্রহ করে এক বা তার বেশি রিজার্ভারে রাখতে পারি। যদি একটা ছাদের ক্ষেত্রফল ১০০ স্কোয়ার মিটার হয়, তবে সেই ছাদ থেকে আমরা প্রায় ১,২০,০০০ লিটার জল পেতে পারি। বাড়িতে গড়ে চারজন লোক আছে ধরে নিলে ঐ জলে
বাড়ির সব কাজ সারা বছর চলে যাবে, মিউনিসিপ্যালিটির জল দরকার হবে না। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত খুবই ব্যয়সাপেক্ষ। এক্ষেত্রে একতলা বাড়ির সিঁড়ির ছাদ থেকে বৃষ্টির জল ধরাই ভাল। সেখান থেকে প্রায় ৯৪০০ লিটারের মতো বৃ্টির জল পেয়ে যাব। নিকাশী পাইপে একটা বিশেষ ধরনের ডিভাইস বসিয়ে তার খানিক ওপর থেকে একটা পাইপ টেনে নিয়ে সেটা ফিল্টারের সাথে যোগ করে দিতে হবে। বৃষ্টির জল যখন আকাশ থেকে পড়ে, তখন ফোটাগুলো বায়ুমণ্ডল থেকে কিছু পলুট্যান্ট নিয়ে ছাদে পড়ে। ছাদ থেকে সেই জল আবার যখন নিকাশী পাইপের দিকে গড়িয়ে যায়, তখন আবার ছাদ থেকে কিছু পলুট্যান্ট নিয়ে যায়। সুতরাং এই জল খাওয়ার জন্য বিশেষ ধরনের ফিল্টার করা অতি আবশ্যক। বাড়ির অন্য সব কাজের জন্য খুবই সাধারণ ফিল্টার (যাকে 'বাকেট ফিল্টার বলা হয়) যথেষ্ট। ফিল্টার করা জল পাইপ দিয়ে যে-ট্যাঙ্কে বৃষ্টির জল সঞ্চয় করা হবে, সেখানে জমতে থাকবে। ফিল্টারে থাকে প্রাকৃতিক পদার্থ। এই ধরনের ফিল্টারে বেশির ভাগ পলুট্যান্টই আটকে যায়। ফিল্টার করা জল পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এই জল বি. আই, এস 10500-1993-এর পানীয় জলের মাপকাঠিতে পাস হয়ে যাচ্ছে। বিছু অতি সূক্ষ্ম পেটের পক্ষে ক্ষতিকারক পোকা (কলিফর্ম অর্গানিজম এবং ই-কলি) যদি কখনো বেরিয়ে গিয়ে রিজার্ভারে এসে যায়, তাই এই জলকণ UV Ray তে রাখার পর আবার পরীক্ষা করে দেখা গেছে ঐ অতি সূক্ষ্ম পোকা আর পাওয়া যায়নি। এইভাবে বৃষ্টির জলকে বিশুদ্ধ থাওয়ার জলে পরিণত করা জল বর্তমানে আমরা খাই, তার তুলনায় এই ফিল্টার করা জল অনেক গুণে ভাল। আর তাছাড়া এই জল রান্নাঘরে পাইপের সাহায্যে ছাদ থেকে নেমে আসে বলে লোড শেডিং বাধা হয়ে দাঁড়ায় না বা বিদ্যুৎ-খরচও নেই।
এই সিস্টেমের খরচ কত? এই জলে কি সারা বছর চলে যাবে? বৃষ্টির জলের খরচ কত, সহজ নিয়মে চটপট করা যায় না। তবে একটা পরিবারে যদি গড়ে তিনজন লোক বসবাস করেো এবং গড়ে আড়াই লিটার জল খায়, সেক্ষেত্রে শুধু খাওয়ার জন্য ব্যবহার করলে এই জলে সারা বছর চলে যাবে। তার খরচ প্রায় ২০ হাজার টাকার মতো পড়বে। আর রান্নার জন্য আরও ৫ হাজার টাকা লাগবে। এই শুদ্ধ বৃষ্টির জলকে যদি বাজারের পরিশ্রুত জলের সাথে তুলনা করা যায় তবে দেখা যাবে যে, এই খরচ নিতান্তই কম।
এই সিস্টেমের রক্ষণাবেক্ষণ কিভাবে করা যাবে?
বর্ষার আগে বছরে মাত্র একবার ফিল্টারের পদার্থগুলি বের করে ভালভাবে পরিষ্কার করার পর পদার্থগুলি যেভাবে সাজানো ছিল, সেইভাবে সাজিয়ে রাখতে হবে। আর রক্ষণাবেক্ষণ বলতে কিছু নেই। এর জন্য বছরে মাত্র ১ হাজার টাকা খরচ হতে পারে।
নিবন্ধ লেখক - চিত্তরঞ্জন হালদার (প্রাক্তন অতিরিক্ত চিফ ইঞ্জিনিয়ার, ডি.সি.এস ই এম., ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি)
সংগৃহীত - উদ্বোধন পত্রিকা
Image source - Google
Related link - (Water conservation) সাম্প্রতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জল সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ও তার উপায়