মৃত্তিকাবাহিত রোগগুলির কারণে বিভিন্ন ফসলে প্রায় ৫০% পর্যন্ত ক্ষতি হয়ে থাকে। মোট উৎপাদন ঘাটতির ১০-২০ শতাংশ শুধুমাত্র মৃত্তিকাবাহিত রোগগুলির কারণে হয়। যেসব রোগের জীবাণু মাটিতে বা মাটিতে থেকে যাওয়া ফসলের অবশিষ্টের মধ্যে বেঁচে থাকতে পারে সেইসব জীবাণুঘটিত রোগগুলিকে মৃত্তিকাবাহিত রোগ বলা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা মাটির নিচেই সংক্রমণ শুরু করে, ফলে রোগের প্রাথমিক লক্ষণ ফসলের বৃদ্ধিদশার বেশ অনেকটা সময় অবধি দৃষ্টিগোচর হয় না।
মাটির উপরের অংশে যখন রোগলক্ষণ প্রকাশ পায়, তখন প্রায়শই কোনও সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেও খুব একটা লাভ হয় না। ফলে ফসলের বাণিজ্যিক অংশগুলির (বীজ, কন্দ, আনুভূমিক স্ফীত কাণ্ড) এবং অন্যান্য সহায়ক অংশগুলির (মূল ও কাণ্ডের সংযোগস্থল এবং সংবহন কলা কোষ) যে অপূরণীয় ক্ষতিসাধন হয় তাতে ফসলের সমগ্র ক্ষতির পরিমাণ অন্যান্য রোগের চেয়ে বহুগুণ বেশি হয়।
মৃত্তিকা বাহিত রোগ সম্পর্কে জানা বা সচেতন হওয়া জরুরি কেন?
মৃত্তিকাবাহিত রোগগুলি ফসলে খুব কম হলেও প্রায় ৫০% অবধি ক্ষতি হয়ে থাকে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট উৎপাদন ঘাটতির ১০-২০ শতাংশ শুধুমাত্র মৃত্তিকাবাহিত রোগগুলির কারণে সংগঠিত হয়। সাম্প্রতিককালে ফসলের মৃত্তিকা বাহিত রোগজীবাণুগুলি চাষের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সব ধরনের মানুষের কাছে বিশেষ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা, একই ফসলের বারবার চাষ, কৃষিকাজে ক্রমবর্ধমান রাসায়নিক নির্ভরশীলতা ও কৃষির নিবিড়ায়ন মৃত্তিকাবাহিত রোগগুলির বাড়বাড়ন্তের অন্যতম কারণ। এখনই এই সব রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে আরও শোচনীয় অবস্থা প্রতক্ষ্য করতে হতে পারে। উপরন্তু বিভিন্ন জলবায়ুতে এদের বিস্ময়কর অভিযোজন ক্ষমতার জন্য এই জাতীয় রোগ সমস্যার প্রবন্ধণ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে।
আরও পড়ুন -Successful Farming: ব্ল্যাক রাইস চাষে ব্যাপক সাফল্য বিদেশফেরত যুবকের
মৃত্তিকাবাহিত রোগ সহজে প্রতিকার করা যায় না কেন?
১. মৃত্তিকাবাহিত রোগজীবাণুর প্রবন্ধণের জটিলতার কারণ হিসাবে বলা যায়, ফসলের জাতগুলির সহজাত প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব, রোগ জীবাণুগুলির উচ্চমাত্রার জিনগত অনবস্থতা, তাদের একাধিক উদ্ভিদ প্রজাতিকে আক্রমণ করার ক্ষমতা এবং এইসব রোগজীবাণুর মাটিতে সুদীর্ঘ উত্তরজীবিতা (Survival)।
২. মৃত্তিকা বাহিত রোগজীবাণুগুলি সাধারণত গুপ্তঘাতক। ফলে এদের উপস্থিতির লক্ষণ প্রকাশ পেতে প্রায়শই দেরি হয় এবং তখন প্রতিকার ব্যবস্থা স্বভাবতই বাণিজ্যিকভাবে সফল হয় না।
৩. মৃত্তিকাবাহিত রোগজীবাণুদের মধ্যে অতিরিক্ত মাত্রায় জীনগত বৈচিত্রের কারণে এইসব রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে সংবেদনশীল ফসলের প্রতিরোধী জাত উৎপাদন বেশ কঠিন হয়। উপরন্তু মৃত্তিকাবাহিত বিভিন্ন জীবাণু। যেমন, রাইজোক্টোনিয়া সোলানি, রালস্টোনিয়া সোলানেসেরিরাম, সক্লেরোসিয়াম রলফসি ও সক্লেরোটিনিয়া সক্লেরাসিওরাম উদ্ভিদ জগতের প্রায় ২৫টির বেশি পরিবারভুক্ত বিভিন্ন প্রজাতিতে (একবীজপত্রী ও দ্বিবীজপত্রী নিরপেক্ষভাবে) সংক্রমণ করতে পারে এবং মাটিতে সুপ্তদশায় বহুদিন বেঁচে থাকতে পারে। অনেক সময় পরজীবী মৃত্তিকা কৃমি মাটিতে বসবাসকারী রোগ জীবাণু যেমন ব্যাকটেরিয়া (রালস্টোনিয়া সোলানেসেরিয়াম) ও ছত্রাক (ফিউসেরিয়াম ইত্যাদি)-এর আক্রমণ বৃদ্ধি করে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে।
৪. কৃষিতে ক্রমবর্ধমান রাসায়নিক নির্ভরতা ও মাটির জৈবকার্বনের ঘাটতির ফলে মাটিতে বসবাসকারী উপকারী জীবাণুর সংখ্যা ক্রমশই কমে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ মৃত্তিকাবাহিত রোগজীবাণুর সংখ্যা কৃষিজমিতে ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৫. ফসল বৈচিত্রের অভাব ও একই জমিতে বারবার সমগোত্রীয় ফসলের চাষ মৃত্তিকাবাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
৬. কৃষকবন্ধুদের মধ্যে জৈব ছত্রাকনাশক ও তার ব্যাবহারবিধির সম্বন্ধে সম্যক ধারণার অভাব।
৭. বায়ুবাহিত রোগজীবাণুর গৌণ বিস্তার প্রতিরোধ করার চেয়ে মৃত্তিকা বাহিত রোগজীবাণুর গৌণ বিস্তার প্রতিরোধ করা অনেক বেশি কষ্টসাধ্য। কারণ, উদ্ভিদের পত্রসমষ্টিকে আরোগ্য-সহায়ক রাসায়নিক দিয়ে যত ভালভাবে ভেজানো যায় মাটিতে রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে আরোগ্য-সহায়ক রাসায়নিক প্রয়োগ ততটা সহজসাধ্য নয়। এই জন্যই আরোগ্য-সহায়ক-প্রতিকার ব্যবস্থা মৃত্তিকাবাহিত রোগজীবাণুর ক্ষেত্রে বাণিজ্যিকভাবে সফল হয় না।
৮. অনেক রোগজীবাণু পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যখন একই সঙ্গে সংক্রমণ ঘটায় তখন একটি যৌগিক রোগ জটিলতা সৃষ্টি হয়, যার শনাক্তকরণ, রোগনির্ণয় এবং নিয়ন্ত্রণ বেশ জটিল হয়ে ওঠে। যেমন, আদার রাইজোম পচা, পাটের ঢলে পড়া ইত্যাদি।
মাটিবাহিত জীবাণুর কিছু মাটিতে স্থায়ীভাবে, কিছু স্বল্পকাল বাস করে। আরও কিছু মাটির সহায়তায় হামলা আক্রমণ ঘটায়। সরষে বা বাঁধাকপির ‘শিকড় ফোলা’ রোগ জীবাণু প্লাসমোজিওফোরা, নানা সবজি ও ফুলের ‘চারাধসা’ ঘটানো পাইথিয়াম ও ফাইটফথোরা, নানা ফসলের ‘শিকড়, গোড়া ও কন্দে পচন’ ধরানো সক্লেরোটিনিয়া, সক্লেরোসিয়াম ও মাক্রোফোমিনা ছত্রাকগুলি অথবা বহু ফসলের ‘ঢলে পড়া’ সৃষ্টিকারী ছত্রাক ফিউসেরিয়াম, ভাটিসিলিয়াম ও ব্যাকটেরিয়া রালস্টোনিয়া জীবাণুগুলি ‘মাটিবাহিত’। এছাড়া আলুর ‘খোসরোগে’র কারণ স্ট্রেপটোমাইসেস এবং বহু সবজির ‘শিকড় ফোলা’ রোগসৃষ্টিকারী কৃমি জীবাণু-মেলয়ডোগাইনি, গ্লোবডেরা ও হেটারোডেরাও মাটিবাহিত।
মাটিবাহিত এই রোগজীবাণু নিয়ন্ত্রণ বেশ শক্ত। এই জীবাণুগুলি জিনগতভাবে পরিবর্তনক্ষম, বহু ফসলকে আক্রমণ করে। মাটিতে এরা স্বল্প থেকে বহুদিন টিকে থাকে প্রায় অদৃশ্য হয়ে। এদের অনেকের আক্রমণ টের পাওয়া যায় অনেক পরে। তাই নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ করতে দেরি হয়ে যায়। এই রোগগুলির প্রতিরোধী বা সহনশীল জাতও বেশ কম। রাসায়নিক বা অন্য নিয়ন্ত্রক এদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করাও বেশ কঠিন মাটিতে মিশে থাকার জন্য । আবার আদা ও ভুট্টার নরম পচা, পাটের হুগলি-ঢলে পড়া, পেয়ারার গাছ শুকানো প্রভৃতি ক্ষেত্রে একাধিক মাটিবাহিত জীবাণু রোগ সৃষ্টি করে, তাই নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। নিবিড় শস্যচাষে সারা বছরে জীবাণুগুলি একটা না একটা পোষক ফসল পেয়েই যায়। তাই এ ধরনের জীবাণুকে উৎখাত করা অতি কঠিন।
আরও পড়ুন -Muskmelon cultivation guide: জেনে নিন সহজ উপায়ে বাঙ্গি বা খরবুজা চাষের পদ্ধতি