কথায় আছে জলই জীবন। আমাদের শরীরের কোষের প্রোটোপ্লাজমের শতকরা ৬০-৯০ ভাগই জল, রক্তের ৯০-৯২ শতাংশ জল। মানবদেহের ওজনের ৬০-৭০ শতাংশ ভাগই হল জল। উদ্ভিদ দেহে কোষ থেকে কোষান্তরে বিভিন্ন অনুর ব্যাপন ও অভিস্রবন প্রধানত জলের সাহায্যেই ঘটে। সুতরাং এককথায় বলা যেতে পারে জীবদেহে জলের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু এখন কথাটা হল, এক কিলোগ্রাম ধান হতে লাগে প্রায় ৩৫০০ লিটার জল। সেখানে এক কিলোগ্রাম গম তৈরি হতে লাগে ১৩০০ লিটার জল। ভুট্টা, বাজরার মতন ফসল ফলাতে আরও কম জল লাগে। আর কিলোগ্রাম মাংস তৈরি করতে প্রায় ১৫,৫০০ লিটার জল লাগে। থালার পাশে যাতে জলভরা গেলাসটি থাকে, খাদ্যশস্য কিংবা পশুখাদ্যের জোগান ধরে রাখতে যদি হয়, তবে খাওয়ার পাতে বসেও ভাবতে হবে, কতটা জল গিয়েছে এই খাবার উৎপন্ন করতে। কথাটি যদি বিশ্বাস না হয়, তবে মনে করুন বছর খানেক আগে তেষ্টার জলের জন্য চেন্নাইবাসীদের লম্বা লাইন। এদিকে বিশ্বের মোট জল অপচয়ের ৮ শতাংশ অপচয় ঘটে আমাদের ভারতবর্ষে।
ভারতবর্ষে কৃষিকাজের জন্য যে পরিমাণ জলের প্রয়োজন তার ৬১.৬ শতাংশ জল আসে ভূ-গর্ভ থেকে, ২৪.৬ শতাংশ আসে খাল (Canal) থেকে এবং ১৩.৮ শতাংশ আসে অন্যান্য উৎস থেকে। কৃষিতে ভূ-গর্ভস্থ জলের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাংশে ভূ-গর্ভস্থ জলের প্রথম স্তর আগামী পনেরো বছরে ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর কারন যে সব অঞ্চলে চিরকাল গম, ভুট্টা, বাজরা জাতীয় কম পিপাসু ফসলের চাষ হত, সেখানে এখন ধান ও আখের চাষ হচ্ছে।
বর্তমান সময়ে ভারতবর্ষে জল লভ্যতার হিসাবঃ
ভারতবর্ষের মোট ভৌগলিক এলাকা ৩২৯ মিলিয়ন হেক্টর এবং বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমান প্রায় ১১৯৪ মিলিমিটার। অর্থাৎ ভারতবর্ষের মোট বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমান (৩২৯ মি.হে X ১১৯৪ মি.মি) ৩৯২ মিলিয়ন হেক্টর মিটার। তুষারপাত ও অন্যান্য উৎসগুলি ধরলে তা দাঁড়ায় ৪০০ মি.হে.মি। ভারতীয় সেচ কমিশনের তথ্যনুযায়ী এই ৪০০ মি.হে.মি বৃষ্টিপাতের মধ্যে ৭৫ শতাংশ বৃষ্টিপাত হয় দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু দ্বারা (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) এবং অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ বৃষ্টিপাত হয় বছরের অন্যান্য সময়ে। ৪০০ মি.হে.মি বৃষ্টিপাতের মধ্যে আবার ২১৫ মি.হে.মি জল মাটির ভিতরে প্রবেশ করে, (Infiltration) ১১৫ মি.হে.মি মাটির উপর দিয়ে যায় (Run off) ৭০ মি.হে.মি সঙ্গে সঙ্গে বাষ্পীভূত হয় যায় (Immediately evaporate)। যে ২১৫ মি.হে.মি জল মাটির ভিতরে প্রবেশ করে তার মধ্যে ১৬৫ মি.হে.মি জল মাটির ভিতরের আর্দ্রতা (Soil Moisture) বজায় রাখে এবং ৫০ মি.হে.মি জল ভু-গর্ভস্থ জল (Ground water) হিসাবে সঞ্চিত হয়। অতএব প্রতিবছর মোট বার্ষিক বৃষ্টিপাতের মধ্যে মাত্র ৫০ মি.হে.মি অর্থাৎ ১২.৫ শতাংশ জল ভূ-গর্ভে সঞ্চিত হয় । কেন্দ্রীয় জল কমিশনের (২০১৪) পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী ভূ-গর্ভ থেকে সংগৃহীত জলের মোট পরিমাণ ৩৯৮ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। এর মধ্যে কৃষি ও পানীয় জল হিসাবে ব্যবহৃত হয় ৮৯ শতাংশ, গৃহস্থলীর কাজের জন্য ৯ শতাংশ এবং শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় ২ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে ভারত অতি দ্রুত ভূগর্ভস্থ জল পর্যাপ্ত পরিমাণে না পাওয়ার সংকটে পড়তে চলেছে। তার প্রধান কারণ ভূগর্ভস্থ জলের অত্যধিক উত্তোলন এবং ভূগর্ভস্থ জলের মধ্যে দূষণ ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বৃদ্ধির জন্য। ভারতে মাটির উপর সঞ্চিত জলের পরিমাণ ও প্রবাহিত জলের পরিমাণ থেকে জল লভ্যতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি, তথাপি মানুষ ভূগর্ভস্থ জল বেশী ব্যবহার করে কারণ এটি তাদের আয়ত্তের মধ্যে। দিনে দিনে ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার করার প্রবণতা বাড়ছে এবং মাটির উপরিস্থ জল ব্যবহার করার প্রবণতা কমছে। বিশেষত সবুজ বিপ্লবের পর থেকে ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার করার প্রবণতা বেড়েছে। বিশেষত সরকারের কৃষি জলসেচ প্রকল্পের অধীনে চাষি ভাইদের জলসেচের জন্য অর্থ সাহায্য করা ও বিদ্যুৎ মাশুল হ্রাস করা এবং অপরিকল্পিত শহরায়ন ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহারকে অনিয়ন্ত্রিত করেছে।
জল সংরক্ষণের বিভিন্ন উপায়গুলি হলঃ
জলের অভাবের জন্য খাদ্যের অভাব দেখা দিতে পারে বিশ্বজুড়ে, বলছে একটি সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন। রাষ্ট্রপুঞ্জ বাহান্নটি দেশের একশো আট জন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে গড়েছিল জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক উপদেষ্টামণ্ডলী। ৮ ই অগস্ট, ২০১৯ প্রকাশিত প্রতিবেদনে তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এই প্রথম পৃথিবীর প্রধান খাদ্য উৎপাদক দেশগুলিতে একসঙ্গে জলাভাব হতে চলেছে। ফলে বিশ্বব্যাপী খ্যাদাভাব দেখা দিতে পারে। কোপ পড়বে গরিবের উপরেই বেশি। তবে এখনই যদি সব দেশ পূর্ণ উদ্যমে সচেষ্ট হয়, তবে জলসংকট রোখা যেতে পারে। বিদ্যুতে অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহার করতে আজ থেকে প্রাণপণ চেষ্টা করলেও কাজ হতে সময় লাগবে। অথচ ভারত-সহ সতেরোটি দেশে জলসংকট এখনই শুরু হয়ে গিয়েছে। অনেকে মনে করেন, ভারতের হাতে পাঁচ বছরের বেশি সময় নেই। যে কাজগুলো এখনই করতে হবে তা হল জলের সঞ্চয়, অপচয় থামানো, জলসৃজন ও ন্যায্য জলবণ্টন।
তবে তার কয়েকটা দীর্ঘমেয়াদি উপায় আছে, যেমন গাছ লাগানো। একটা-দুটো নয়, এক লক্ষ কোটি গাছ। বৃষ্টির জল সংরক্ষণের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে যেমন শিল্প এলাকাগুলিতে এবং নতুন তৈরি পাকাবাড়ীগুলিতে বৃষ্টির জল সংগ্রহের পরিকাঠামো বাধ্যতামূলক করতে হবে। পুকুর, হৃদ ও অন্যান্য জলাশয়ে জলসঞ্চয়ের যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে। জনগনকে সচেতন করাতে হবে ভুগর্ভস্থ জল সমস্যার আসন্ন বিপদগুলি সম্বন্ধে। প্রতিটি এলাকার জলস্তরের কথা চিন্তা করে নলকূপ বসানো বা কূপ খোঁড়ার অনুমতি সরকারকে দিতে হবে। পৃথিবীতে নোনাজলই বেশি। মিষ্টি জল মাত্র দুই শতাংশ, তারও বেশি খানিকটা দুই মেরুতে বরফ হয়ে আছে। স্রেফ ০.৫ শতাংশ ব্যবহারের যোগ্য। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের জল বাড়ছে, মিষ্টি জলের অনুপাত কমছে। তাই নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমুদ্রের জল নুনমুক্ত করে মিষ্টি জল বানাতে পারলে অভাব অনেকটা মেটে। ভারত সহ বেশ কিছু দেশে এই প্রযুক্তি আরম্ভ হয়েছে যেমন ইজরায়েল সৌরশক্তিতে জলের কারখানা চালায় এবং তা থেকে কৃষিকাজ সম্পন্ন হয়। জল সমস্যা সমাধানের প্রকল্পগুলি সবই ব্যয়সাপেক্ষ এবং পানীয় জলের জোগান বজায় রেখে যাওয়ার আর্থিক চাপ বহন করতে হবে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল নগরবাসীদের, যাতে গরিবরাও জল পান।
জল সংরক্ষণে কৃষক সমাজের ভূমিকা (The role of farming community in water conservation) -
জল লভ্যতার উপর ভিত্তি করে কোন কোন অঞ্চলে কি ধরনের শস্য পর্যায় এবং শস্য বিন্যাস তা নির্ধারণ করতে হবে। বৃষ্টিনির্ভর এলাকাতে ও শুষ্ক অঞ্চলে উদ্যান শস্য চাষের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। বিন্দু সেচ, ফোয়ারা সেচের ব্যবস্থাপনা করতে হবে যেখানে জলের অপচয় খুব ঘটে এবং খাল সেচের উপর কৃষক বন্ধুদের জোর দিতে হবে অথবা কৃষি ক্ষেতে পুকুর খনন করে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। যে সব শস্য চাষ করতে বেশি জল ব্যবহার হয় সেই শস্যগুলিকে নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকাতে চাষ করতে হবে এবং কৃষকদের দিনের বেলায় জলসেচ দিতে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করতে হবে, কৃষকেরা রাত্রিবেলা জলসেচ দিলে ভূ-গর্ভস্থ জল ও বিদ্যুৎ দুটোরই অপচয় ঘটে কারণ রাত্রিতে বিশেষ করে মধ্যরাত্রিতে কৃষকেরা পাম্প চালিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ফলে এই অপচয় ঘটে। কৃষিক্ষেত্রে স্বাভাবিক দীর্ঘমেয়াদি সমাধান ছিল সুসংহত সামাজিক জল বিভাজিকা উন্নয়ন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বৃষ্টির জল মাটিতে ধরে রাখা ও ভূ-গর্ভস্থ জলস্তর বৃদ্ধির জন্য বনসৃজনের প্রয়োজনীয়তার প্রচারে বা রুপায়নে অল্পবিস্তর আলোচনা বা পদক্ষেপের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। তাই এই আশু বিপদ থেকে রক্ষার উপায় হল সুসংহত সামাজিক জল বিভাজিকা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
আমরা যেমন ব্যাঙ্কে টাকা জমা রাখি আর সেই টাকার যদি বিশেষ প্রয়োজন হয় তবেই আমরা সেই টাকা তুলি না হলে এদিক ওদিক থেকে ব্যবস্থা করে নিই, ঠিক একইভাবে ভূগর্ভস্থ জল সঞ্চয়, ব্যাঙ্কে সঞ্চিত অর্থের ন্যায় নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া সেই জল উত্তোলন করা উচিত নয়। এই বোধ যদি প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে প্রোথিত হয় তাহলে দেখা যাবে যে ভূ-গর্ভস্থ ব্যাঙ্কের সঞ্চিত টাকা কখনো শেষ হবে না অর্থাৎ পৃথিবী থেকে মানব সভ্যতার কখনো বিনাশ হবে না।
নিবন্ধ লেখক - শ্রী তরুণ সরকার, বিষয়বস্তু বিশেষজ্ঞ (শস্যবিজ্ঞান), পূর্ব মেদিনীপুর কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্র
Image Source - Google
Related Link - রাজ্যের মানুষের জন্য নতুন প্রকল্প 'জলস্বপ্ন' (Jalswapna- A new project) – রাজ্যে তৈরী হতে চলেছে কর্মসংস্থান
কৃষকদের ফসলের বীমা (crop insurance) করার জন্য দিতে হবে না আর কোন অর্থ – সরকার করবে পূর্ণ সহায়তা