আধুনিক কৃষি যান্ত্রিকরনের পাশাপাশি ধীরে ধীরে নিবিড় চাষ আবাদের প্রতি বেশি ধাবিত হচ্ছে। কৃষিকে যদি পরিকল্পনা মাফিক বাণিজ্যিকরণ-এর দিকে এগিয়ে দেওয়া না যায় তবে চাষী চিরকাল অবাঞ্ছিত থেকেই যাবে।
আমাদের দেশে সেচ ও অসেচযুক্ত এলাকাগুলোতে এখন বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের চাষ আবাদ হচ্ছে। একই জমিতে বছরের বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ধরনের(Crop Rotation) চাষকে ফসলচক্র বলা হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে জমির উর্বরতার মান ঠিক রেখে ভূমিক্ষয় রোধ করা ও এর পাশাপাশি জমিতে জৈবের পরিমান ঠিক রেখে রোগ ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ আগাছা দমন করা ইত্যাদি।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্যের তাগিদে শস্য উত্পাদন বৃদ্ধিও একান্ত আবশ্যক এবং সুস্থায়ী কৃষিতে (Sustainable Farming) ফসল উত্পাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হল শস্য আবর্তন। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা গেছে, গ্রামীণ অঞ্চলের পরিবারগুলির মধ্যে এখনও ৭০ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল এবং তাদের মধ্যে ৮২ শতাংশ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী। সুতরাং কৃষিক্ষেত্রে তো নিযুক্ত রয়েছেন অনেকেই, কিন্তু শস্য আবর্তন –এর বিষয়ে কতটা ওয়াকিবহাল আমাদের প্রান্তিক কৃষকবন্ধুরা ? জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, কৃষকরা যদি ফসল সুরক্ষার পদ্ধতিগুলি প্রয়োগ করা বন্ধ করে দেয়, তবে শস্যে কীটপতঙ্গ এবং রোগ-পোকার আক্রমণের কারণে অবিলম্বে তাদের ফসলের উৎপাদন প্রায় ৪০ শতাংশ হ্রাস পাবে। সম্প্রতি বায়োসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা থেকে জানা গেছে যে, সামগ্রিক খাদ্য উত্পাদন ২০৫০ সালের মধ্যে ২৫-৭০% বৃদ্ধির প্রয়োজন। কারণ বর্তমান অবস্থা অনুযায়ী প্রায় ২.২ বিলিয়ন মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাবার রয়েছে। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি জরুরী অবশ্যই, কিন্তু মাতৃস্বরূপা জমির উপর অত্যাচার না করে সঠিক পদ্ধতিতে শস্য সুরক্ষার বিষয়টিতে মনোনিবেশ করতে হবে।
ক্রপ রোটেশন শস্য পরিচর্যার অপর একটি দিক। বারংবার একই শস্য জমিতে আবাদ করলে সেই মাটির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়। জলবায়ু এবং মাটির অবস্থা বুঝে কৃষকদের বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ করতে হবে। প্রায় ৭০% পরিষ্কার জল বিশ্বজুড়ে কৃষি প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। সর্বোপরি, মাটির আর্দ্রতার স্তরটি উদ্ভিদের স্বাস্থ্য এবং সর্বাধিক ফসল বজায় রাখার মূল চাবিকাঠি। স্বাভাবিকভাবেই মাটির উর্বরতা, আর্দ্রতা স্তর, সেচ ব্যবস্থা, রাসায়নিক কৃষিবিষের ব্যবহার কমিয়ে জৈব কীটনাশক ব্যবহার- এ সকল দিকই কৃষককে মনে রাখতে হবে।
আরও পড়ুন - জৈব উপায়ে ফসলের রোগ পোকা নিয়ন্ত্রণ করবেন কিভাবে, জানালেন কৃষি অধিকর্তা
ফসলচক্রের কিছু নিয়ম -
১. একই ধরনের (গোত্রের) ফসল একই জমিতে পর পর চাষ করা উচিৎ নয়। উদাহরণ - ধান(তন্ডুল জাতীয়) চাষের পর ডালের চাষ(শিম্ব জাতীয়) ফসল চাষ করা আবশ্যক। এটি করলে ফসলের রোগ ব্যাধি কমবে।
২. জমিতে বরবটি, ধঞ্চে, লুশান ইত্যাদি ফসলকে সবুজ সার হিসেবে জমিতে ব্যবহার করতে হবে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে জমিতে নাইট্রোজেন ও জৈব পদার্থ বৃদ্ধি।
৩. বেশি সার প্রয়োগ করা হয় এমন চাষের পর কম সার গ্রহণকারী ফসলের চাষ করতে হবে। উদাহরণ - ধানের পর শশা, কিংবা আলুর পর কুমড়ো।
৪. যেসব ফসল ফলতে বেশি সময় নেয় তারপর কম সময় যুক্ত ফসল চাষ করতে হবে। (যেমন : ধান, সর্ষে, তিল)
৫. ঢালু জমিতে যেমন ভূমিক্ষয়কারী ফসল যেমন ভুট্টা চাষ করার পর ডাল চাষ করা উচিৎ।
৬. আদর্শ ফসলচক্রে খামারের জমি, মজুর, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সকল কৃষি উপকরণের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা বাঞ্চনীয়।
পরিশেষে বলা যায়, পরিবেশ দূষণ ও চাষের পদ্ধতির ক্রমবিবর্তনে বাংলার কৃষি জমির পরিবর্তন ঘটেছে। অনির্বচনীয়ভাবে রাসায়নিকের প্রয়োগে ফসল উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও শস্য হারিয়েছে তার পুষ্টিগুণ। এর কারণ অবশ্যই জনবিস্ফোরণ, নগরায়ন ও শিল্পায়ন। কিন্তু ফসলের পুষ্টিগুণ বজায় রেখে ন্যূনতম অপচয়ে উচ্চমানের ফসল উৎপাদন করা এবং শস্য আবর্তন, তার পরিচর্যা ও তার সুরক্ষা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এর জন্য রাসায়নিকের ব্যবহারের পরিমাণ যতটা সম্ভব কমিয়ে ফসল উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে জৈব প্রযুক্তি। এতে রাসায়নিক প্রয়োগের তুলনায় অপেক্ষাকৃত খরচ একটু বেশী এবং উৎপাদন সামান্য কম হলেও তা মানুষের এবং প্রাণীর স্বাস্থ্যে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করবে না। শুধু আমাদের কৃষক বন্ধুদের সচেতন করতে হবে, বর্তমানে অধিক মাত্রায় রাসায়নিক প্রয়োগে উচ্চ ফলনের আকাঙ্খা ত্যাগ করে ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তার দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে।
আরও পড়ুন - বর্তমান যুগের লাভজনক চাষ কীভাবে করবেন?