দ্রুত নগরায়ন এবং শিল্পায়নের ফলে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ক্রমাগত সংকোচিত হতে শুরু করেছে এবং এর সাথে চিরাচরিত পদ্ধতিতে চাষ পরিবেশের উপর অনেক ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করে। পৃথিবীর বাড়তে থাকা জনসংখ্যাকে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ করতে হলে, আমাদের পরিবেশবান্ধব খাদ্য উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হবে। আমাদের এমন পদ্ধতির উদ্ভব করতে হবে, যার মাধ্যমে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থাৎ জল এবং চাষযোগ্য ভূমির সংরক্ষণ করতে পারি। মাটি ছাড়া চাষ (Soil-less cultivation) পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা সাফল্যের সাথে পরিবেশবান্ধব এবং পুষ্টিকর ফসল পেতে পারি। বিগত কয়েক বছরে বিভিন্ন পদ্ধতি যেমন, হাইড্রোপনিক্স, অ্যাকোয়াপনিক্স এবং অ্যারোপনিক্স বিকল্প চাষ পদ্ধতি হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
আজ আমরা এই প্রবন্ধে আলোচনা করব হাইড্রোপনিক চাষের সুবিধা সম্পর্কে। চলুন দেখে নেওয়া যাক, কেন এই পদ্ধতিতে চাষ করব।
মৃত্তিকা ভিত্তিক চাষের তুলনায় হাইড্রোপনিক চাষের সুবিধা (Advantages of hydroponic cultivation as compared to soil based cultivation) :
১. হাইড্রোপনিক চাষের ক্ষেত্রে মাধ্যমগুলিকে জীবাণুমুক্ত করতে অনেক কম সময় লাগে এবং কিছু সাধারন ধোঁয়া উৎপাদনকারী রসায়নের দ্বারা খুব কম সময়ে তাদের জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব।
২. অনেক কম জায়গায় অনেক বেশি পরিমাণ গাছ লাগানো সম্ভব, তার ফলে প্রতি একক জায়গায় গাছের ফলন অনেক বৃদ্ধি পায়।
৩. এই ধরণের চাষ পদ্ধতিতে কোনরকম আগাছা সমস্যা হয় না। এর ফলে আগাছা পরিষ্কার করার জন্যে প্রয়োজনীয় শ্রমিক এবং ক্ষতিকারক আগাছা-নাশক রসায়নের ব্যবহার বন্ধ হয়। এর ফলে চাষের খরচ অনেকটা কমে যায়।
৪. চিরাচরিত ফসল চাষ পদ্ধতির মধ্যে অনেক ধরণের মৃত্তিকা থেকে জন্ম নেওয়া রোগ-বালাই, পোকামাকড়ের উপদ্রব হয়। কিন্তু হাইড্রোপনিক চাষের ক্ষেত্রে এ ধরণের কোনো সমস্যা দেখা যায় না। তার ফলে কোন নির্দিষ্ট ধরণের শস্য-চক্র/ ফসল-চক্র মেনে চলার প্রয়োজন নেই।
৫. হাইড্রোপনিক চাষ পদ্ধতির ক্ষেত্রে, উদ্ভিদের কোন প্রকার জলের ঘাটতি দেখা যায় না। সাধারণত উদ্ভিদের শিকড়ের কাছাকাছি আদ্রতা পরিমাপক সেন্সর লাগানো থাকে এবং পুরো প্রক্রিয়াটি স্বয়ংক্রিয় ভাবে কম্পিউটার দ্বারা পরিচালিত হয়। এর ফলে যেমন শ্রম নির্ভরতা কমে, তেমনি জলের ব্যবহারজনিত কার্যকরিতা অনেক বৃদ্ধি পায়। গাছের শিকড়ের বাইরে জলের অপচয় একেবারেই হয় না, তেমনি পৃষ্ঠতল থেকেও বাষ্পীভূত হয়ে জলের অপচয় রোধ হয়।
৬. এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফল বেশ শক্তপোক্ত হয় এবং এদের স্থায়িত্বকাল বৃদ্ধি পায়। কিছু পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, মাটিতে চাষ করা টমেটোর তুলনায়, হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত টমেটোর মধ্যে 'ভিটামিন A' এর আধিক্য রয়েছে।
৭. চিরাচরিত পদ্ধতিতে চাষাবাদের সময় দেখা গিয়েছে, যে পরিমাণ সার আমরা গাছের গোড়ায় দিই, তার ৫০-৮০ শতাংশই চুইয়ে মাটির তলায় চলে যায়। অর্থাৎ, এই বিপুল পরিমাণ সার গাছের তেমন কোন কাজে লাগেনা এবং অপচয় হয়। এই সার নিচে গিয়ে ভূগর্ভের জলস্তরকেও দূষিত করে। কিন্তু হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে, খুব অল্প পরিমাণে সার লাগে এবং তার সমপরিমাণ প্রত্যেকটি গাছের শেকড়ের কাছে পৌঁছে যায়। এর ফলে সারের কার্যকারিতা অনেক বৃদ্ধি পায়।
৮. নতুন করে চারা লাগানোর সময় মাটিতে অনেক চারা গাছ মারা যায়। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চারাগাছ গুলির কোনরকম ধকল হয় না এবং তারা খুব সহজেই নতুন পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে।
৯. এটা দেখা গিয়েছে হাইড্রোপনিক চাষে গাছে অনেক দ্রুত ফলন পাওয়া যায়। ফসল অনেক জলদি পরিপক্ক হয়ে ওঠে। এর ফলে খুব সহজে জলদি বাজারজাত করা সম্ভব হয়। চাষিরা এতে বাজারদরও ভাল পেয়ে থাকেন।
১০. আপনি যদি পলি হাউস অথবা গ্রিন হাউসে চাষ করেন, তাহলে কয়েক বছর পর আপনাকে মাটি পুরোপুরি পরিবর্তন করতে হতে পারে। কারণ ওই অল্প জায়গার মধ্যে অনেক গাছ লাগানোর ফলে মাটির উর্বরা শক্তি এবং গঠন খুব সহজেই নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু, হাইড্রোপনিক্স এর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত মাধ্যমগুলি যেমন নুড়ি পাথর, বালি এগুলি পরিবর্তন করার খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। বারবার জীবাণুমুক্ত করার জন্যে ক্ষতিকারক রসায়ন ব্যাবহার করতে হয়না।
১১. চিরাচরিত চাষের তুলনায়, হাইড্রোপনিক চাষে ফলন অনেক বেশি হয়। যেমন, আপনি গ্রিন হাউসের ভেতরে টমেটো চাষ করলে গাছ প্রতি ৮-১০ কেজি প্রতি বছর ফলন মেলে। একই টমেটো, আপনি হাইড্রোপনিক পদ্ধতির মাধ্যমে করলে গাছ প্রতি ২৫-৩০ কেজি প্রতিবছর ফলন পাওয়া সম্ভব। এমনকি এটাও দেখা গিয়েছে, নেদারল্যান্ডে এক একটি গ্রিন হাউসে হাইড্রোপনিক পদ্ধতির মাধ্যমে চাষ করে একটি গাছ থেকে প্রায় ৭০ কেজি টমেটোর ফলন পাওয়া গিয়েছে।
১২. হাইড্রোপনিক চাষ পদ্ধতি চাষযোগ্য জমির উপর নির্ভর করে না। হাইড্রোপনিক ফার্ম বাজার এর কাছে তৈরি করা যেতে পারে এবং সেখান থেকেই আপনার ফসল আপনি বিক্রি করতে পারেন। এভাবে আপনি পরিবহনের খরচ এবং বায়ু দূষণ কমাতে পারেন।
১৩. যেহেতু হাইড্রোপনিক ফসল ঘরের ভেতর করা হয়, তাই ফসলের উপর আবহাওয়া খুব একটা নিয়ন্ত্রণ নেই। আপনি সারা বছর ফসল চাষ করতে পারেন।
হাইড্রোপনিক চাষের ভবিষ্যৎ (The future of hydroponic farming) -
আমাদের দেশে অর্থাৎ ভারতে যেসব এলাকায় মাটির গুণগত মান খুবই কম কিন্তু জলের প্রাচুর্য রয়েছে, সেখানে আমরা হাইড্রোপনিক চাষ শুরু করতে পারি। বর্তমানে আমাদের দেশের কিছু বড় শহর যেমন দিল্লি, চন্ডিগড়, নয়ডা এবং ব্যাঙ্গালোরে মানুষেরা বাড়ির ছাদে এবং ব্যালকনিতে হাইড্রোপনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে শাকসবজি এবং মশলা উৎপাদন করছেন। আমাদের দেশেও আগামী দিনে হাইড্রোপনিক চাষের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। অনেকেই নিজেদের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে বেরিয়ে এসে হাইড্রোপনিক চাষের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করছেন এবং বাণিজ্যিক আকারে নিজেদের ব্যাবসা শুরু করেছে। আমাদের দেশে অর্থাৎ ভারতে যেসব এলাকায় মাটির গুণগত মান খুবই কম কিন্তু জলের প্রাচুর্য রয়েছে, সেখানে আমরা হাইড্রোপনিক চাষ শুরু করতে পারি। বর্তমানে আমাদের দেশের কিছু বড় শহর যেমন দিল্লি, চন্ডিগড়, নয়ডা এবং ব্যাঙ্গালোরে মানুষেরা বাড়ির ছাদে এবং ব্যালকনিতে হাইড্রোপনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে শাকসবজি এবং মশলা উৎপাদন করছেন। আমাদের দেশেও আগামী দিনে হাইড্রোপনিক চাষের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। অনেকেই নিজেদের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে বেরিয়ে এসে হাইড্রোপনিক চাষের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করছেন এবং বাণিজ্যিক আকারে নিজেদের ব্যাবসা শুরু করেছে।