ডঃ প্রতাপ মুখোপাধ্যায়ঃ অ্যাকোযাপনিক্স নামের একটি মিশ্র শব্দচয়ন হয়েছিল সত্তরের দশকে-যার নাম আবার নতুনভাবে শোনা যাচ্ছে ইদানিং। খাদ্য উৎপাদনের দুটি স্তম্ভ –অ্যাকোয়াকালচার ও হাইড্রোপনিক্স-এর একত্রীকরণে, জলের পুর্নব্যবহারের মাধ্যমে সমন্বিত প্রযুক্তিতে কিছু মাছ ও সাধারণ শাক-সবজির ফলন সারা বছরই সম্ভব হতে পারে।এর দুটি ইউনিটের প্রথমটি অ্যাকোয়ারিয়াম কিংবা ফাইবার গ্লাস ট্যাঙ্কে- যেখানে মাছ থাকবে যথারীতি ও স্বাভাবিক ভাবেই। বাইরে থেকে যোগান দেওয়া হবে অক্সিজেন ও সরু পেলেটযুক্ত বা দানা খাবার। এই জল( যার সাথে মিশে থাকবে মাছের দেহ নিঃসৃত অ্যামোনিয়া), বায়োফিল্টারের / নুড়ি-পাথরে জন্মানো বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া – নাইট্রোসোমোনাস,নাইট্রোব্যারটার-এর ক্রিয়ার সাহায্যে নাইট্রেট রূপান্তরিত হয়ে মাছের জলজ পরিবেশকে কলুষমুক্ত রাখবে আর শুধু তাই নয় এই নাইট্রেট ও পুষ্টি সমৃদ্ধ জল দ্বিতীয় ইউনিটে রাখা ট্যাঙ্কে বিভিন্ন উদ্ভিদ তাদের শিকড়ের সাহায্যে নাইট্রেট নাইট্রোজেনকে কাজে লাগিয়ে বেড়ে উঠবে ক্রমশই।আবার উল্লেখযোগ্যভাবে অ্যাকোয়ারিয়ামে রাখা রঙীন বা খাদ্যোপযোগী যে মাছেই থাক না কেন সেখানে বাইরে থেকে সরবরাহ করা উদ্ভিদজাত উৎপাদনে তৈরী খাবার উপস্থিত ফসফরাসের প্রায় সবটুকুই মাছ শরীর থেকে নিঃসৃত করে দিয়ে থাকে।
যেহেতু এই ফসফরাস থেকে ফাইটেট আকারে আর মাছ তার আত্মীকরণ করতে পারে না, কারণ তার প্রয়োজনীয় উৎসেচক ফাইটেস থাকে না বলে- অর্থাৎ জলে নাইট্রেটের সাথে ফসফরাসেরও প্রাচুর্যও থেকে যায়। জলে পটাসিয়াম সাধারনত থাকেই-তাই তিনটি পুষ্টিমৌল N,P এবং K এই জলে সব সময় পাওয়া যায়। এই সমৃদ্ধ জল হয়ত বা কিঞ্চিত ফিল্টার করে বা ক্ল্যারিফিকেশনের সাহায্যে (ভাসমান বা তলায় জমে থাকা কণাগুলিকে মুক্ত করার জন্য) পুর্নব্যবহার করা যায় শাক-সবজি ফলনে তা ট্যাংকের মাধ্যমে আবার অ্যাকোয়ারিয়ামে ফিরিয়ে আনে। সাধারণ বাষ্পীভবন ইত্যাদির কারণে জলের পরিমাণ একটু কম হয়ে গেলে বাইরে থেকে প্রতি সপ্তাহে একটু জল যোগ করে নিতে পারলে মাটির অনুপস্থিতিতেই শাক-সবজি ও সেই সাথে মাছের ফলনের জৈব উপাদান পদ্ধতিই হল অ্যাকোয়াপনিক্স প্রযুক্তির মূল কথা।
আরও পড়ুনঃ এই জাতের মহিষ 700 থেকে 1200 লিটার দুধ দেয়, যা দুধ উৎপাদনকারীদের জন্য বাম্পার আয়
ছোট আকারের কিছু মাছ নিয়ে শুরু করা যেতে পারে এই সমন্বিত চাষ পদ্ধতি। এমন মাছ যাদের তাপমাত্রা ওঠা নামা কিছুটা হলেও অসুবিধা হবে না, জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন কম থাকলেও চলবে, খাদ্যের ব্যাপারে বাছ-বিচার নেই অথচ বাড়-বৃদ্ধির হার বেশ ভালো, বিভিন্ন উদ্ভিদকণা, প্রাণীকণা, অ্যাজোলা জাতীয় সবুজ শৈবাল কিছু পোকামাকড়ের শূককীটও খেতে পারে-এমন একটি মাছ হল তেলাপিয়া। (উন্নত মানের পোনা এখন সর্বত্র পাওয়া যায়।) এছাড়া আরও বেশ কিছু মাছের কথা ভাবা যেতে পারে- খলসে, সরপুঁটি, বাটা ইত্যাদি। যে সমস্ত শাক-সবজি সহজেই উপাদান করা যায় তার মধ্যে পালং, শুশনি, লেটুস, পুদিনা কুলেখাড়া, ধনেপাতা ইত্যাদির নাম করা যেতে পারে।
সুন্দরভাবে এই প্রযুক্তি প্রয়োগে যে মাছ ও সবজির ফলন সম্ভব তা আমাদের শহরেই পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা সফলতার সঙ্গে দেখিয়েছেন। সঙ্গে দেওয়া ছবিগুলিতে কিছু নির্দেশন রইল।
আরও পড়ুনঃ Profitable Fish Farming: মাছ চাষের অভিনব পদ্ধতি,শিখে নিলে লাভ হবে দ্বিগুন
ব্যবস্থাপনাতে বিশেষ সমস্যা নেই। জলের pH ও দ্রবীভূত অক্সিজেন নিয়মিত দেখে নিতে পারলে ভালো হয়। জলের আয়তন কমে গেলে বাইরে থেকে জল যোগ করা দরকার। কর্পোরেশন/মিউনিসিপালিটির জলে ক্লোরিন ক্লোরামিন থাকতে পারে, সেই কারণে এই জল না দেওয়াই শ্রেয়। পি এইচ ৭.০ এর সামান্য(৭.২-৭.৮)- কোন কারনে- মূলত ব্যাকটেরিয়ার ক্রিয়াকলাপে তা কিছুটা কমতে পারে। তাই চুনের জল পরিমিতি পরিমাণ প্রয়োগেই পিএইচ পুনরুদ্ধার সম্ভব। এরেটর পাম্পের সাহায্যে অক্সিজেন যোগান থাকলে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাপমাত্রা বাড়লে যেহেতু জলের অক্সিজেন কমতে পারে, তাই অক্সিজেনের ব্যবস্থা রাখা নেহাতই দরকার।
একটি ছোট আকারের যদি আমরা করতে পারি ছাদ-বাগান বা পুষ্টি বাগানের আদলে-অন্তত এটুকু বলা যায় একটি পরিবারের সকলের পক্ষেই আনন্দ ও শিক্ষার এক সম্ভার ছাড়াও ঘরোয়া প্রয়োজনের কিছু শাক-সবজি- তা পুঁই,পালং,ধনেপাতা,লেটুস ছাড়াও কিছু দেশিয় ছোট মাছ অন্তত পরিবারের অনুপুষ্টি এর যোগান নিশ্চিত করতে পারে। মাছ-গাছ-ব্যাকটেরিয়া-জল-বাতাসের সমন্বয় গড়ে তোলা যেতে পারে এরকম অ্যাকোয়াপনিক্স- যা ছোটদের উৎসাহিত করবে আগামী দিনে পুষ্টি সমৃদ্ধ জৈব উৎপাদনের ফলন ফলাতে, জলের অপচয় রোধ করতে, চাষে ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার বন্ধ করতে এবং সর্বোপরি নিরাপদ খাদ্য সুনিশ্চিত করতে