কম্পোজিট ফিশ ফার্মিং এর সাথে কিছু সাথী ফসল হিসেবে মাছের মিশ্রচাষ করলে মাছ চাষিরা বাড়তি লাভ পেতে পারেন। বৈচিত্র্য ময় মিশ্রচাষে একদিকে যেমন মাছের উৎপাদন বাড়ানো যায়, তেমনি নিত্য নতুন মাছের স্বাদ পাওয়া যায়।
জলাশয়ের সার্বিক উৎপাদন বাড়াতে এই মাছ গুলি কার্প জাতীয় মাছ গুলির পাশাপাশি মিশ্র চাষে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। বেশ কিছু প্রগতিশীল মাছ চাষি হাতে কলমে এই সব মাছের চাষ করেছেন। আর্থিকলাভে মাছ চাষিরা হাতে নাতে তার প্রমানও পেয়েছেন। সাথী ফসল হিসেবে লাভজনক কয়েকটি মাছের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এই লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করা হল।
মাছের নাম - আমুর কার্প
অতিরিক্ত চর্বি, মেদ ঝরিয়ে এক্কেবারে স্লিম হয়ে নতুন চেহারায় ফিরে এসেছে এই কমন কার্প বা আমেরিকান রুইয়ের নতুন নাম হয়েছে আমুর কার্প ( a new breed of Common Carp )। বর্তমান কমন কার্প বা আমেরিকান রুইয়ের অসুবিধে গুলি হল- এরা দ্রুত যৌন পরিপক্কতা পায় (<৬ মাস) ও বাজারযোগ্য আকার অর্জন করার আগে লালন পুকুরে ডিম ছেড়ে ফেলার ফলে সংখ্যা বেড়ে যায়, খাদ্য ও বাসস্থানের অভাব হয়, আর তার জন্য এদের বৃদ্ধি ভালো হয়না। এই সমস্যার জন্য বিজ্ঞানীরা দ্রুত বৃদ্ধি হার এবং বিলম্বিত পরিপক্কতা সম্পন্ন উন্নত জাতের কমন কার্প তৈরী করার চেষ্টা করে এই আমুর মাছ তৈরী করেছেন। পুকুরের নিচের তলার মাছ (যেমন মৃগেল) কম ছেড়ে বা বন্ধ রেখে এই মাছের মিশ্রচাষ অত্যন্ত লাভ জনক।
মাছের নাম - সরপুঁটি মাছ
সরপুঁটি খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। এটি বেশ শক্ত প্রকৃতির অধিক ফলনশীল মাছ। প্রতিকূল পরিবেশে কম অক্সিজেনযুক্ত বেশি তাপমাত্রার জলেও এ মাছ বেঁচে থাকতে পারে। সরপুঁটি রুই জাতীয় মাছের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম খরচে, কম সময়েও সহজতর ব্যবস্থাপনায় বেশি উৎপাদন পাওয়া সম্ভব। মিশ্র চাষ পদ্ধতিতে উন্নত প্রজাতির মাছের সঙ্গেও অত্যন্ত সফলভাবে এ মাছ চাষ করা যায়। ছয় মাসে একটি সরপুঁটির পোনা গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম ওজনে উন্নীত হয়ে থাকে। একই পুকুরে বছরে দুইবার এ মাছের চাষ করা যায়।
মাছের নাম - মুক্তোগাছা
এটি কেরালার রাজ্য মাছ কারিমীন। ইংরেজী নাম পার্ল স্পট বা গ্রীন ক্রোমিড। মিঠাজল ও উপকূলবর্তী নোনাজলে চাষ করা যায়। এরা সর্বভুক, প্রধানত পচা জৈব বর্জ্য, জলজ শৈবাল ও উদ্ভিদ খায়। ৮-১০ মাসের সময়ের মধ্যে একটি মাছ ১২০-১৫০ গ্রাম হয়ে যায়, অর্থাৎ বাজারযোগ্য আকার অর্জন করতে পারে। পার্ল স্পট এর মিশ্রচাষ করা যায়, যা এই মাছ চাষিদের জন্য অতিরিক্ত আয় প্রদান করতে পারে। এটি একটি কম চর্বি, উচ্চ প্রোটিন খাদ্য, ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ, যা আমাদের হৃদয় ও মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখে।
মাছের নামঃ জয়ন্তী রুই
জয়ন্তী রুই প্রথম উৎপাদন করে ভুবনেশ্বরের সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ফ্রেশওয়াটার অ্যাকোয়াকালচার (আইসিএআর)। নরওয়ের গবেষণা সংস্থার কারিগরি সহায়তায় ভুবনেশ্বরের সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ফ্রেশওয়াটার অ্যাকোয়াকালচার (আইসিএআর) -এর বিজ্ঞানীরা ওই জয়ন্তী রুই-এর জন্ম দিয়েছে। জয়ন্তী রুইয়ের বৃদ্ধির হারও অনেক বেশি। সাধারণ রুই-এর থেকে জয়ন্তী রুই-এর পচনশীলতাও অনেকটা কম। জয়ন্তী রুই-এর রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বেশী এই প্রজাতির রুই দেখতেও বেশ ভাল। দেশি রুই-এর গায়ের রং কালচে লাল। অন্যদিকে জয়ন্তী রুই হালকা লালচে সাদা রঙের। চকচক করে। জয়ন্তী রুই মাছের ডিমপোনার চাষে বাঁচার হার বেশী। সাধারণত সাধারণ রুই-এর ১০০টি ডিমপোনার মধ্যে ৪০% বাঁচে। জয়ন্তী রুই-এর ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটা ৬০-৬৫%। জয়ন্তী রুই-এর চাষ লাভজনক ও খাদ্য হিসেবে সুস্বাদু।
আরও পড়ুন - জয়ন্তী রুই – রুই মাছ চাষের এক নতুন প্রজাতি, চাষে দ্বিগুণ লাভবান কৃষক
মাছের নাম - মিল্ক ফিশ
ফিলিপাইনের জাতীয় মাছ। নাম চ্যানস চ্যানস বা মিল্ক ফিশ। এই মাছ আবার ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ানেও দারুণ জনপ্রিয়। এ দেশের দক্ষিণ ভারতেও মেলে। ‘ডেকান হিলশা’ বা ‘দাক্ষিণাত্যের ইলিশ’ হিসেবেই পরিচিত।
প্রশান্ত মহাসাগরের বাসিন্দা এই চ্যানস চ্যানসের স্বাদের সঙ্গে ইলিশের নাকি আচরণেও মিল আছে। ইলিশের মতো চ্যানস চ্যানসও ঝাঁক বেঁধে ঘোরে। ইলিশের মতোই ডিম পাড়ার সময়ে দলবেঁধে মোহনার দিকে বা অপেক্ষাকৃত মিষ্টি জলে চলে আসে চ্যানস চ্যানস। ফলে স্বভাবগত দিক দিয়ে ইলিশের সঙ্গে অনেকটাই মিল রয়েছে চ্যানস চ্যানস বা মিল্ক ফিশের। তার উপরে ইলিশের মতো চ্যানস চ্যানসেও যথেষ্ট কাঁটা রয়েছে।
এই মাছ মিষ্টি জলেও চাষ করা যায়। তবে সে ক্ষেত্রে এর আকার একটু ছোট হয়। আঁশ এবং কাঁটাযুক্ত এই মাছের খাদ্যগুণও অনেকটাই বলে দাবি বিজ্ঞানীদের।
মিল্ক ফিশ শাকাহারী মাছ। জলাশয়ের তলদেশে জন্মানো শৈবাল, ল্যাব-ল্যাব খেয়ে এরা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। নোনাজলে লবণের পরিমাণ কমবেশি হলে তা সহজেই সহ্য করে নিতে পারে এই প্রজাতির মাছ। সেই কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশে এই মাছের বেঁচে থাকার হারও বেশি। চাষের পুকুরে কম প্রোটিনযুক্ত খাবার দানা খাদ্য গ্রহন করে। ছয় মাসের চাষে বাজারজাত করণের উপযুক্ত ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন লাভ করে। ইলিশের মতোই দেখতে ও দেহে কাঁটার বিন্যাস থাকার জন্য এদের “দাক্ষিণাত্যের ইলিশ” হিসাবে গণ্য করা হয়।
১-২ সেন্টিমিটারের ধানীপোনা প্রতি বর্গ মিটারে ২০-৩০ পিস হিসাবে মজুত করা হয়। পুকুরের তলদেশে জন্মানো শৈবাল, ল্যাব ল্যাব এরা খাদ্য হিসাবে গ্রহন করে। এই ধানীপোনা ৪-৬ সপ্তাহে ৫-৮ সেমি আকারের আঙুলে পোনায় পরিণত হয়, যেগুলি চাষের পুকুরে ছাড়ার উপযুক্ত।
৪-৬ মাসে , এই মাছ ৪০০-৫০০গ্রাম ওজন হয় ও ৪-৪.৫ টন/হেক্টর উৎপাদন পাওয়া যায়। টানা জাল বা ফাঁস জালের দ্বারা মিল্ক ফিশ ধরা যায়।
মাছের নামঃ গিফট তেলাপিয়া
তেলাপিয়া চাষের বড় সমস্যা হলো এর অনিয়ন্ত্রিত বংশ বিস্তার। এই ধরণের অনিয়ন্ত্রিত বংশবিস্তারের কারণে পুকুরে বিভিন্ন আকারের তেলাপিয়া মাছ দেখা যায়। এতে করে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। প্রকৃতিগতভাবেই পুরুষ তেলাপিয়া মাছের দৈহিক বৃদ্ধির হার বেশি। এই ধারণাকেই কাজে লাগিয়ে শুধুমাত্র পুরুষ তেলাপিয়া চাষকেই মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ বলা হয়। এই প্রজাতি সম্পূরক খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্থ্, প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকে, অধিক ঘনত্বে চাষ করা যায় এবং প্রজননের জন্য পুকুরের পাড়ে গর্ত করে না বিধায় বর্তমানে শুধুমাত্র পুরুষ তেলাপিয়া বা মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষে খামারীদের আগ্রহ বাড়ছে। আর এই পুরুষ জাতীয় তেলাপিয়া মাছ বিশেষ নির্বাচিত প্রজননের মাধ্যমে উৎপন্ন করা হয় যার নাম “গিফট তেলাপিয়া”। পুরো নাম জেনেটিক্যালি ইম্প্রুভড ফার্ম তেলাপিয়া”।
গিফট মাছের চাষে মাছ চাষিরা লাভবান হবেন দ্রুত। এই গিফট জাতীয় তেলাপিয়া রপ্তানিযোগ্য মাছ হওয়ায় কলকাতার বেশ কিছু বাণিজ্যিক রপ্তানী সংস্থা “গিফট” তেলাপিয়া মাছের রপ্তানীতে উৎসাহিত। চুক্তিভিত্তিক মাছের চাষের মাধ্যমে বৈদেশিক বাজারে রপ্তানিতে আরো বেশি করে জনপ্রিয় হতে চলেছে। অতি সম্প্রতি তেলাপিয়া বিশ্বজনীন মাছ বা গ্লোবাল ফিশ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। সারা বিশ্বে চাষ করা মাছের নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এই মাছ।
আরও পড়ুন - গ্রামীণ অর্থনীতিতে মাছ চাষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে উপার্জনে কীভাবে সহায়তা করতে পারে, জানুন বিস্তারিত