মাছ শহর থেকে গ্রামে, অবাঙ্গালি-বাঙালি প্রায় সবখানেই নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় অবিচ্ছেদ্য একটি খাদ্য সামগ্রি। মৎস্য সম্পদ সাধারণ মানুষের বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় একটি অতি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সুপ্রাচিনকাল থেকেই ভারতবর্ষে পুকুর বা নালায় মৎস্যচাষ প্রথা চলে আসছে যার উল্লেখ আমরা ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ (খ্রিঃ পূর্ব ৩২১-৩০০) এবং রাজা সৌমেস্যরের ‘অভিলাষিতা্র্থচিন্তামনি’ (১১২৭ খ্রীঃ) এ পেয়ে থাকি (হোরা, ১৯৫১; জিংরাম, ১৯৯১)। ভারতবর্ষে যদিও মৎস্য উৎপাদন ০.৭ মিলিয়ন টন (১৯৫১ খ্রিঃ) থেকে ১০.৭৯ মিলিয়ন টনে (২০১৫-১৬) বৃদ্ধি পেয়েছে (ডি.এ.এইচ.ডি.এফ, ২০১৬) এবং ভারতবর্ষের সামগ্রিক মৎস্য উৎপাদনের ৯৫% মাছ জলজ পালন থেকে আসে (এফ.এ.ও, ২০১৪), তবুও ভারতবর্ষের জলাশয়ের সম্ভাব্য ব্যবহার এখনো হয়নি (কুরুপ, ২০১০)। ভারতবর্ষের অন্তস্থলীয় মৎস্য উৎপাদনের ৭০-৭৫% আসছে ভারতীয় মেজর কার্প; কাতলা (Catla catla), রুই (Labeo rohita) এবং মৃগেল (Cirrhinus mrigala) থেকে (এফ.এ.ও, ২০০৫)। সহ-অবস্থান গুনসম্পন্ন, দ্রুত বর্ধনক্রম, ভিন্ন খাদ্যাভ্যাস ও বাসস্থানের বৈশিষ্ট্যযুক্ত একাধিক মাছকে একই জলাশয়ে চাষ করাকে বহু প্রজাতির মিলিত মৎস্য চাষ বলে। ভারতীয় মেজর কার্পের সাথে মুক্তাগাছা (Etroplus suratensis), মাগুর (Clarias batrachus), শিঙ্গি (Heteropneustes fossilis), মিল্কফিশ (Chanos chanos), খলসে (Osphronemus gorami) ইত্যাদি মাছচাষের উল্লেখ পাওয়া যায় (এফ.এ.ও, ২০০৫)। চাষ মৎস্যচাষও একপ্রকার বহু প্রজাতির মিলিত চাষ যেখানে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে তিনটি ভারতীয় মেজর কার্প প্রজাতির সাথে তিনটি বহিরাগত কার্প প্রজাতি (সিলভারকার্প;Hypophthalmicthys molitrix, গ্রাসকার্প; Ctenopharyngodon idella, কমনকার্প; Cyprinus carpio) সহপালন করা হয় মাছেদের উপযুক্ততা, সামজ্ঞস্যতা, একে অন্যের প্রতি বন্ধুসুলভ এবং লাভজনক চাষের উপর ভিত্তি করে।
মিশ্র মৎস্যচাষ প্রথম শুরু হয় মধ্য ষাটের দশকের পরে কেন্দ্রীয় অভ্যন্তরীণ মৎস্য গাবেষনার উপকেন্দ্র কটকে। সেই সময় ভারতীয় কৃষি গবেষনা পরিষদ (ICAR) এর তত্তাবধানে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে এই মিশ্র মৎস্যচাষের সম্ভাব্যতা ও অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রয়োগসাধ্যতা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়।
বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মিশ্র মৎস্যচাষে ছয় প্রজাতির মাছের শতকরা অনুপাত সাধারণত কাতলা (১০-১৫%), রুই (২৫-৩০%), মৃগেল (১৫-২০%),সিলভারকার্প (২০-৩০%), গ্রাসকার্প (৫-১০%), কমনকার্প (১০-২০%) হয়ে থাকে (এফ. এ. ও. ২০০৩)। বিভিন্ন তথ্য অনুসারে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে এই ধরনের মৎস্য চাষ পদ্ধতিতে বার্ষিক মৎস্য উৎপাদনে বিস্তর ফারাক লক্ষ্য করা যায়(২০৬০-৮৮৬৭ কীঃ গ্রাঃ/হেঃ/বছর) (চক্রবর্তী, ১৯৮০; হুসেইন, ২০১৩)।
ছয় প্রজাতির মিশ্র মৎস্য চাষ পদ্ধতির ৫০ বছর পুর্ণ হয়েছে । এই চাষপদ্ধতির বর্তমান অবস্থা ও তার থেকে বার্ষিক মৎস্য উৎপাদন সংক্রান্ত তথ্য খুবই কম (বিশ্বাস, ২০১৭)। জনপ্রিয় এই মৎস্যচাষ পদ্ধতির বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গে মিষ্টি জলে মাছ উৎপাদনে প্রথম স্থানাধিকারি উত্তর ২৪ পরগণা জেলাকে নির্বাচন করে একটি সমীক্ষা করা হয়েছে। ৬টি থানা থেকে গড়ে ১০ জন করে মোট ৬০ জন মিশ্র মৎস্যচাষী ভাইয়ের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করে পূর্বপরীক্ষিত ও পূর্বনির্ধারিত প্রশ্ন উত্তর ও কথোপকথনের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য উঠে আসে যা সত্তর দশকের প্রবর্তিত মিশ্র মৎস্যচাষ পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেখা গেছে অধিকাংশ মৎস্যচাষী ১০ অথবা তারও বেশি বছরের চাষের অভিজ্ঞতায় মৎস্য মজুত পূর্ব ব্যবস্থাপনায়, মজুতকালীন ব্যবস্থাপনায় (যেমন- মাছের অনুপাত, প্রজাতির সংখ্যা, মাছ মজুতের পরিমাণ), মজুতপরবর্তী ব্যবস্থাপনায় অনেক পরিবর্তন এনেছেন। মজুতপূর্ব ব্যবস্থাপনায় মহুয়া খৈল (MOC) এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। গ্রামাঞ্চলে কথিত আছে-“মহুয়া খৈলে দুই উপকার/ আদিতে বিষ অন্তে সার”।
উত্তর ২৪ পরগণা জেলায় মজুতপূর্ব ব্যবস্থাপনায় যারা মহুয়া খৈল ব্যবহার করেন তাদের ৮৭% চাষিভাই ICAR নির্ধারিত MOC (২৫০০ কিগ্রাঃ/হেঃ/মি) পরিমাণ অপেক্ষা হেক্টর প্রতি ৭০০-১০০০ কিগ্রাঃ বেশি MOC দিয়ে থাকেন। এর কারন স্বরূপ তাঁরা বাজারজাত অতি ভেজাল ও অনুন্নত MOC কেই দায়ি করেছেন।
বর্তমানে কোন মৎস্যচাষীই পুকুরের জলজ কীটপতঙ্গ নিধনের ব্যবস্থা হিসেবে সাবান+তেলের মিশ্রন আর ব্যবহার করেন না। অধিকাংশই বাজারজাত নুভান (ডাইক্লোরভ্স বা ২,২-ডাইক্লোরভিনাইল ডাইমিথাইল ফসফেট) অথবা উস্থাদ (সাইপারমেথ্রিন) ইত্যাদি রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করেন।
মাছচাষে চুন প্রয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রচলিত কথা অনুসারে “চুন দেওয়ার অশেষ গুন/ সব তরকারিতে যেমন নুন”। আমাদের সমীক্ষা অনুযায়ী প্রায় ৭০% চাষীভাই মৎস্যচাষে নুন্যতম জল পরীক্ষা (যেমন-pH)ব্যতিরেকেই হেক্টর প্রতি ৩০০-৩৫০ কিগ্রাঃ কলিচুন মজুতপূর্ব ব্যবস্থাপনায় ব্যবহার করেন।
উপরন্তু, মজুতকালীন ব্যবস্থাপনায় ৭৫% মৎস্যচাষী কমপক্ষে ৭-১০ প্রজাতির মাছ মজুত করে থাকেন এবং ৯০% মৎস্যচাষী ICAR নির্ধারিত মজুত ঘনত্ব (৭৫০০-১০০০টি, @৫০-১০০ গ্রাম/প্রতিটি) অপেক্ষা ৫০০০-৬০০০টি মাছ বেশি মজুত করেন। ৬ প্রজাতির মাছ ছাড়াও তাঁরা বাটা (Labeo bata), কালবোস (Labeo calbasu), ব্ল্যাক কার্প (Molypharyngodon piceus), গলদা চিংড়ি (Macrobrachium rosenbergii), জাপানি পূটী ইত্যাদি মাছ চাষ করেন। অল্পসময়ে অধিক ফলনের জন্য পুকুরে অধিক মাছের চারা মজুতই তাঁদের বক্তব্য। কোন মৎস্যচাষীই ICAR নির্ধারিত মজুতকালীন মাছের অনুপাত মেনে চলেন না। তাদের মতানুসারে রুই এবং সিলভার কার্পের বৃদ্ধিরহার অনান্য মাছের তুলানায় বেশী, তাই তাঁরা এই দুটি মাছ বেশি পরিমানে মজুত করে থাকেন। এক্ষেত্রে পুকুরে মাছের অবস্থানগত বৈশিষ্ঠ্য ও তার খাদ্যাভাস বিবেচনা করা হয়না। কথায় আছে “মাছটি তুমি ছাড়ার আগে জেনেনিও খাবার/ না হলে তোমারই পোনা করবে যে সাবাড়”(বনস্পতি বিশ্বাস, ২০১৭)।
প্রায় ৩০% চাষীভাই মাছের প্রচলিত পরিপুরক খাদ্য (ধানের কুঁড়ো, সর্ষের খৈল ও ভুট্টার গুড়ো ইত্যাদি) ব্যতিরেকে বস্তাজাত শুকনো পুরানো পাউরুটি, বিস্কুট, ড্রামজাত প্রাণীজ প্রোটিন, চিটেগুড় ইত্যাদি মাছের পরিপুরক খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেন এবং তাতে ভাল ফলন পান। যদিও অধিকাংশ মৎস্যচাষীগন ICAR প্রবর্তিত বা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মাছ চাষ করছেন না, তথাপি ৭৮% চাষী ভাই নিজেদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রতি হেক্টরে বার্ষিক ৫ টনের বেশি মৎস্য সম্পদ উৎপন্ন করছেন এবং তাদের মধ্যে ৯৫% চাষীভাই বছরে দুই বা অধিক বার পুকুরে মাছ মজুত এবং তারও ততোধিকবার বাজারজাত করছেন । নিজেদের অভিজ্ঞতায় এবং অধিক মৎস্য উৎপাদনের ভিত্তিতে বা আশায় প্রায় সব মৎস্য চাষীই মিশ্র মৎস্যচাষ পদ্ধতিকে নিজেদের মত পরিবর্তন করে নিয়েছেন।
লেখক :
বনশ্রী বিশ্বাস, অধ্যাপক শিব কিঙ্কর দাস
মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদ,পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়
রুনা নাথ(runa@krishijagran.com)