বাণিজ্যিক দিক থেকে দেখতে গেলে, বান্ধব দিবস (Friendship day) হলো আধুনিক সমাজের কাছে বা বলা ভালো নবপ্রজন্মের কাছে একটি মাত্র রাবার ব্যান্ড আর কিছু ফ্রেন্ডশিপ কার্ড এর বিনিময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে, আর কিছু দোকানদার এই সুযোগে অল্প-বিস্তর কিছু রোজগারপাতি করে নিচ্ছে। বন্ধুত্ব সর্বকালীন একটি পবিত্র সম্পর্ক বলে মনে করা হয়। ইংরেজি একটি প্রবাদ বাক্য অনুযায়ী, “আপদকালীন সময়ে যে ব্যক্তি মানুষের কাছে থাকে সেই প্রকৃত ও পরম বন্ধু”। তবে এই বন্ধুত্ব যে শুধু মানুষের মধ্যেই হয় তা নয়, বন্ধুত্ব দুটি দেশের সাথে এমনকি প্রকৃতির সাথেও হতে পারে। কেউ শুধুমাত্র একটি বৃক্ষ রোপণ করে বা সামান্য জল সংরক্ষণ করেও প্রকৃতির প্রতি সৌহার্দ সম্পর্ক জ্ঞাপন করতে পারে। এবং কোনো রাসায়নিক প্রযুক্তি ব্যবহার না করে শুধুমাত্র জৈব সার প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো বৃক্ষকে বাঁচিয়ে রাখাতো আরও বড় সৌজন্যতার পরিচয় বহন করে। পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবর্তনে প্রাণী ও পাখিদের অবদান সম্পর্কে সামান্য হলেও সবার মধ্যেই এই পরিচয় অল্পবিস্তর রয়েছে। মানুষের ক্রমোন্নতি ও কৃষির উন্নতির সাথে প্রাণী ও পাখিদের সংযুক্তি পৃথিবী, পরিবেশ, ও প্রকৃতির উপড় যে গভীর প্রভাব ফেলেছিলো এবিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
আমরা খুব সম্প্রতি বন্ধু দিবস উৎযাপন করলাম। এই দিনটি অবশ্য একজন ভারতীয়র কাছে একটি উল্লেখযোগ্য দিন কারণ তাঁর সবথেকে প্রিয় বন্ধু হলো একটি কাক। এর কারণও অবশ্য রয়েছে, ছোটবেলায় সে একটি তৃস্নার্ত কাকের গল্প পড়েছিলো, সেই কাকটি কীভাবে তার ক্ষুদ্র বুদ্ধিকে ব্যবহার করে ওই প্রতিকূল পরিবেশে ছোটো ছোটো পাথরের সাহায্যে কলসির ভেতরের জলস্তরের বৃদ্ধি ঘটিয়ে জলপান করে তাঁর তৃষ্ণা নিবারণ করেছিলো। তাছাড়া সে পায়রার গল্প থেকে জানতে পারে যে একটি পায়রা কীভাবে অতীতে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ দূরদেশে সঠিক প্রাপকের কাছে বহন করে নিয়ে যেত, যা আমাদের বর্তমান ডাক ব্যবস্থাকেও চরম লজ্জা দেয়। এই পায়রাকে কখনো কখনো প্রেমিকার কাছে প্রেমিকের প্রেমপত্র পৌঁছে দিতে শোনা গেছে। যুদ্ধের সময় চিল এর সাহায্যে গুপ্তচররা তাদের গুপ্ত সংবাদ কিকরে স্বপক্ষে আদান প্রদান করতো? এগুলো আজ ইতিহাস হলেও, ভুল তো নয়।
এই সূত্রেই নভীন খান্নার সাথে আঁকটি কাকের বন্ধুত্ব হয়েছে যা এককথায় অতিপ্রাকৃতিক লাগলেও সত্য। নভীনবাবু পেশায় খনির ইঞ্জিনিয়ার, আর কাকের সাথে বন্ধুত্ব তাঁর একপ্রকার নেশা।
নভীন খান্না ১৯৪৫ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি পাঞ্জাবের ফিরোজপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দিল্লী ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর ও ধানবাদ ইউনিভার্সিটি থেকে মাইন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর একটা বিশেষ গুণ ছিলো সেটি হলো তাঁর মধ্যে পাখিদের আকর্ষন করা ও তাদের সাথে সময় কাটানো ও তাদের ডাক বোঝার একটা অদ্ভুদ ক্ষমতা ছিলো। প্রতিদিন তিনি পাখির ঝাঁক নামিয়ে তাদের খাওয়াতেন ও তাদের সাথে সময় কাটাতেন। এই সময়ই কোনো একটা কাকের সাথে তাঁর সখ্যতা তৈরী হয়। তিনি তাঁকে নিজের হাতে খাওয়াতেন এবং তার সাথে কার্ড গেম খেলতেন। এই সময় খুব কাছের থেকে পাখিদের পর্যবেক্ষণ করতে শেখেন। এই অভিজ্ঞতার বলেই পাখিদের ওড়ার ভঙ্গিমার পরিবর্তন দেখে নভীন বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনা যেমন বৃষ্টিপাত, বজ্র বিদ্যুৎ সহকারে ঝড় ও বৃষ্টি এমনকি ভূমিকম্পেরও ভবিষ্যৎ বাণী করতে সক্ষম। তাঁর মতে পাখিদের বা অন্যান্য পশুদের যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস বোঝার ক্ষমতা যেমন থাকে তেমনি বোধগম্যতা মানুষেরও থাকে না। ভাবতে অবাক লাগে অদের কাছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছাড়াই তারা কেমন অদ্ভুত বোধগম্যতা রয়েছে।
নভীনের মতে পাখিদের লড়াই করার স্বভাবের পরিবর্তনের মাধ্যমে বোঝা যায় সেইদিন বৃষ্টি হবে না ঝড় হবে!... কাকেরা হলো একেকটা প্রাকৃতিক আবহাওয়া দপ্তর, যা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। আর আমাদের প্রত্যেকেরই এই স্বভাবসিদ্ধ ভাবভঙ্গী জানা দরকার, যাতে কৃষকদের আবহাওয়ার ভাবভঙ্গী বোঝার জন্য আবহাওয়া দপ্তরের কোনো পূর্বাভাষের দরকার পড়বে না।
নভীনের বক্তব্য হলো, কাক বন্য প্রকৃতির প্রাণী, এবং যদি একে ঠিকমত প্রশিক্ষিত করা যায় তবে তারা অদ্ভুদভাবে নিজেদেরকে সভ্যতার বেড়াজালে জড়িয়ে ফেলবে। বিগত শত বৎসরেরও বেশী সময় ধরে মানুষ ও কাক একই বাস্তুতন্ত্রে বাস করছে। মার্জলাফ ও এঞ্জেল এর মতো পক্ষীবিশারদ ও গবেষকরাও কাক ও দাঁড়কাকদের পরিবর্তন ও বিবর্তনকে ভালোকরে পর্যবেক্ষন করেছিলেন। তাদের মতে কাক ও দাঁড়কাকের প্রজাতি এক নয় বরং তারা একই সাথে বিবর্তিত হয়েছে। শুধুমাত্র সমসংস্থ সম্পর্ক ছাড়া এদের মধ্যে আর কোনো মিল নেই।“
“অবশ্যই, মানুষ আর কাক হলো প্রায় সমসাময়িক, দুই জাতের জীবন ও ইতিহাস একই রকমভাবে অত্যন্ত ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই যে কাকের সাথে আমার বন্ধুত্ব রয়েছে তাদের ছানারাও তাদের জনিতৃ গুণসম্পন্ন হয়েছে, আরও বলা ভালো এই কাকটির পরিবারের সদস্যরা এখানকার অন্যান্য পাখিদের থেকে অনেক বেশী বিনয়ী অন্তত সেই সব পাখিদের তুলনায় যারা এখানে প্রায় ১০০ বৎসর ধরে বসবাস করছে। আমার চারপাশে যে সব কাকেদের দেখছেন তাদের সবার সাথেই আমার অল্পবিস্তর সখ্যতা রয়েছে। তারা এখানেই তাদের বসবাসের স্থান নির্বাচন করে নিয়েছে, এবং তারা ইতিমধ্যেই বেশ আঞ্চলিক হয়ে উঠেছে, অবশ্য তাঁর মানে এই নয় যে তারা কোনোদিন এই স্থান ছেড়ে যাবে না। বছরের পর বছর আমি দেখছি সূর্য ডোবার পর তারা দল বেঁধে তাদের বাসায় ফিরে আসে। এমনও দেখা গেছে তারা বহু মাইল দূরের থেকেও ঠিক অন্যান্য কাকদের সাথে যোগাযোগ তৈরি করে ঠিক সময়মত তাদের নিজের দলে ফিরে এসেছে। আমি অবশ্য একসাথে এত কাক কখনই দেখি নি তবে শুনেছি কাকেরা একেকটি দলে প্রায় ৪০,০০০ জনেরও বেশী দলবদ্ধ হয়ে থাকে। আবার একেকটি দলের সদস্য সংখ্যা ২০ লক্ষেরও বেশী হয়ে থাকে।
একমাত্র বসন্তে কাকেরা নিজেদের আলাদা আলাদা বাসা নির্মান করে। এইসময় তারা তাদের ছানাদের প্রকৃতি ও প্রতিঘাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। আপনি হয়তো দেখতে পাবেন কাকেরা বহু দূরদূরান্ত থেকে তাদের বাসা তৈরির উপকরণগুলি যোগাড় করে। ডিম ফোটার আগে বা পরে কাকেরা সাধারণত একটু অন্যরকম আচরণ করে থাকে। অন্তত আমার বিগত ৪৫ বছরের অভিজ্ঞতা তাই বলছে”-
এই মূহূর্তে নভীন খান্নার ২৯ টি কাক বন্ধু রয়েছে, এবং এই ব্যাপারটা একদম সত্য, মোটেই কাকতালীয় নয় । শুধুমাত্র ভারতীয় পত্র পত্রিকায় নয়, তাঁর এই ধরণের নেশার খবর আজ অস্ট্রেলিয়ার “চ্যানেল নাইন”-এর কাছেও অজানা নয়।
- প্রদীপ পাল