তেলাপিয়া মাছের (Mozambique tilapia) বৈজ্ঞানিক নাম Oreochromis mossambicus। এটি একটি মাঝারি আকারের উচ্চ ফলনশীল মাছ। সাধারণ স্থানীয় গিফট জাতের তেলাপিয়ার তুলনায় উদ্ভাবিত উন্নত জাতের বিএফআরআই গিফট জাত ৩২-৬৬% অধিক উৎপাদনশীল। সাম্প্রতিককালে এ মাছের মনোসেক্স পুরুষ জাতের পোনার চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে কারণ, তেলাপিয়ার ক্ষেত্রে স্ত্রী জাতের চেয়ে পুরুষ জাতের উৎপাদনশীলতা তুলনামূলকভাবে ২০-৩০% বেশী। এ প্রেক্ষিতে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এর বিজ্ঞানীরা ৯৮-১০০% মনোসেক্স পুরুষ জাতের পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছে।
তেলাপিয়ার পোনা উৎপাদন কৌশল:
তেলাপিয়ার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট হচ্ছে প্রতি মৌসুমে ৫-৬ বার স্বাভাবিক প্রজননের মাধ্যমে জলাশয়ে অধিক সংখ্যক পোনা উৎপাদন করে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি এই মাছ চাষের একটি বড় সমস্যাও বটে। এই সমস্যা হতে উত্তরণের উপায় হলো মনোসেক্স পুরুষ জাতের তেলাপিয়া চাষ করা। পুরুষ জাতের তেলাপিয়া চাষ করলে অপেক্ষাকৃত বেশী উৎপাদন পাওয়া যায় এবং সাথে সাথে পোনা উৎপাদনের মাধ্যমে যে সমস্যার সৃষ্টি হয় তা হতে মুক্ত থাকা যায়।
বিশুদ্ধ জাতের ব্রুড মাছ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ:
মনোসেক্স তেলাপিয়া পোনা উৎপাদনের জন্য ১০০-১৫০ গ্রাম ওজনের বিএফআরআই সুপার তেলাপিয়ার ব্রুড সংগ্রহ করে ২০-২৫ শতাংশ পুকুরে প্রতি শতাংশে ৭০-৮০টি হারে মজুদ করতে হবে। মজুদ করার পর সম্পূরক খাদ্য হিসাবে চালের কুঁড়া, গমের ভুষি, সরিষার খৈল ও ফিশমিলের মিশ্রন (২৫% প্রোটিন) মাছের দেহ ওজনের ৩% হারে সরবরাহ করতে হবে।
পুকুরে হাপা স্থাপন:
হাপা স্থাপনের জন্য পুকুরের আয়তন ছোট-বড় হতে পারে, তবে ৫০-৬০ শতাংশের হলে ভাল হয়। এ আয়তনের একটি পুকুরে ৮-১০টি ২৫মি.ী৪মি.ী১মি. সাইজের হাপা স্থাপন করা যায়। এই হাপার মধ্যে প্রতি ঘন মিটারে পরিপক্ক ১০০-১৫০ গ্রাম ওজনের ৩টি স্ত্রী ও ১টি পুরুষ তেলাপিয়া মজুদ করতে হবে। মজুদকৃত মাছকে ২৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ সম্পূরক খাদ্য মাছের দেহ ওজনের ৭-৮% হারে প্রতিদিন দিতে হবে।
ইনকিউবেশন জারে পোনা ফোটানো -
মাছ মজুদ করার ১০-১২ দিন পরে স্ত্রী তেলাপিয়ার মাছের মুখ হতে ডিম সংগ্রহ করতে হবে। প্রত্যেক হাপায় মজুদকৃত স্ত্রী মাছগুলোর মুখ থেকে ৪-৫ দিন অন্তর ডিম সংগ্রহের ব্যবস্থা নিতে হয়। এই সংগৃহীত ডিম হ্যাচারীতে, প্লাষ্টিকের তৈরী ইনকিউবেশন জারে ফোটার জন্য রাখতে হবে। ৩-৪ দিনের মধ্যে ডিমগুলো হতে রেণুপোনা ফুটে বের হয়ে আসবে এবং এই পর্যায়ে রেণুপোনা ডিম্ব থলি হতে খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে। ডিম্ব থলি নিঃশেষিত না হওয়া পর্যন্ত রেণুপোনাগুলোকে ইনকিউবিশন জারে রাখতে হবে।
হরমোন মিশ্রিত খাদ্য তৈরী:
মনোসেক্স পুরুষ তেলাপিয়ার পোনা উৎপাদন করার জন্য ৬০ মিলিগ্রাম ১৭ আলফা মিথাইল টেসটোষ্টেরন ৯৯% ইথাইল এ্যালকোহলে দ্রবীভূত করে ৩৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ প্রতি কেজি খাদ্যে উত্তম করে মিশিয়ে হরমোন খাদ্য তৈরী করা হয়।
হরমোন খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি:
এ পর্যায়ে ইনকিউবেশন জার হতে রেণু পোনাগুলোকে সরিয়ে হাপাতে মজুদ করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, হরমোন মিশ্রিত খাদ্য প্রতিদিন ৪-৫ বার রেণু পোনাগুলোকে খাওয়াতে হবে। ২১ দিন পর পোনাগুলোকে প্রতি ঘনমিটারে ৩০০-৪০০টি হারে অন্য হাপায় মজুদ করা হয়ে থাকে। এখানে পোনাগুলোকে দেহ ওজনের ১০-১৫% হারে ৩০% প্রোটিশ সমৃদ্ধ স্বাভাবিক খাদ্য (হরমোন বিহীন) সরবরাহ করতে হবে। এখানে পোনাগুলোকে আরও ২-৩ সপ্তাহ লালন পালন করে বিক্রি অথবা চাষের জন্য পুকুরে মজুদ করা হয়ে থাকে। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে ৯৮-১০০% মনোসেক্স পুরুষ জাতের তেলাপিয়ার পোনা উৎপাদন করা সম্ভব।
পুকুর প্রস্তুতি:
নার্সারী পুকুরের আয়তন ১০-২৫ শতাংশ এবং পানির গভীরতা ১ মিটার রাখা আবশ্যক। পুকুর শুকিয়ে সমস্ত রাক্ষুসে মাছ ও মৎস্যভূক প্রারী অপসারণ করতে হবে। নিষ্কাশন সম্ভব না হলে মিহি ফাঁসের জাল টেনে অথবা মৎস্য বিষ (প্রতি শতাংশে ৪০-৫০ গ্রাম রোটেনন) প্রয়োগ করে অবাঞ্চিত প্রাণী দূর করতে হবে। হরমোন মিশ্রত খাদ্য প্রয়োগের জন্য হাপার আয়তন ৮-১০ ঘনমিটার হতে পারে। প্রতি ঘন মিটার হাপাতে ১,২০০-১,৫০০টি রেণু পোনা মজুদ করা যায়। হাপাতে রেণু পোনাগুলোকে ২১ দিন লালন-পালন করতে হবে নি¤œলিখিত হারে রেণু পোনাগুলোকে হরমোন মিশ্রিত খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরের পানির গুণাগুন পোনা চাষের উপযোগী করার জন্য মাটির পিএইচ ৬.৫-৭.০ এর জন্য শতাংশ প্রতি ১.০ কেজি পাথরে চুন প্রয়োগ আবশ্যক। চুন প্রয়োগের ৩-৪ দিন পরে প্রতি শতাংশে ৮-১০ কেজি গোবর অথবা ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে। পোনা মজুদের পূর্বে নার্সারী পুকুরের পাড়ে নাইলন/ফিল্টার নেটের বেড়া দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
পোনা মজুদ ও ব্যবস্থাপনা:
-
নার্সারী পুকুরের প্রতি শতাংশে ১,২০০-১,৫০০টি হারে পোনা মজুদ করা যেতে পারে।
-
মজুদকৃত পোনাকে নার্সারী পুকুরে ৬ সপ্তাহ ১০-২৫% হারে ২৮-৩০% প্রোটিনসমৃদ্ধ সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
-
মজুদকৃত পোনাকে নিম্নের ছক অনুযায়ী সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করা যেতে পারেঃ
-
প্রতি সপ্তাহে অনুমান করে খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
-
নার্সারী পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য ৭-১০ দিন অন্তর ৬-৮ কেজি পঁচা গোবর অথবা ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি পানিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
-
এ ব্যবস্থাপনায় ৬ সপ্তাহ লালনের পর পোনা যখন ১৫-২০ গ্রাম ওজনের হবে তখন তা বিক্রি বা চাষে জন্য পুকুরে মজুদ করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন - গ্রামাঞ্চলে পুকুর পাড়ে শাক-সবজির চাষ থেকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও কৃষকদের বাড়তি আয়ের সুযোগ
পুকুরে মনোসেক্স তেলাপিয়ার চাষ:
মনোসেক্স পুরুষ তেলাপিয়া স্ত্রী তেলাপিয়ার চেয়ে যেহেতু বেশী উৎপাদনশীল সেহেতু নিঃসন্দেহে চাষের জন্য এটি একটি উচ্চফলনশীল জাতের মাছ। ছোট ডোবা, পুকুর, খাঁদ, ঘেরসহ অন্যান্য জলাশয়ে এ মাছ ৩-৪ মাসে বিপননযোগ্য হয়।
পুকুর প্রস্তুতি:
ছোট বড় যে কোন পুকুরে যেখানে পানির গভীরতা ৩-৫ ফুট থাকে এমন পুকুর নির্বাচন করতে হবে। পুকুরের পাড় মেরামত ও জলজ আগাছা পরিস্কার করে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ আবশ্যক। চুন প্রয়োগের ৩ দিন পরে প্রতি শতাংশে ১০-১৫ কেজি গোবর সার প্রয়োগ করতে হয়। এ অবস্থায় পুকুরে মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা মজুদের ব্যবস্থা নিতে হবে।
পোনা মজুদ ও চাষ ব্যবস্থাপনা:
পুকুর প্রস্তুতির পর প্রতি শতাংশে ১০-১৫ গ্রাম ওজনের সুস্থ সবল ২০০-২৫০টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে। পোনা মজুদের পর সম্পূরক খাদ্য হিসাবে চালের কুঁড়া, সরিষার খৈল, গমের ভূষি, ফিসমিল ইত্যাদি মিশ্রণ (২৮% প্রোটিন) প্রতিদিন পুকুরে মাছের দেহ ওজনের ৪-৮% হারে প্রয়োগ করতে হবে। প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুর্যতা বৃদ্ধির জন্য ১৫ দিন অন্তর অন্তর ৪-৬ কেজি গোবর সার অথবা ২-৩ কেজি মুরগীর বিষ্টা প্রয়োগ করা যেতে পারে। প্রতি ১৫ দিন অন্তর অন্তর জাল টেনে মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করে সম্পূরক খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
মাছ আহরণ ও উৎপাদন:
পুকুরে পোনা মজুদের ৪-৫ মাসের মধ্যে ২৫০-৩০০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। এ অবস্থায় পুকুর শুকিয়ে সমস্ত মাস ধরে বিক্রি করতে হবে। এ পদ্ধতিতে চাষ করে প্রতি হেক্টরে ৮-৯ টন মাছ উৎপাদন করা সম্ভব।
আয়-ব্যয়: বাণিজ্যিকভাবে চাষের ক্ষেত্রে আধা-নিবিড় ব্যবস্থাপনায় মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষে প্রতি হেক্টরে ১.২৫-১.৫০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে ২.০-২.৫ লক্ষ টাকা মুনাফা করা যায়।
সমস্যা -
-
প্রজনন হাপায় স্ত্রী ও পুরুষ তেলাপিয়ার অনুপাত ৩:১ না হলে পোনা উৎপাদন আশানুরুপ হয় না
-
প্রজনন হাপা ময়লা হলে পোনা উৎপাদন কার্যক্রম ব্যহত হয়
-
মনোসেক্স পুরুষ তেলাপিয়া পোনা নার্সিং না করে মজুদ করলে পোনার বাঁচার হার কম হয়
-
বাৎসরিক পুকুরে চাষ করলে সমস্ত মাছ আহরণ করা সম্ভব হয় না
-
বিশুদ্ধ হরমোন ও ইথাইল অ্যালকোহল (৯৯%) বাজারে সহজপ্রাপ্য নয়।
-
মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা উৎপাদন ও চাষের ক্ষেত্রে নিম্ন লিখিত বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজনঃ
-
প্রজনন হাপায় স্ত্রী ও পুরুষ মাছের অনুপাত সঠিক হারে রাখতে হবে
-
প্রজনন পুকুর সব সময় পরিস্কার প্রয়োজনীয় পরিমানে পানি (১-১.৫ মিটার) সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
-
হরমোন মিশ্রিত খাদ্য প্রয়োগের ক্ষেত্রে পোনার সাইজের তারতম্য না হওয়াই ভাল। সে জন্য একই দিনে সংগৃৃহীত নিষিক্ত ডিম হতে উৎপাদিত পোনা একত্রে করে হাপায় রেখে হরমোন মিশ্রিত খাদ্য প্রয়োগ করা যেতে পারে।
-
বাৎসরিক পুকুরে তেলাপিয়া চাষ না করাই ভাল পুকুর অবশ্যই শুকিয়ে পরবর্তী চাষ শুরুর আগে সমস্ত মাছ ধরে ফেলতে হবে।
আরও পড়ুন - গ্রামের যুবকরা/মৎস্য চাষিরা পার্শে মাছের বাণিজ্যিক চাষে আয় করুন অতিরিক্ত