খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওর, পুকুর ও জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে। তার মধ্যে একটি দেশি প্রজাতির সরপুঁটি বা সরনা পুটি। সরল পুঁটিও বলা হয়ে থাকে। এর বৈজ্ঞানিক নাম পুংটিয়াস সারানা। সাদাটে বা রূপালী বর্ণের দেহ এ মাছটি, কানকোর উপরে সোনালী দাগ বিশিষ্ট এ মাছটির পাখনাসমূহ লালচে বা কমলা রংয়ের। অতি সুস্বাদু এই মাছটির পুষ্টিমানও বেশ ভালো।
খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওড়সহ বিভিন্ন জলাশয়ে পূর্বে এ মাছটি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেলেও বর্তমানে আর আগের মত পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে অল্প পরিমানে বর্ষাকালে ধানেক্ষেতে বা পাটের ক্ষেতেও এদের পাওয়া যায়। দেশী সরপুঁটি অন্যান্য পুঁটি মাছের ন্যায় বর্ষা মরসুমে প্রজনন করে থাকে। এরা আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে হালকা স্রোতযুক্ত জলে ডিম দিয়ে থাকে।
সরকারি উদ্যোগে বর্তমানে এ মাছটিকে অ্যাকুরিয়ামে লালন-পালনের চেষ্টা করা হচ্ছে। চাষের পাশাপাশি অ্যাকোয়ারিয়ামে পালনের উদ্যোগ নিলে তা আর্থিকভাবে লাভজনক হবে এবং এ মাছটির বিলুপ্তির সম্ভাবনা কমে যাবে। আবার পুকুরে অতি সহজেই সরপুঁটি মাছের চাষ করা যায়। হলদিয়া ব্লকের বেশ কিছু মাছ চাষ চাষি সরপুঁটি মাছের চাষ করছেন। হলদিয়ায় সরকারি প্রকল্পে সরপুঁটি মাছের চারা দেওয়াও হয়েছে। দ্বারিবেড়িয়া গ্রামের নারায়ন বর্মন বাণিজ্যিক ভাবে সরপুঁটি মাছের চাষ করেছেন এবং সাফল্য পেয়েছেন। তমলুকে সিএডিসি ফার্মে এই মাছ নিয়ে গিয়ে এর কৃত্রিম প্রজনন করেছে। তমলুকে সিএডিসি সরকারি মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রে এই মাছের ডিম পোনা পাওয়া যায়। তাছাড়া বেসরকারি হ্যাচারিতেও সরপুঁটি মাছ আজকাল পাওয়া যাচ্ছে।
মাছের মিশ্র চাষ (Mix Fish Framing) -
চাষের জন্য এই মাছের মিশ্র চাষ করা যায়। রুই, কাতলা, মৃগেল কার্প জাতীয় মাছের সাথে অনায়াসেই সরপুঁটি চাষ করা যায়। মাছটি একদমই রাক্ষুসে স্বভাবের নয়। সঠিক পদ্ধতিতে নার্সারি পুকুর প্রস্তুত করার পর প্রতি ডেসিম্যাল পুকুরে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজারটি পোনা (৫ থেকে ৭ দিন বয়স) মজুদ করা যায়।
প্রাথমিকভাবে পাঁচ দিন পোনার মোট ওজনের দ্বিগুন হারে এবং পরবর্তী পাঁচ দিন অন্তর অন্তর পোনার মোট ওজনের যথাক্রম ১৫, ১০ ও ৫ শতাংশ হারে বাণিজ্যিক নার্সারি খাবার অথবা সম্পূরক খাবার দিতে হবে। বরাদ্দকৃত খাবার দিনে দুই থেকে তিনবারে পুকুরে দিতে হবে। নার্সারি পুকুরে ২৫ থেকে ৩০ দিন পোনা প্রতিপালনের পর চাষের পুকুরে ছাড়ার উপযুক্ত হয়ে থাকে।
চাষ পদ্ধতি (Cultivation Procedure) -
সাধারন পদ্ধতিতে মিশ্র চাষ করলে, পুকুরে ৪-৬ ইঞ্চি সাইজের ডেসিম্যালে মোট ৩০-৪০টি কার্প জাতীয় মাছ (রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, কমন কার্প) ছাড়লে এর সাথে ১০টি সরপুঁটি মাছ ছাড়া যায়। সরপুঁটি সকল স্তরেই অবস্থান করে। পুকুরের ধারে অগভীর জলে বসবাস করে। খাদ্য হিসেবে এটি শেওলা জাতীয় উদ্ভিদ, জলজ পোকামাকড়, ছোট মাছ, চিংড়ী, জুপ্ল্যাংকটন, এককোষী প্রাণী ইত্যাদি খেয়ে থাকে। সরপুঁটি সাধারণত নরম ঘাস পছন্দ করে। তাই এ মাছের জন্য খুদে পানা, টোপা পানা, নেপিয়ার ঘাস, কলাপাতা ইত্যাদি প্রতিদিন সামান্য পরিমাণ হলেও সরবরাহ করা গেলে আনুপাতিক উৎপাদনও সন্তোষজনকভাবে বৃদ্ধি পাবে। পাঁচ-ছয় মাস পালনের পর এক-একটি মাছের ওজন গড়ে ১২০ থেকে ১৫০ গ্রাম দাঁড়াবে । এই সময় মাছ বাজারজাত করার পুরোপুরি উপযোগী হয় । সুস্বাদু মাছ হিসেবে বাজারে এই মাছের চাহিদাও থাকে প্রচুর।
হারিয়ে যাওয়া মাছ গুলি বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি হ্যাচারীতে কৃত্রিম প্রজনন করা হচ্ছে। এতে মাছ গুলি সহজেই পাওয়া যাচ্ছে। এর সাথে পুকুরে মাছগুলি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক চাষ করলে মাছের উৎপাদন বেড়ে যাবে। তবে প্রাকৃতিক জলাশয় রক্ষা, জলাভূমি সংরক্ষন, ধান চাষের জমিতে কীট নাশক না দিলে এই সব মাছগুলি হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা যাবে। প্রতি ব্লকে ব্লকে মৎস্যচাষ সম্প্রসারন আধিকারিক রয়েছেন। ওনার সুপরামর্শে মাছ চাষিরা যদি আরো এগিয়ে আসেন তবে মাছগুলি আরো বেশি করে বাঙালির পাতে আসবে ।