পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে অন্যতম সেরা হল মাছ। পুষ্টির কথা প্রসঙ্গে প্রথমেই প্রোটিনকে মনে করা হয়। যেন এ দুটি একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। প্রোটিনের যে কয়েকটি শ্রেণী আমাদের জানা আছে তার মধ্যে সর্বসেরা হল মায়োফাইব্রিলার প্রোটিন। উদাহরণ হিসেবে এদের কয়েকটি নাম হল অ্যাকটিন, মায়োসিন, ট্রোপোমায়োসিন ইত্যাদি। যেকোন মাছের মধ্যে এই সেরা প্রোটিন থাকে সব চাইতে বেশী (প্রায় ৭৫%); আর প্রোটিনের শ্রেণীগুলির মধ্যে সর্বনিম্ন মানের যেটি তা হল স্ট্রোমা প্রোটিন আর এই নিম্নমানের প্রোটিনটি মাছে মাত্র ২-৩% মতো থাকে। ফলে যেকোনো প্রণীজ প্রোটিনের তুলনায় মাছের প্রোটিন সর্বশ্রেষ্ঠ মানের আর এই একই কারণে মাছ অত্যন্ত সহজপাচ্য এবং এই প্রোটিনে আমাদের শরীরের জরুরী ১০টি অ্যামিনো অ্যাসিডের ভারসাম্য খুব ভালো ভাবে রয়েছে। আরো উল্লেখ করতে গেলে বলতে হয় এই ১০ টি প্রোটিনের মধ্যে একান্ত জরুরী যে চারটি হল যথাক্রমে লাইসিন, মিথাওনিন, আরজিনিন ও ট্রিপটোফ্যান। এদেরও পর্যাপ্ত পরিমানে পাওয়া যায় মাছের মধ্যে।
প্রোটিন-জনিত উচ্চমানের পুষ্টিগুণের দিকটি ছাড়াও মাছের অপরিসীম পুষ্টিগত মূল্যের উৎস হল কয়েকটি দীর্ঘ শৃঙ্খল ওমেগা-৩ শ্রেণীর ফ্যাটি অ্যসিড। এদের মধ্যে আবার যে দুটির নাম উল্লেখ না করলেই নয় তারা হল আইকোশাপেন্টাইনোইক-অ্যাসিড বা ই পি এ এবং ডোকোসাহেক্সা-ইনোইক-অ্যাসিড বা ডি এইচ এ। আমাদের স্বাস্থ্যের এমন কোন দিক নেই যাতে এই দুটির প্রয়োজনীয়তা নেই। রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বা এল ডি এল এর মাত্রা কমাতে এবং একই সাথে ভালো কোলেস্টেরল বা এইচ ডি এল এর মাত্রা বাড়াতে এই ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে; তার মানে আমাদের হৃৎপিন্ডের কর্মক্ষমতাকে চালিত রাখতে এদুটি একান্ত ভাবে আমাদের প্রয়োজন। এছাড়াও স্নায়ু বা মস্তিষ্ক জনিত নানাবিধ সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে যদি আমাদের রক্তে এই দুটি ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমান যথাযথ থাকে। সাধরণত সামুদ্রিক মাছের মধ্যে এদের উপস্থিতি মিষ্টি জলের মাছের তুলনায় কিছুটা বেশী থাকে। সেই অর্থে মনে হতে পারে সামুদ্রিক মাছ পুষ্টি গুণের দিক থেকে এগিয়ে আছে, কিন্তু মিষ্টি জলের মাছে ডিস্যাচুরেস নামের উৎসেচক থাকে যা কিনা সামুদ্রিক মাছে নেই। আর এই জন্য এগুলির সংশ্লেষণ ক্ষমতা থাকার দরুণ খুব সামান্য পরিমানে হলেও শুরুর উপাদান বা লিনোলেনিক অ্যাসিড খাবারের মাধ্যমে জোগান পেলেই এরা সামুদ্রিক মাছের তুলনায় কিছু কম যাবে না। মাছের খাবারে তাই সামান্য তারতম্য ঘটিয়ে আমরা মিষ্টি জলের মাছের পুষ্টি বাড়িয়ে দিতে পারি এইভাবে এবং তখন মিষ্টি জলের মাছ সামুদ্রিক মাছের তুলনায় পুষ্টিগুনের দিক থেকে বরাবর হয়ে যাবে। ভারত বর্ষের পূর্ব এবং উত্তর পূর্ব রাজ্যগুলিতে বেশিরভাগ মানুষই মিষ্টি জলের মাছ খেতে পছন্দ করেন। তাই এইভাবে আমরা বিশেষ পুষ্টির জোগান মিষ্টি জলের মাছের মাধ্যমে পেয়ে যেতে পারি।
মাছ থেকে সরাসরি ৪টে ভিটামিন – এ, ডি, ই, কে ছাড়াও সায়ানোকোবালামিন বা ভিটামিন বি-১২ এর মতো দুস্প্রাপ্য ভিটামিন পেয়ে থাকি। যে কয়েকটি খাবার পটাশিয়াম সমৃদ্ধ তার মধ্যে মাছ অন্যতম। সর্বত্রই সোডিয়ামের ছড়াছড়ি আর পটাশিয়ামের ঘাটতি। মাছ এদিক থেকে এক ব্যতিক্রমি পুষ্টির জোগানদার। এছাড়াও ক্যালশিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, দস্তা, ম্যাগনেশিয়াম, সিলেনিয়াম ও আয়োডিন মাছে পর্যাপ্ত পরিমানে থাকায় মাছ সবদিক থেকে পুষ্টি গুণে ভরপুর।
এর মধ্যে একটি চিন্তার কারণ এই যে আমাদের রসনার তৃপ্তির জন্য আমরা মাছ অনেক সময়ই অতিরিক্ত ভেজে রান্না করার চেষ্টা করি এবং তার ফলে পুষ্টি গুণও বেশ কিছুটা হারিয়ে যায়। এই জায়গাতে একটু সচেতন থাকলে মাছের মতন পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার আর কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না। খুব উচ্চ তাপমাত্রায় মাছ ভাজা হলে তেলের মধ্যে ট্রান্স ফ্যাটি অ্যসিড উৎপন্ন হতে পারে। এই যৌগটি কিন্তু আমাদের শরীরের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। সাধারনত সিস্-ফ্যাটি অ্যসিড আমাদের পক্ষে উপকারী আর ট্রান্স ফ্যাট ক্ষতিকর। এইটুকু স্মরণে রাখতে পারলে ভালো হয়।
আমাদের রাজ্যে ৬ লক্ষ হেক্টরের বেশী মিষ্টি জলের সম্পদ রয়েছে আর এর মধ্যে অর্ধেক পরিমানকেও আমরা আধুনিক মাছ চাষের আওতায় আনতে পারিনি। যদিও সরকারের মৎস দপ্তর ও গ্রামীণ বিকাশ দপ্তরের উদ্যোগে প্রশংসনীয় এবং আশা করা যায় মাছ চাষের ব্যপক প্রসারের কোনো বাধা থাকবেনা। এতে খাদ্য প্রপ্তি যেমন বেশী হবে পুষ্টি জোগানটিও সুনিশ্চিত হবে এবং মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, গ্রামীণ অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটবে। এই ব্যপারে প্রশিক্ষণ ও নানা রকম শিবিরের মাধ্যমে জন সচেতনতা বাড়ানো খুব প্রয়োজন কারণ বাস্তবতার নীরিখে মাছ চাষের সম্প্রসারণ আগামী দিনের জন্যে অত্যাবশ্যক।
লেখক:
ড: প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (প্রাক্তন প্রধান প্রাণীরসায়ন ও পুষ্টি বিজ্ঞানী
কেন্দ্রীয় স্বাদুজল মৎস গবেষণা সংস্থা, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভুবনেশ্বর )
রুনা নাথ(runa@krishijagran.com)