আপনি কি জানেন গ্রামবাংলায় আমরা যেসব গাছপালা দেখি, তার সাহায্যেই গবাদিপশুর অধিকাংশ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। গবাদিপশুর প্রাকৃতিক উপায়ে চিকিৎসা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। কোন রোগে কোন উদ্ভিদ/লতাপাতা কীভাবে ব্যবহার করলে উপকার হবে, এই প্রবন্ধে আজ আমরা সেই তথ্যই আলোচনা করব। বিশেষত যদি আশেপাশে প্রাণী চিকিৎসক উপস্থিত না থাকেন, তবে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা যায়।
গবাদি পশুর প্রাকৃতিক চিকিৎসা -
হজমের গোলমাল – ৫০০ মিলি. আদার রস ও ৫০০ মিলি. সজনে পাতার রস, ২০০ মিলি. মধুর সাথে ভালো করে মিশিয়ে দিনে দু'বার করে তিনদিন খাওয়াতে হবে।
পাতলা পায়খানা – গবাদিপশু ভিজে বা পচা খাবার খেয়ে ফেললে বা দূষিত জল খেলে এই সমস্যায় ভোগে। এর প্রতিকারের জন্য –
১) একমুঠো করে ডালিম পাতা, পেয়ারা পাতা ও নিমপাতা কুচিয়ে ৫০গ্রাম আদা ও ১০০ গ্রাম গুড়ের সাথে ভালো করে মিশিয়ে তিনভাগে ভাগ করে নিতে হবে। এরপর একভাগ করে দিনে তিনবার খাওয়াতে হবে।
২) ৫০০ গ্রাম পেয়ারা পাতা, তিন গ্লাস জলে ফুটিয়ে সেটা দিনে দুবার করে খাওয়াতে হবে।
জিভে ঘা - জিভে ঘা হলে গরু খাওয়া বন্ধ করে দেয়, ফলে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। এর উপশমের জন্য নিম্নোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে-
১০০ গ্রাম তেঁতুলের সাথে ২০০ মিলি. তিলের তেল ভালো করে মিশিয়ে ঘা এর ওপর দিনে তিন-চারবার লাগাতে হবে।
কোষ্ঠকাঠিন্য – গরুর কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করতে ১০০ গ্রাম হলুদ এক লিটার জলে ফুটিয়ে ক্বাথ তৈরী করে দিনে একবার করে তিনদিন খাওয়াতে হবে।
পেট ফাঁপা – গরুকে অতিরিক্ত কার্বহাইড্রেট জাতীয় খাবার বা গরম ফ্যান বা অনুষ্ঠান বাড়ির খাবার খাওয়ালে এই সমস্যা হয়। পেটে অতিরিক্ত গ্যাস জমে যায়। এর চিকিৎসার জন্য নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
১) ১০ গ্রাম রসুন, ৫০ গ্রাম বিটনুন ঈষদুষ্ণ জলে মিশিয়ে চার-পাঁচ ঘন্টা অন্তর খাওয়াতে হবে।
২) ২০০মিলি. ক্যাস্টর অয়েল ঈষদুষ্ণ জলে মিশিয়ে চার-পাঁচ ঘন্টা অন্তর খাওয়াতে হবে।
সর্দি কাশি –
১০০ গ্রাম করে তুলসী পাতা ও বাসক পাতার সাথে ৫০ গ্রাম আদা ও ১০০ গ্রাম গুড় মিশিয়ে এক লিটার জলে ফুটিয়ে কাথ্ব তৈরী করে, সেখান থেকে ১০০মিলি. দিনে দুবার করে খাওয়াতে হবে।
পালান প্রদাহ/ঠুনকো (Mastitis) –
বর্তমানে দুগ্ধ শিল্পে এটি একটি বড় সমস্যা। কোন গরুর পালান প্রদাহ দেখা গেলে পালানটা ভালো করে ধুয়ে, তারপর ঘৃতকুমারীর জেলির মতো অংশটা ৫০ গ্রাম হলুদ ও ১০ গ্রাম চুনের সাথে ভালো করে মিশিয়ে পালানের ওপর লাগাতে হবে দিনে দু-তিনবার।
দুধের সাথে রক্ত পড়া –
এক কেজি লজ্জাবতী পাতা ভালো করে বেঁটে দিনে দুবার করে তিন-পাঁচদিন খাওয়াতে হবে।
দুধের উৎপাদন কমে যাওয়া –
১) ২৫০ গ্রাম সতভরীর (Asparagus racemosus) মূল বেঁটে দিনে দুবার করে পাঁচদিন খাওয়াতে হবে।
২) প্রতিদিন ৫০ গ্রাম করে জীবন্তি -এর পাতা ও কান্ড, গো-খাদ্যর সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে দিনে দুবার করে টানা একমাস।
বন্ধ্যাত্ব (Infertility) –
ডাক না আসা একটা খুব বড় সমস্যা। এর সমাধানের জন্য প্রতিদিন সকালে ২০০ গ্রাম করে অঙ্কুরিত ছোলা পনেরো দিন খাওয়াতে হবে। এরপর যখন গরু গরম হবে, তখন ১০০ মিলি. নিমতেল খাইয়ে, তারপর কৃত্রিম প্রজনন (AI) করানোর পর টানা এক সপ্তাহ ধরে একমুঠো কারিপাতা খাওয়াতে হবে।
ডাক না রাখা (Repeat breeding) –
গরুর ডাক না আসা যেমন একটি সমস্যা, তেমনি সমস্যা ডাক না রাখতে পারা। এর সমাধানের জন্য নিম্নলিখিত পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় –
১) কৃত্রিম প্রজননের পর প্রতিদিন দুমুঠো কারিপাতা খাওয়াতে হবে একটানা দশ দিন।
২) ২০০ গ্রাম করে লজ্জাবতী গাছ নিয়ে পাচন তৈরী করে তিনদিন খাওয়াতে হবে।
ফুল না পড়া –
অনেক সময় দেখা যায় বাচ্চা হওয়ার পরেও গরুর ফুল (placenta) আটকে থাকে। এর সমাধানের জন্য নিম্নোক্ত পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় –
১) এক কেজি লজ্জাবতী পাতা দিনে একবার করে দুদিন খাওয়াতে হবে।
২) একমুঠো বেলের পাতা, ৬ টি রসুনের কোয়া, দশটা গোলমরিচ ও ২ টি পেঁয়াজ নিয়ে ভালো করে পিষে একটু দুধের সাথে মিশিয়ে দিনে একবার করে খাওয়াতে হবে।
মাছি দূরীকরণ –
মাছি একটি বড় সমস্যা। এরা গরুর গায়ে খোলা ঘা থাকলে সেখানে ডিম পাড়ে এবং তার থেকে ম্যাগট জন্মায়। তাই মাছি দূর করতে নিন্মোক্ত উপায় অবলম্বন করতে হবে।
ঘৃতকুমারীর রস গরুর গায়ে লাগাতে হবে এবং আশপাশে ছড়িয়ে দিতে হবে।
চর্মরোগ –
১) যে কোন চর্ম রোগের জন্য নিম এক অব্যর্থ ওষুধ, শুধু সঠিক প্রয়োগবিধি জানা দরকার। চর্মরোগ সারাতে নিমের ছাল, পাতা ফুল একসাথে পিষে মণ্ড তৈরী করতে হবে। তারপর সেটা আক্রান্ত অংশে দিনে তিনবার লাগাতে হবে। এছাড়া নিমফল বেঁটে রস বের করে সেটি দিনে দু’-তিনবার লাগালেও কাজ হবে।
২) আমরা বলি বেগুনের কোন গুণ নেই। কিন্তু বেগুনের অনেক গুণ, সেটা ক্রমশঃ প্রকাশ্য। চর্মরোগ নির্মুল করতে বেগুনের সাথে জোয়ারের গুঁড়ো মিশিয়ে আক্রান্ত অংশে লাগাতে হবে।
ছত্রাকঘটিত সংক্রমণ (Fungal infections) –
১) রসুন পিষে লেই তৈরী করে আক্রান্ত অংশে লাগাতে হবে।
২) আগেই বলা হয়েছে, যে কোন চর্মরোগে নিম অব্যর্থ ঔষধ। নিমছাল পিষে আক্রান্ত অংশে লাগাতে হবে, যতদিন না সম্পূর্ণ ঠিক হয়।
উকুন –
১) গরু, ছাগলের গায়ের উকুন দূর করতে নিমপাতা ব্যবহার করা যায়। নিমপাতা বাটা সারা গায়ে লাগাতে হবে।
২) একভাগ আতার বীজ+ একভাগ নিমের বীজ+ একের পাঁচ ভাগ তামাক পাতা ভালো করে পিষে লেই তৈরী করে দুই লিটার জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে। এরপরে সেটি সারা গায়ে লাগাতে হবে।
খোস-পাঁজরা –
গবাদিপশুর খোস-পাঁজরা নিরাময়ের জন্য, একমুঠো দাদমর্দন গাছের শুকনো বা কাঁচা পাতা পিষে, জল বা লেবুর রসের সঙ্গে মিশিয়ে নারকেল ছোবড়ার সাহায্যে খোস-পাঁজরার উপর লাগাতে হবে যতদিন না সম্পূর্ণ নির্মূল হচ্ছে।
পরিশেষে একটি কথা বলা দরকার, এখানে যেসব পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে, সেগুলি সবই দেশীয় ও সাবেকি পদ্ধতি। তবে এসমস্ত চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করেও যদি গবাদিপশুর রোগ না সারে, তাহলে দেরী না করে অবশ্যই কোন প্রাণী চিকিৎসক এর সাথে যোগাযোগ করবেন। সবার কাছে একটি বিশেষ অনুরোধ, প্রাণী চিকিৎসক এর পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বা কোন অ্যালাপথি ঔষধ ব্যবহার করবেন না, তাতে হিতে বিপরীত হবে।
আরও পড়ুন - নতুন প্রজাতির এই রুই মাছের চাষে দ্বিগুণ লাভবান চাষি (New Species Of Rohu Fish)