কীটনাশক হল এমন একটি বস্তু, যার প্রয়োগের মাধ্যমে যেকোনো ধরনের কীট যেমন, পতঙ্গ ও জলজ আগাছাসমূহ এবং গাছের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা সম্ভব হয়। ১৯৪০ সালের পর থেকে কৃত্রিম কীটনাশকের বহুল উৎপাদন ও ব্যবহার ব্যাপকহারে চালু হয়েছে। কিন্তু কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগে বিষক্রিয়ায় প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে আমাদের শরীরে, সাথে সাথে জলজ প্রাণী তথা সমগ্র জীবকূলেরই ক্ষতিসাধন হয়।
এই বিষক্রিয়া আবার দুই ধরণের (Type of poisoning) -
তীব্র বিষাক্ততা বা বিষক্রিয়াঃ কোনো রাসায়নিক বা কীটনাশক খুব অল্প সময়ের ভিতর মানুষ, পশু বা গাছপালাতে যেসকল মারাত্মক তাৎক্ষণিক ক্ষতিসাধন করে, তা হল তীব্র বিষক্রিয়া। ক্ষতিকর বিষক্রিয়ার প্রভাব খুব অল্প সময়ের মধ্যে, মানে তৎক্ষণাৎ বা ২৪ ঘণ্টার ভিতর দেখা যায়। যে সকল কীটনাশকের তীব্র বিষক্রিয়া খুব বেশী হয়, তারা যদি খুব স্বল্পপরিমাণেও জীবদেহে শোষিত হয়, তা ঐ জীবের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
দীর্ঘস্থায়ী বিষাক্ততাঃ কোনো রাসায়নিক বা কীটনাশক উন্মুক্ত হওয়ার ফলে যে প্রলম্বিত ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, তা হল দীর্ঘস্থায়ী বিষক্রিয়া। দীর্ঘস্থায়ী বিষক্রিয়ার প্রভাব ৩ মাসের বেশী সময় পরেও লক্ষ্য করা যেতে পারে।
জলজ প্রাণীদের ওপর প্রভাব (Effects on aquatic animals) -
- বৃক্কের ওপর প্রভাবঃ দীর্ঘ সময়ের জন্য কীটনাশকের প্রভাবে উন্মুক্ত থাকার ফলে জলজ প্রাণীদের বৃক্কের আকার অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে।এই আকার বৃদ্ধি বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন বৃক্ক- কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি ও আকার বৃদ্ধির কারণে অথবা দূষিত পদার্থকে পরিপাক করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে। তবে আমরা এটা বলতে পারি যে, বৃক্কের যেসকল পরিবর্তন হোক না কেন তা মূলত ইহার শর্করা ও স্নেহপদার্থের ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে হতে দেখা যায়।
- বিপাক-ক্রিয়ার উপর প্রভাবঃ কীটনাশকের প্রভাবে মাছের বিপাক-ক্রিয়ার প্রথমদিকে তেমন কোনো পরিবর্তন না ঘটলেও দীর্ঘসময় পরে, বিপাক-ক্রিয়ার অতিসক্রিয়তা বিশাল আকারে লক্ষ্য করা যায়, যা দেহে অক্সিজেনের চাহিদাকে অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে মাছের মৃত্যু ঘটাতে পারে। অরগ্যানোক্লোরিন জাতীয় কীটনাশকের ক্ষেত্রে এই ঘটনাটি আরও প্রকটভাবে দেখা যায়।
- ফুলকার ওপর প্রভাবঃ ফুলকায় ক্ষত সৃষ্টি করে, ফুলকায় পচন ধরায়, ফুলকার আকার-আকৃতি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি করে, যা ক্যানসার ঘটাতে পারে, বা ক্যানসারের প্রধান কারণ হতে পারে, ফুলকার কোষগুলি লাল বর্ণ ধারণ করে ফুলে-ফেঁপে ওঠে। ফুলকার শ্লৈষ্মিক-গ্রন্থির অতিরিক্ত নিঃসরণ ঘটায়।
- মাছের প্রজননের ওপর প্রভাবঃ কীটনাশকের প্রভাবে মাছের ডিমের সংখ্যা হ্রাস পায়, শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর গুণগত মান হ্রাস পায়, কার্যকরী শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর সংখ্যা কমে যায়, যা মাছের প্রজননকে মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে, পরবর্তী প্রজন্মের মাছের মধ্যে গঠনগত অসামঞ্জস্য তৈরি করে, মাছের ডিম্বাশয় ও অণ্ডকোষের আকার- আকৃতি হ্রাস করে, যৌন-পরিপক্কতাকে প্রলম্বিত করে এবং পার্শ্ব-যৌন বৈশিষ্ট্যগুলির বহিঃপ্রকাশকে বাধা দেয়।
উপসংহারঃ
কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে কৃষিক্ষেত্রে ফলন এবং উৎপাদন বহুল পরিমাণে বেড়েছে। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে অতিরিক্ত মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারের ফলে তা জলজ পরিবেশে মাছ এবং অন্যান্য প্রাণীদের ওপর ও মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এছাড়াও দীর্ঘদীন ধরে অতিরিক্ত মাত্রায় কীটনাশকের ব্যাবহার অর্থনৈতিকভাবেও খুবই ব্যায়-সাপেক্ষ।