জলকৃষি বা অ্যাকোয়াকালচার (Aquaculture)-এর মাধ্যমে সামান্য ব্যবস্থাপনা ও ন্যূনতম প্রযুক্তি প্রয়োগে কতকিছুর যে পরিপোষণ সম্ভব, তা বলার নয়। বিভিন্ন মাছ, চিংড়ী, কাঁকড়া, ঝিনুক, গুগলী, কিছু প্রজাতির ব্যাঙ (সবুজ ব্যাঙ/সোনা ব্যাঙ) ছাড়াও স্বয়ংপোষিত স্বগুণসমৃদ্ধ জলজ উদ্ভিদ যেমন, ফার্ন জাতীয় ভাসমান অ্যাজোলা, স্পাইরুলিনা, বাহারি নরম ঝাঁঝি, জলপালং, নানা ধরণের অনুশৈবাল, ঔষধি গুণযুক্ত শাক – শুষনি, ব্রাহ্মী, কলমি, কুলেখাড়া, হেলেঞ্চা এবং অর্থকরী ফসল – শালুক, শোলা, মাখনা, পানিফল ও সর্বোপরি পদ্ম (আমাদের বেশ কয়েকটি পড়শি দেশ – মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া/কামপুচিয়া পদ্মের সিল্ক উৎপাদন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে)।
আমাদের দৈনন্দিন খাবারে বৈচিত্র্য ও অনুপুষ্টির সম্ভার জোগাতেও কত মানুষের জীবিকার সংস্থান করতে পারে প্রায় শতেক দেশীয় ছোট মাছের চাষ। আমাদের রাজ্যের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অযত্নে লালিত এবং প্রায় অনাবাদী পড়ে থাকা পুকুর, ডোবা, খাল, বিল, করঞ্জলী (যা প্রায় কয়েক লক্ষ হেক্টর পরিমাণ হবে), যা মিষ্টি জলের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার, বা খাদ্য সুরক্ষার উৎস হতে পারে তাই নয়, ভূগর্ভে ক্রমশই কমে আসা জলস্তরের ঘাটতি পূরণ করে ভূপৃষ্ঠের জল যোগান দিয়ে আর্থ সামাজিক উন্নতি বিধানে ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে, নচেৎ অকৃপণ সূর্যকিরণে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সালোকসংশ্লেষের পূর্ণ সদ্ব্যবহার থেকে বঞ্চিত থেকে যাবো আর বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য ব্যহত হবে এবং ক্রমশই এই সব জলাশয়ে আগাছা পরিপূর্ণ হয়ে মশা মাছির সূতিকা গৃহই থেকে যাবে পতিত ও অনাবাদী অবস্থায়।
জল কৃষির মাধ্যমে এই অনাবাদী মজা জলাশয়ে আবাদ করতে দরকার জল পরিশোধন, যা সহজেই অ্যাজোলা, বিভিন্ন গুঁড়িপানা (লেমনা, উলফিয়া, স্পাইরোডেলা) –র সাহায্যে হতে পারে। অনেক সময় ইউট্রোফিকেশনের কারণে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটতে পারে। জলে ক্লোরোফিলের পরিমাপ করে সহজেই প্রাথমিক উৎপাদন সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব এবং তা জেনে নিয়ে এই জলজ উদ্ভিদগুলির সহায়তায় জল পরিশোধিত করে সেখানে মাছ চাষ, রাজ্যে তথা দেশে মৎস্য চাষের এক সম্ভবনাময় দিগন্ত খুলে দিতে পারে। গ্রাস কার্প, সিল্ভার কার্প, মৃগেল, উন্নত মানেরতিলাপিয়া (GIFT প্রজাতি) শিঙ্গি, মাগুর চাষ করা সম্ভব শুরুতেই। এতে মশার লার্ভা বা কোন পোকামাকড়ের উৎপাত তো থাকবেই না, জল পরিষ্কার থেকে পরিবেশেরও উন্নতি ঘটবে। এইভাবে জলকৃষির মাধ্যমে জলকে দূষণমুক্ত করে মাছের পালন সম্ভব হতে পারে। জলাশয়গুলিও কিছুটা বায়ুমন্ডলীয় তাপ শোষণ করে নিয়ে উষ্ণায়নের প্রতিকূলতার প্রভাব কিছুটা হলেও কমাতে পারে।
আমাদের এই জাতীয় অনাবাদী পুকুরগুলির রক্ষণাবেক্ষণের অভাব হয় যে সব কারণে তার একটি হল বহু মালিকানাধীন জলাশয়। পশ্চিমবঙ্গ অন্তর্দেশীয় মৎস্য আইন (সংশোধিত) অনুযায়ী, যদি এইরূপ জলাশয়ে উপযুক্তভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করা হয়, বা যথাযথভাবে মাছ চাষ না করা হয়, সেক্ষেত্রে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ জলাশয়টির নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালন কোন রেজিস্ট্রিকৃত গোষ্ঠী দীর্ঘমেয়াদী ইজারা দিয়ে দিতে পারলে অব্যবহৃত জলাশয়গুলি জৈবিকভাবে মাছ চাষের উপযুক্ত হতে পারে।
আরও পড়ুন - অল্প মূলধন বিনিয়োগের মাধ্যমে গ্রামীণ যুবকরা তিলাপিয়া মাছের চাষ করে আয় করুন অতিরিক্ত
পুকুরগুলির সংস্কারে রাজ্য মৎস্যদপ্তর (ব্লক ও জেলা স্তরের আধিকারিকদের ও মীন মিত্রদের সহায়তায়) জেলার কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের মৎস্য বিশেষজ্ঞের সাহায্যে ICAR গবেষণা প্রতিষ্ঠান রাজ্যপ্রাণী ও মৎস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক/বিভিন্ন NGO –র মৎস্য বিশারদের ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ মাছচাষিদের অনুপ্রাণিত করতে পারে। সম্প্রতি সোনারপুরে অবস্থিত শস্যশ্যামলা কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র একটি ভ্রাম্যমাণ মৎস্য স্বাস্থ্য পরীক্ষাগার চালু করেছে। তাঁদের সাথে দূরাভাষ বা বা সরাসরি যোগাযোগ করে জল-মাটি পরীক্ষা, চাষের পরিকল্পনা করা, ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলি নির্ধারণ করা ও সেই মতো ব্যবস্থা নেওয়া, ভালো মাছের চারা, খাবার প্রস্তুত ও প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া সম্ভব।
এর ফলে মাছ উৎপাদন আশাব্যাঞ্জকই শুধু হবে না, জলাশয়ের পরিবেশ দূষণমুক্ত থাকবে। গুণগত মানের মাছের পোনা উপযুক্ত সংখ্যা ও অনুপাতে মজুত করে, সম্পূরক খাবার, বায়ু সঞ্চালন, প্রয়োজনে চুন ও জৈব সারের প্রয়োগে মাছ চাষের পরিবেশও ও অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি হবে এবং অঞ্চলে পুকুর ও জলাশয়গুলি থেকে আয়ের সংস্থান হবে এবং এগুলিকে কেন্দ্র করে চাষের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম/উপকরণ নিয়ে স্থানীয় যুবক/যুবতী ব্যবসা করেও আয়ের পথ খুঁজে পেতে পারেন।
আরও পড়ুন - জানুন ডিম উৎপাদনে সক্ষম সোনালী মুরগি পালনের জন্য কি কি করণীয়