ধানের জমিতে চিংড়ি মাছ চাষ করা যায়। এধরনের চাষকে সমন্বিত চিংড়ির চাষ বলা হয়। এই চাষে ধানের জমিতে চিংড়ি, ধান ও শাক সবজি একসাথে চাষ করা হয়। এই ধরনের চাষে জমির চারপাশে উঁচু আল তৈরি করে এর ভেতরে ড্রেনের মতো তৈরি করে তাতে জল জমিয়ে রেখে চিংড়ি মাছের চাষ করা হয় আর জমির সমতল জায়গায় ধান ও শাক সবজি চাষ করা হয়।
সমন্বিত চিংড়ি চাষের উপায়
এই চাষ থেকে ভালো ফল পেতে হলে কিছু পদ্ধতি মেনে চলতে হয়। সেই সব পদ্ধতি নিচে আলোচনা করা হোল।
১) সঠিক জমি নির্বাচন - সবার আগে সঠিক জমি নির্বাচন করতে হবে। যে জমিতে বালি আছে সেখানে এই চাষ করা যাবে না কারণ বালি জমিতে জল ধরে রাখা যাবে না। এই চাষের জন্য নিচু ধানের জমি উপযুক্ত। যে জমিতে ৬ থেকে ১০ মাস জল ধরে রাখা যায় তা এই চাষের জন্য আদর্শ। জমিতে যেন কাদা মাটি বেশী থাকে।
২) জমির পরিকাঠামো তৈরি করা - এর পর জমির পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে। জমির পাশে উঁচু, মোটা ও চওড়া এবং জলের স্তর থেকে এক হাত উঁচু আল তৈরি করতে হবে। এই আল তৈরি করলে জমিতে জল ধরে রাখা যায় ও চিংড়ি মাছ অন্য কোনো জমিতে যেতে পারে না। এর ফলে বাইরের পচা জলও ভিতরে আসতে পারবে না। এরপর ওই আলের ভেতরে ড্রেন তৈরি করতে হবে। আলের ভেতরের দিকে ৩-৪ ফুট জায়গা ছেড়ে দিয়ে ৬-১০ ফুট চওড়া ও ৩-৫ ফুট গভীর ড্রেন তৈরি করতে হবে। এই ড্রেন মাছের থাকার জায়গা হবে। রোদে জল গরম হলে মাছরা ড্রেনের ঠাণ্ডা জলে থাকতে পারবে। এখানে চিংড়ি মাছকে খাওয়ানো যেতে পারে। যদি চাষের জমি বড় হয় তাহলে জমির তিনদিকে ড্রেন করতে হবে আর জমি যদি ছোটো হয় তাহলে জমির দুদিকে ড্রেন করলেই চলবে। চিংড়ি মাছের চারাগুলোকে প্রথমেই চাষের জায়গাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত না। জমির পাশে ছোটো পুকুর তৈরি করতে হবে যাকে নার্সারি পুকুর বলা হয়। এই পুকুরে ৩০ থেকে ৩৫ দিন মাছের চারাগুলোকে রাখতে হবে। এই পুকুরের আকার মাছের সংখ্যা ও জমির পরিমাণের উপর নির্ভর করে। জমির ৩-১০ শতাংশ এবং ৩-৫ ফুট গভীর হবে এই পুকুরটি।
জমির প্রস্তুতি - চিংড়ি চাষে ভালো ফল পেতে হলে জমিকে সঠিক ভাবে প্রস্তুত করতে হবে। যার জন্য সঠিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। প্রথমে দেখতে হবে যাতে জমির পাড়ে কোনো বড় গাছ না থাকে যাতে করে সূর্যের আলো ভালো করে জমিতে প্রবেশ করতে পারে। জমির পাড়ে আগাছা থাকলে বা গর্ত থাকলে সেখানে সাপ বা বেজী থাকতে পারে যারা মাছের চারা বা পোনা খেয়ে নিতে পারে। পাড় যেন ভাঙ্গা না থাকে থাকলে পরে বন্যার জল বা পাশের জমির জল ঢুকে পরতে পারে। জমিতে আগাছা থাকলে সেই আগাছা পচে গেলে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করতে পারে যার ফলে জমি দুষিত হয়ে পড়বে এবং চাষের ক্ষতি হবে। যে সব খাদ্য চিংড়ি মাছকে দেওয়া হয় তার পুরোটা মাছ খায় না তাই বাকী খাবারের অংশ জমিতে পরে থাকে এবং পচে যায় এর ফলে গ্যাস হয় আর জমি দুষিত হয় আর চাষের ক্ষতি হয়, তাই ওই সব খাবারের অংশ তুলে ফেলতে হবে। জমির অতিরিক্ত কাদা তুলে ফেলতে হবে কিন্তু নতুন চিংড়ি চাষ করলে প্রথম ৩ বছর জমি থেকে কাদা তোলার দরকার নেই।
চুনের ব্যবহার - চিংড়ির চাষে চুনের ব্যবহার অতি গুরুত্বপূর্ণ। চুনের ফলে মাটি ও জলের জীবাণু নষ্ট হয়ে যায়। চুনে ক্যালসিয়াম থাকে যা মাছের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। চুন রোগ প্রতিরোধ করে। চুন প্রয়োগের ফলে সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। জলের ঘোলাটে ভাব চুনের ফলে কমে যায় ফলে জলে সূর্যের আলো ঢুকতে পারে। জমি শুকনো অবস্থায় চুন গুড়ো করে ছিটিয়ে দিতে হবে। জমিতে জল থাকলে গর্তে ৮-১০ ঘণ্টা আগে চুন ভিজিয়ে রাখতে হবে।
সারের ব্যবহার - জমিতে চুন দেওয়ার ৫ থেকে ৭ দিন পরে জমিতে প্রাকৃতিক খাবারের জন্য জৈব সার বা সবুজ সার অথবা প্রয়োজনে অজৈব সার ব্যবহার করতে হবে। সার প্রয়োগের সময় জলে প্রাকৃতিক খাবার তৈরি হয়। বিভিন্ন রকম শেওলা ও প্রাণীর কণা হল এই প্রাকৃতিক খাদ্য। সার দেবার ৫-৭ দিনের মধ্যে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয়। জলের রঙ হালকা সবুজ ও লালচে হলে বুঝতে হবে খাদ্য তৈরি হয়েছে।
চিংড়ির চারা মজুত করা - সমন্বিত চিংড়ি চাষে চারা মজুত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সময় মাছের সবথেকে বেশী ক্ষতি হতে পারে। এই সময় ৩০ থেকে ৩৫ দিন চারাগুলোকে যত্ন করে রাখতে হবে তাহলে পরে এদের ক্ষতির আশঙ্কা কম থাকে। সঠিক যত্ন করলে চারার মৃত্যুর হার অনেক কম হয়।
চিংড়ির নার্সারি - জমিতে ছোটো পুকুরে চারা চিংড়ি থেকে সঠিকভাবে পালন করে জুভেনাইল চিংড়িতে রূপান্তরিত করাকে চিংড়ির নার্সারি বলে। চারা অবস্থায় চিংড়ি মাছের যথেষ্ট যত্নের প্রয়োজন কারন এই সময় এরা দুর্বল থাকে। তাছাড়া এই সময় সাপ, বেজি এদের থেকে বাঁচার ক্ষমতা এদের থাকে না তাই এই সময় এদের দিকে নজর রাখতে হবে। এই সময় এদের পালন করার জন্য কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। নার্সারি পুকুরের আকার জমির ৫-১০ শতাংশ হলে ভালো। পুকুরের গভীরতা হবে ৩-৪ ফুট এরফলে ভালো পরিমাণে সূর্যের আলো পাওয়া যাবে। পুকুরের তলা ভালো করে শুকিয়ে নিতে হবে আর আগাছা দূর করতে হবে। পুকুরে চুন দিতে হবে।
চিংড়ির চারার খাদ্য - চিংড়ি মাছ শুধু প্রাকৃতিক খাবার খায় না তাই তাদের পরিপূরক খাবারও দিতে হবে। চারা মজুতের প্রথম সাত দিন পর্যন্ত ৫০০০ চারার জন্য সন্ধ্যাবেলা একমুঠো সুজি দেওয়া যেতে পারে। এরা সাধারণত রাতে খায়। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে প্রতি ১ কেজি খাবারে ৪০০ গ্রাম মাছের গুড়ো বা মাংসের গুড়ো, ৪০০ গ্রাম সয়াবিন, ১০ গ্রাম চিটেগুড় আর ১০ গ্রাম আটা মিশিয়ে ছোটো বলের আকারে তৈরি করে দিতে হবে।
চারা চাষের সময় মনে রাখতে হবে -
- সন্ধ্যার পর চারা মজুত করতে হবে।
- সন্ধ্যার পর খাবার দিতে হবে।
- চারাদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
- এইভাবে চাষ করলে ফল ভালো পাওয়া যাবে।
- দেবাশীষ চক্রবর্তী