কৃষিজাগরন ডেস্কঃ প্রায় ১০ কোটি বছর আগে এই পৃথিবীতে সপুষ্পক উদ্ভিদের সৃষ্টি হয়।তার প্রায় সাথে সাথেই পরাগযোগের মাধ্যম হিসেবে আবির্ভাব হয় মৌমাছিদের।আর মানবসভ্যতার সাথে মৌমাছিদের সরাসরি পরিচয়ের প্রমাণ মেলে ১৫০০০ বছর পুরনো স্পেনের প্রাচীনগুহাচিত্রে। আমাদের পূর্বপরুষেরা সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই বুনো মধু আহরণে অভ্যস্ত ছিলেন।মধুর ব্যবহারের প্রমান মেলে ৫০০০ বছর আগে লেখা ঋকবেদেও।তখন পাহাড়-জঙ্গল থেকে মৌচাক ভেঙ্গে মধু সংগ্রহ করাই ছিল রীতি। ধীরে ধীরে সভ্যতার হাত ধরে এগোতে এগোতে শুরু হয় কৃত্রিম ভাবে মৌমাছিদের পালনকরা।এই ব্যাপারে আমাদের প্রথম পথ দেখায় প্রাচীন মিশরীয়রা। শুরু হয় গাছের ফাঁপা গুঁড়ি, পোড়ামাটির পাত্র, বাঁশের ঝুড়ি, প্রভৃতির মধ্যে মৌমাছিপালন। আর আজ, উন্নততর ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌমাছিপালন অনেকের কাছেই একপ্রকার স্বনির্ভর উদ্যোগের তথা বিকল্প আয়ের মাধ্যম রূপে সুপরিচিত।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌমাছি পালনে প্রয়োজনীয় উপকরণ
১। মৌ-বাক্স (বি-হাইড): মৌমাছিদের কলোনি স্থাপনের জন্য সঞ্চারণশীল ফ্রেম সহ একটি বিশেষ কাঠের বাক্স।
২। মধু নিষ্কাশন যন্ত্র (হানি এক্সট্রাক্টর): মৌচাকের কোনো ক্ষতি না করে তা থেকে মধু নিষ্কাশন করার একটি যন্ত্র বিশেষ।
৩। ধোঁয়াদানী: মৌ-কলোনি নিরীক্ষণ ও মধু নিষ্কাশনের সময় মৌমাছিদের সহজে নাড়াচাড়া করার জন্য এই যন্ত্রের সাহায্যে পরিমিত ধোঁয়ার ব্যবহার করা হয়।
৪। মুখ ঢাকার টুপি ও আবরণ (ফেস ভেল): মৌমাছির হুল থেকে মুখকে রক্ষা করার জন্য ব্যবহৃত আচ্ছাদন সহ বিশেষ টুপি।
৫। মৌ দস্তানা (বি গ্লাভস): নির্বিঘ্নে মৌচাক নিরীক্ষণের জন্য চামড়া কিংবা ত্রিপলের কাপড় দিয়ে তৈরি উচ্চমানের দস্তানা।
আরও পড়ুনঃ বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে মৌমাছি পালন
৬। ছুরি: মধু ভর্তি মৌকোষের মোমের আবরণ কাটার জন্য ব্যবহৃত ধারালো ছুরি।
৭। হাইড টুল: ভোঁতা, বাটালি জাতীয় ও দুইপ্রান্ত চ্যাপ্টা আকৃতির এই ধাতব টুকরোটি সাধারণত মৌচাকের ফ্রেমগুলি তুলতে, মৌমাদির আঠা এবং মৌচাকের অতিরিক্ত বৃদ্ধিস্রান্ত মৌ-কোষগুলি ছেঁটে ফেলতে ব্যবহৃত হয়।
৮। মৌ বুরুশ (বি ব্রাশ; মধু নিষ্কাশনের জন্য মৌচাক নিয়ে যাওয়ার আগে তা থেকে সমস্ত মৌমাছিদের ঝেড়ে ফেলতে এই ব্রাশটি ব্যবহার করা হয়।
৯। ঝাঁক ধরার জাল: লম্বা হাতল যুক্ত, জাল দিয়ে তৈরি একটি বিশেষ খলি, যা মৌমাছির ঝাঁক ধরার জন্য ব্যবহৃত হয়।
১০। রানীকোষ রক্ষক: রানী বিহীন কোনো মৌ-কলোনিতে যখন নতুন রানিকোষ উপস্থাপন করা হয় তখন সেই কোষটি একটি কোষ রক্ষক খাঁচা দ্বারা আবৃত থাকে, যতক্ষণ না অন্যান্য মৌমাছিরা তাকে গ্রহণ করছে। পাতলা পাত বা তার দিয়ে তৈরি এই খাঁচাগুলি মৌমাছিদের মৌকোষ নষ্ট করতে বাধা দেয়।
১১। রানী থাঁচা (কুইন কেজ): কলোনিতে নতুন রানী উপস্থাপন করার সময় প্রথমে তাকে একপ্রকার বিশেষ ধরনের প্লাস্টিকের অথবা তারের খাঁচায় আবদ্ধ করে সেই কলোনিতে রাখা হয় যাতে ওই কলোনির অন্যান্য মৌমাছিরা তার কোন ক্ষতি না করতে পারে। এইভাবে ১২ ঘণ্টা আবদ্ধ থাকার পর রানী ও কলোনির গন্ধ যখন এক হয়ে যায় তখন রানীকে খাঁচা মুক্ত করা হয়।
মৌমাছি পালনে দরকার ঋতু ভিত্তিক পরিচর্যা
ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে আবহাওয়ার তারতম্য ঘটে, আর তার জেরে আশেপাশের গাছ-গাছালি ও ফুলে বৈচিত্র্য দেখা যায়। তাই সুষ্ঠুভাবে মৌমাছি পালনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পরিচর্যার প্রযোজন হয়।
আরও পড়ুনঃ থাকার জন্য এসি রুম, ডায়েটে ড্রাই ফ্রুটস, ১০ কোটি টাকার এই মহিষ এসেছে পাটনার কৃষক মেলায়
বসন্তকালীন পরিচর্যা
বসন্তকাল আমাদের দেশে সবচেয়ে মনোরম ঋতু। এই সময় প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরনের ফুল, যেম সর্ষে, তিল, ধনে, কালো জিরে, সূর্যমুখী, খেসারী, লিচু, সজনে, খলসি (ম্যানগ্রোভ), ইত্যাদি দেখা যায়। তাই এই সময়কে "মধু প্রবাহ ঋতু" বলা হয়। এই সময় কর্মী মৌমাছিরা মকরন্দ ও পরাগরেণু সংগ্রহে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকে। এই ঋতুতেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে মধু উৎপাদিত হয়। আবার এই ঋতু মৌমাছিদের প্রজননের জন্যও সবচেয়ে আদর্শ। তাই এই সময় নিম্নলিখিত পরিচর্যা ও সতর্কতা গ্রহণ করা উচিত:
১। মৌ-বাক্সের মেঝেতে পড়ে থাকা মৃত মৌমাছি, শুকনো পরাগ এবং সঞ্চয় কুঠুরির ঢাকনা ইত্যাদি সময় মতো পরিস্কার করা উচিত।
২। মৌ-বাক্সে যাতে সঠিক ভাবে বায়ু চলাচল করে তা লক্ষ রাখা উচিত
৩।অধিক মধু সঞ্চয়ের জন্য প্রজনন কক্ষের উপর প্রয়োজন অনুসারে এক বা একাধিক সুপার চেম্বার সংযোজন করা দরকার
৪। সুপার চেম্বারের ফ্রেমগুলি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও সময়মতো মধুপূর্ণ ফ্রেমগুলি খুলে মধু নিষ্কাশন করতে হবে।