কৃষিজাগরণ ডেস্কঃ মাছে-ভাতে বাঙালি! বাঙালির পাতে মাছ না পড়লে পঞ্চব্যঞ্জনের সমাহারও যেন ফিকে হয়ে পড়ে। বিয়েবাড়ি থেকে পৈতে বাড়ি আমিষের পদে মাছের জায়গা এক আলাদা উচ্চতায়। অর্থনীতির দিক থেকে প্রধানত আমিষের চাহিদা পূরণ করার জন্য মৎস্য সম্পদের ভূমিকা বলাই বাহুল্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রয়েছে। এখনকার এগিয়ে চলা পৃথিবী পুরোপুরি ভাবে প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল। জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আধুনিক কলাকৌশল ও প্রযুক্তির ব্যবহারে প্রাণী জগতে মনুষ্য সম্প্রদায়ের অবদান বিপুল। গোটা বিশ্বের উৎপাদন কৌশল বর্তমানে বাণিজ্যের উপর দাঁড়িয়ে। অল্প শ্রম ও পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে বেশি পরিমাণে মুনাফা অর্জন এর প্রধান উদ্দেশ্য। মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও এর অনথ্য নয়। বিশ্ব জুড়ে সব দেশে বৈজ্ঞানিক কৌশলে উন্নত জাতের মাছের চাষ হয়ে চলেছে। জায়গায় জায়গায় মৎস্য খামার গড়ে ওঠা এর প্রধান দিক।
মৎস্য চাষ প্রযুক্তি খুবই সহজ এক পদ্ধতি। এই চাষ শিখে ফেললে আমাদের দেশের শিক্ষিত বেকার ও নিরক্ষর লোকজন অর্থের মুখ দেখবেন। এই বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাছ চাষের জন্য প্রয়োজন উন্নত জাতের পোনা, যা দ্রুত বেড়ে চলতে পারে। নিয়ম অনুসরণ করলেই মাছের পোনা কয়েক মাসের মধ্যে দ্রুত বাড়তে পারে।
পুকুরে রাক্ষুসে মাছ থাকলে মাছের চাষ ভালো হয় না। রাক্ষুসে মাছের উদাহরণ স্বরূপ বলা চলে শোল, গজার, টাকি প্রভৃতি মাছের কথা। এরা মাছের বাচ্চা খেয়ে ফেলে। তাই মাছ চাষের শুরু করার আগে পুকুরের সব জল শুকিয়ে ফেলে রাক্ষুসে মাছ সরাতে হবে। বড় আকারের গাছের ছায়া পুকুরে পড়লে ডালপালা ছেঁটে দেওয়া উচিত। প্রথম অবস্থায় পুকুরে চুন দিতে হবে। পাত্রে চুন ফুটিয়ে নিয়ে জলে মেশানো চুন পুকুরে ছিটিয়ে দেওয়া উচিত। চুনের মাত্রা প্রতি শতাংশে এক কেজি হলে ভালো। পুকুরে চুন দেওয়া হয়ে গেলে, পাঁচ দিন পর সার দিতে হবে। জৈব ও রাসায়নিক দুই ধরণের সারই পুকুরে দেওয়া প্রয়োজন। গোবর ও হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা জৈব সার হিসাবে উত্তম বলে ধরা হয়। প্রতি শতাংশে এসব সারের মাত্রা ইউরিয়া ১২৫ গ্রাম, টিএসপি ৬৫ গ্রাম এবং এমপি ২০ গ্রাম। জৈব ও রাসায়নিক দুই ধরনের সারই একসঙ্গে নিয়ে একটি পাত্রে জল দিয়ে ভালোভাবে গুলে নিতে হবে। তারপর এই মিশ্রিত সার পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুর তৈরি হয়ে গেলে, ১০-১৫ দিন পর ১০-১৫ সেন্টিমিটার সাইজের ভালো প্রজাতির পোনা ছাড়তে হবে। বেশি উৎপাদনেই জন্য পুকুরে একসঙ্গে ৭-৮ ধরনের মাছ ছাড়তে হবে। বিভিন্ন ধরনের পোনা ছাড়া হলেও সেগুলির আকার সমান হলে ভালো। পোনা ছাড়ার পর দিন থেকে খাবার দেওয়া উচিত। মাছের মোট ওজনের শতকরা ২ ভাগ হারে প্রতিদিন খাবার দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ পুকুরে বিভিন্ন মাছের মোট ওজন যদি ১০০ কেজি হয় তবে প্রতিদিন মাছের খাবার দিতে হবে ২ কেজি। খাবারের অর্ধেক হবে কুঁড়া এবং বাকি অর্ধেক হবে সরিষার খৈল ও চালের কুঁড়া যা হাঁড়িতে রাতের বেলা ভিজিয়ে রাখতে হবে। সকাল হলে খৈল ও কুঁড়া দিয়ে গোল বল বানিয়ে নিতে হবে। খাবার দেওয়ার আগে পুকুরের চার কোণায় মুখ বড় দেখে চারটি হাঁড়ি বসাতে হবে।
পতিত পুকুরে মাছ চাষের পদ্ধতি
খাঁচা তৈরির মধ্যে দিয়ে : প্লাবিত জলাশয়ের গভীর অঞ্চলে খাঁচা তৈরি করে নিয়ে মাছ উৎপাদন করা যায় তবে এ পদ্ধতিতে তেলাপিয়া বা নাইলোনাটিকার চাষ করলে কম টাকায় বেশি উৎপাদন করা যায়।
কাঠা বা কমর তৈরি করে : এই পদ্ধতির চাষে কাঠা বা কমর বানিয়ে গাছপালার ডাল দিয়ে মাছের বাসস্থান তৈরি করতে হবে। জীবজন্তুর নাড়ি-ভুঁড়ি এবং বর্জ্য দিয়ে কাঠা দিলে মাছগুলো আশ্রয় ও খাদ্যের জন্য একত্রিত হয়। গাছপালার ঝাঁক থেকে তৈরী হওয়া শ্যাওলা খেয়ে মাছ বড় হতে থাকে। প্রতি তিন মাস বাদে ঝাঁক তুলে বড় মাছ বাজারে পাঠালে অর্থনৈতিক ভাবে লাভের মুখ দেখবেন চাষিরা।
ধানক্ষেতে মাছ চাষ : নিচু জমির পাড় দিয়ে জমিতে জল ঢোকানোর পর পাড় মেরামত করে ধানি জমিতে মাছ চাষের পদ্ধতিও বহুল ভাবে জনপ্রিয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রতি শতাংশ জলাশয়ের জন্য ৩০টি সরপুঁটি, ২০টি কমন কার্প হিসেবে পোনা ছাড়তে হবে। মাছের মল সার হিসেবে একপ্রকারে জমির ধানের ফলন বৃদ্ধি করে।
আরও পড়ুনঃ লাম্পি সংক্রমিত গবাদি পশুর দুধ খাওয়া কি মানুষের জন্য বিপজ্জনক?
মাছ তোলার উপযুক্ত সময় : নিয়ম মেনে মাছ চাষের পর ৩-৪ মাস হলেই বড় মাছগুলো তুলে নিতে হবে। সাধারণত ৪০০-৫০০ গ্রাম ওজনের মাছ তুলে নিয়ে নতুন ভাবে বেশি করে পোনা ছাড়তে হয়। এই নিয়ম মেনে চললে আর্থিক লাভের পরিমান চাষি ভাইদের দ্বিগুন হয়ে উঠবে।