আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরণের ছাগল পালন করা হয়৷ তবে পশ্চিমবঙ্গের আবহাওয়ায় মূলত ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল (Black Bengal) পালন করা হয়। এছাড়া এখন বিটল, বারবারি, যমুনাপারি ছাগলের (Goat Breed) চাহিদাও বাড়ছে একটু একটু করে৷ বেশি পরিমাণে দুধ এবং মাংসের জন্য এই জাতের ছাগল পালনে উৎসাহ প্রকাশ করছেন পশুপালকেরা৷ তবে যে জাতেরই হোক ছাগল পালন যারা করতে চান তাদের প্রতিদিনই প্রতিটি ছাগলের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে, যেমন প্রথম পাঁচ দিন সকাল ও বিকালে দু’বার থার্মোমিটার দিয়ে ছাগলের দেহের তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে হবে। হঠাৎ কোন রোগ দেখা মাত্রই পশুচিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে, ইত্যাদি। এছাড়াও দরকার আরও কিছু ব্যবস্থাপনা, আজ আমরা সেই নিয়েই আলোচনা করব।
বাংলার কালো ছাগল ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিবেচ্য গুণাবলী –
পাঁঠার ক্ষেত্রে –
পাঁঠার বয়স ১২ মাসের মধ্যে হতে হবে, অণ্ডকোষের আকার বড় এবং সুগঠিত হতে হবে।
পিছনের পা সুঠাম ও শক্তিশালী হতে হবে।
পাঁঠার মা, দাদী বা নানীর বিস্তারিত তথ্যাদি (অর্থাৎ তারা বছরে দু’বার বাচ্চা দিত কিনা, প্রতিবারে একটির বেশীর বাচ্চা হত কিনা, দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ইত্যাদি গুণাবলী) সন্তোষজনক বিবেচিত হলেই ক্রয়ের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
ছাগীর ক্ষেত্রে –
নির্বাচিত ছাগী হবে অধিক উৎপাদনশীল বংশের ও আকারে বড়।
নয় বা বারো মাস বয়সের ছাগী (গর্ভবতী হলেও কোন সমস্যা নেই) কিনতে হবে।
ছাগীর পেট তুলনামূলকভাবে বড়, পাঁজরের হাড় চওড়া, প্রসারিত ও দুই হাড়ের মাঝখানে কমপক্ষে এক আঙ্গুল ফাঁকা জায়গা থাকতে হবে।
নির্বাচিত ছাগীর ওলান সুগঠিত ও বাঁট সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়াদি (Health management) –
গ্রহণযোগ্য ছাগল অবশ্যই সকল ধরণের সংক্রামক ব্যাধি, চর্মরোগ, চক্ষুরোগ, যৌনরোগ ও বংশগত রোগমুক্ত হতে হবে। পিপিআর খুবই মারাত্মক রোগ হওয়ায় কোন এলাকা থেকে ছাগল সংগ্রহ করার আগে উক্ত এলাকায় পিপিআর রোগ ছিল কিনা, তা জানতে হবে। উক্ত এলাকা কমপক্ষে ৪ মাস আগে থেকে পিপিআর মুক্ত থাকলে তবেই সেখান থেকে ছাগল সংগ্রহ করা যেতে পারে।
জৈব নিরাপত্তা –
খামার এলাকার বেড়া বা নিরাপত্তা বেষ্টনী এমনভাবে নির্মাণ করতে হবে, যাতে সেখানে অনাকাঙ্খিত ব্যক্তি, শেয়াল, কুকুর ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী প্রবেশ করতে না পারে। প্রবেশ পথে ফুটবাথ বা পা ধোয়ার জন্য ছোট চৌবাচ্চায় জীবাণুনাশক মিশ্রিত জল রাখতে হবে। খামারে প্রবেশের আগে গমনকারী তার জুতা/পা ডুবিয়ে জীবাণুমুক্ত করবেন।
খামারের জন্য সংগৃহীত নতুন ছাগল সরাসরি খামারে পূর্বে বিদ্যমান ছাগলের সাথে রাখা যাবে না। নতুন আনিত ছাগলদের স্বতন্ত্র ঘরে সাময়িকভাবে পালনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ধরণের ঘরকে পৃথকীকরণ ঘর বা আইসোলেশন শেড বলে। অন্ততপক্ষে দু’ সপ্তাহ এই শেডে রাখা বিশেষ জরুরি। এসব ছাগলের জন্য প্রাথমিক কিছু চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
প্রথমে এদেরকে কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে। এজন্য বহিঃপরজীবী এবং আন্তঃপরজীবীর জন্য কার্যকর কৃমিনাশক প্রয়োগ করতে হবে। চর্মরোগ প্রতিরোধের জন্য প্রতিটি ছাগলকে ০.৫% ম্যালাথিয়ন দ্রবণে স্নান করাতে হবে।
আইসোলেশন শেডে ছাগল রাখার পর ১৫ দিনের মধ্যে যদি কোন রোগ না দেখা দেয়, তাহলে প্রথমে পিপিআর রোগের ভ্যাকসিন এবং ৭ দিন পর গোটপক্সের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে। শেষ টিকা প্রদানের ৭ দিন পর ছাগলগুলিকে মূল খামারে নেওয়া যেতে পারে।
মনে রাখবেন, প্রতিদিন সকাল এবং বিকালে ছাগলের ঘর পরিষ্কার রাখতে হবে। কোন ছাগল যদি অসুস্থ হয়, তাহলে তাকে আলাদা করে আইসোলেশন শেডে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি কোন ছাগল মারা যায়, তবে অবশ্যই তার কারণ সনাক্ত করতে হবে। ল্যাবরেটরিতে রোগ নির্ণয়ের পর তদানুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বিশেষ করে অন্যান্য ছাগলের জন্য নিতে হবে। মৃত ছাগলকে খামার থেকে দূরে নিয়ে মাটির গভীরে পুঁতে বা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগাক্রান্ত ছাগলের ব্যবহার্য সকল সরঞ্জামাদি ও দ্রব্যাদি সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
ছাগলের বাসগৃহ –
ছাগলের ঘর শুষ্ক, উঁচু, জল জমে না, এমন স্থানে স্থাপন করা উচিৎ। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বি, দক্ষিণ দিক খোলা এমনভাবে করতে হবে। এছাড়া জল নিষ্কাশনের জন্য উত্তম ব্যবস্থা আছে, এমন স্থানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ছাগল ঠাসাঠাসি অবস্থায় বাস করতে পছন্দ করে না। এরা মুক্ত আলো, বাতাস এবং পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন স্থানে থাকতে পছন্দ করে।
এক জোড়া ছাগলের জন্য ৫ ফুট লম্বা, ১.৫ ফুট চওড়া এবং ৬ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট খোঁয়াড় প্রয়োজন। প্রতিটি পূর্ণ বয়স্ক ছাগলের জন্য গড়ে ১০-১৮ বর্গফুট এবং বাড়ন্ত বাচ্চার জন্য ৩-৮ বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন। ছাগলের ঘর খড়, টিন বা ইঁট নির্মিত হতে পারে। তবে ঘরের ভিতর বাঁশ বা কাঠের মাচা প্রস্তুত করে তার ওপর ছাগল রাখা উচিৎ। মাচার উচ্চতা ১ মি. (৩.৩৩ ফুট) এবং মাচা থেকে ছাদের উচ্চতা ৬-৮ ফুট হবে। মল-মূত্র নিষ্কাশনের গোবর ও চনা সুবিধার্থে বাঁশের চটা বা কাঠের মাঝে ১ সেমি. ফাঁক রাখতে হবে।
মাটির হলে সেখানে পর্যাপ্ত বালি দিতে হবে। বৃষ্টি যেন সরাসরি ঘরের ভিতর প্রবেশ না করতে পারে, সেজন্য ছাগলের ঘরের চালা ১-১.৫ মি. (৩-৩.৫ ফুট) ঝুলিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। শীতকালে রাতের বেলায় মাচার উপরের দেওয়ালকে চট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। পাঁঠার জন্য অনুরূপ ভাবে পর্যাপ্ত আলো বাতাস ও মল-মূত্র নিষ্কাশনের উত্তম সুবিধাযুক্ত পৃথক খামার তৈরি করতে হবে। শীতকালে মাচার উপর ১.৫ ইঞ্চি পুরু খড় বিছিয়ে তার ওপর ছাগল রাখতে হবে। প্রতিদিন ভালোভাবে পরিষ্কার করে রৌদ্রে শুকিয়ে পুনরায় খড় বিছাতে হবে।
ছাগলের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা (Health management) –
একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, মুক্ত ভাবে ছাগল প্রতিপালনের তুলনায় আবদ্ধ অবস্থায় ছাগল পালন অনেক বেশী ঝুঁকিপূর্ণ। এ ব্যবস্থায় বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনা ও প্রযুক্তির সমন্বয় না ঘটালে খামারীকে বিস্তর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এজন্য ছাগলের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাস্থ্যের প্রতি খামারীকে স্বতন্ত্রভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। ছাগলের খামারে রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে থাকে। তাই বিভিন্ন রোগ দমনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত নেওয়া জরুরি। তা না হলে খামার থেকে লাভের আশা করা যায় না।
তীব্র শীতের সময় ছাগী বা বাচ্চাদের গায়ে চট পেঁচিয়ে দেওয়া যেতে পারে। মাচার নিচ এবং ঘর প্রতিদিন সকালে পরিষ্কার করতে হবে এবং কর্মসূচী অনুযায়ী জীবাণুনাশের ব্যবস্থা নিতে হবে। সুস্থ ছাগলের একটি বৈশিষ্ট্য – সুস্থ ছাগলের নাড়ির স্পন্দন প্রতি মিনিটে ৭০-৯০ বার, শ্বাস-প্রশ্বাস প্রতি মিনিটে ২৫-৪০ বার এবং তাপমাত্রা ৩৯.৫ সেমি. হওয়া উচিৎ। সুস্থ ছাগল দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে, মাথা সবসময় উঁচু থাকে, নাসারন্ধ্র থাকবে পরিষ্কার, চামড়া হবে কোমল এবং পশম মসৃণ ও চকচকে দেখাবে এবং পায়ু অঞ্চল থাকবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
আরও পড়ুন - Kisan Credit Card – বাড়ি বসেই পেয়ে যান কিষান ক্রেডিট কার্ড, এখনই করুন আবেদন
ছাগল সুস্থ রাখতে যে সকল ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা আবশ্যক, সেগুলির মধ্যে রয়েছে –
কর্মসুচী অনুযায়ী টিকাপ্রদান –
ভাইরাসজনিত রোগ যেমন পিপিআর, গোটপক্স, ক্ষুরা রোগ ইত্যাদি এবং ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ যেমন – এনথ্রাক্স, ব্রুসেলোসিস ইত্যাদি খুবই মারাত্মক বলে এগুলির বিরুদ্ধে যথাযথ টিকা প্রদান করা আবশ্যিক। যে সকল ছাগীকে পূর্বে পিপিআর, গোটপক্স, একথাইমা, ব্রুসেলোসিস ইত্যাদি টিকা দেওয়া হয় নি, তাদেরকে গর্ভের পঞ্চম মাসে উক্ত ভ্যাকসিনগুলি দিতে হবে। বাচ্চার বয়স যখন ৫ মাস, তখন তাকে পিপিআর ভ্যাকসিন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন দিতে হবে।
কৃমিনাশক ঔষধ প্রয়োগ –
সকল ছাগলকে নির্ধারিত মাত্রায় বছরে দু’বার কৃমিনাশক ঔষধ প্রদান করতে হবে। কৃমিনাশক কর্মসূচী অনুসরণের জন্য পশু চিকিৎসকের ব্যবস্থা পত্র অনুযায়ী সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আরও পড়ুন - PM KISAN Update - নবম কিস্তি প্রেরণ শুরু পিএম কিষানের আওতায়, অর্থ না পেলে যোগাযোগ করুন এই নম্বরে