চিংড়ি মাছের রাজা হল গলদা চিংড়ি। সব থেকে বড় আকারে হয় এই চিংড়ির প্রজাতী। তাই এদের "জায়ান্ট ফ্রেশ ওয়াটার প্রন" বলা হয়। এছাড়া, ইংরেজিতে বলে স্ক্যাম্পি। এই নামেই সর্বত্র বেশি পরিচিত। গলদা চিংড়ি হল আন্তর্জাতিক সীফুড মার্কেটে প্রচুর চাহিদা সহ একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য। যাইহোক, বেশ কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে যা এই শিল্পকে ঘিরে রেখেছে, এই প্রজাতির জলজ উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে । তবে গলদা চিংড়ির চাষ অ্যাকুয়াকালচারেরও প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে ।
মিস্টি জলের গলদা চিংড়ির পুরুষ ও স্ত্রী চিংড়ির বৃদ্ধির হার ভিন্ন। গলদা চিংড়ি লিঙ্গ বিশেষে একটি দ্বিমুখী বৃদ্ধির ধরণ প্রদর্শন করে। গলদা চিংড়ির মধ্যে পুরুষ গলদা স্ত্রী গলদা চিংড়ির তুলনায় অতি দ্রুত বাড়ে ও ওজন অনেক বেশি হয়। প্রাকৃতিক ভাবে প্রাপ্ত একটি পুরুষ গলদা চিংড়ির ওজন ৪০০-৪৫০ গ্রাম পর্যন্ত হতে দেখা গেছে। অন্যদিকে স্ত্রী গলদা চিংড়ি ওজনে সর্বোচ্চ ১২০-১৫০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে।
পূর্ণাঙ্গ গলদা চিংড়ির স্ত্রী-পুরুষ চেনার উপায়:
একটা বিষয় জানলাম যে স্ত্রী গলদা চিংড়ির চেয়ে পুরুষ গলদা চিংড়ি বেশি বাড়ে। তাই একই বয়সের পুরুষ চিংড়ি স্ত্রী চিংড়ির চেয়ে আকারে খানিকটা বড় হয়। এছাড়াও শিরোবক্ষ (Cephalothorax) আকারে মোটা এবং বড় হয় আর নিম্নোদয় (Abdomen) অপেক্ষাকৃত সরু দেখায়। পুরুষ চিংড়ি সহজেই নজরে পড়ে এমন একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর দ্বিতীয় ভ্রমণপদ লম্বা, মোটা এবং দাঁড়া বিশিষ্ট। এই দ্বিতীয় বাহুর দ্বারা পুরুষ চিংড়ি স্ত্রী চিংড়িকে সঙ্গমকালে দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গনে আবদ্ধ রাখে। স্ত্রী চিংড়ির মাথা ও দ্বিতীয় বাহু অপেক্ষাকৃত অনেকটা ছোট থাকে এবং নিম্নোদয়ের তলার দিকে ডিম ধারণের জন্য নিম্নোদয় অপেক্ষাকৃত চওড়া হয়।
পিঠের খোলসগুলি বড় হয় এবং উভয় দিকে নেমে এসে ডিমগুলি ঢেকে রাখতে সাহায্য করে। পুরুষের জনন অঙ্গ পঞ্চম ভ্রমণপদের গোড়ায়, আর স্ত্রীর যৌন অঙ্গ তৃতীয় ভ্রমণপদের গোড়ায় অবস্থিত। পরিপক্ক স্ত্রীর মাথার নীচে ও পার্শ্বে গোলাপী রং/কমলা রং এর আভা দেখা যায়। পুরুষ চিংড়ির আরো কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যেমন, প্রথম উদর খন্ডের তলার খোলসের মাঝখানে একটা ছোট কাঁটার মত আর দ্বিতীয় সাঁতারের পায়ের ভেতরের দিকের পত্রের (Endopodite) গোড়ায় লোমের মত এ্যাপেন্ডিক্স ম্যাসকুলিনা (Appendix) দেখা যায়। জুভেনাইল অবস্থায় পরুষ চিংড়িকে এই এ্যাপেন্ডিক্স ম্যাসকুলিনা দেখেই সনাক্ত করতে হয়। কারণ তখন অন্যান্য বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে না। তাই স্ত্রী-পুরুষ পৃথক পৃথক করা অনেকটা অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। অভিজ্ঞ চাষি অতি সহজেই স্ত্রী-পুরুষ আলাদা করতে পারেন।
আরও পড়ুন -Boal fish farming process: বানিজ্যিক উদ্যোগে বোয়াল মাছ চাষ পদ্ধতি
পুরুষরা পরিপক্কতার সময় মহিলাদের চেয়ে বড় এবং দ্রুত বৃদ্ধি পায় তাই, সমস্ত পুরুষ গলদা চিংড়ির চাষে একটি অর্থনৈতিক সুবিধা রয়েছে । তাই সকল পুরুষ গলদা চিংড়ির চাষ অত্যন্ত লাভজনক। মাছ চাষিরা যদি মিশ্র মৎস্যচাষে রুই, কাতলার সাথে পুরুষ-গলদার চাষ করেন তবে লাভের পরিমান অনেকটাই বেশি। তবে কিভাবে পাওয়া যাবে এই পুরুষ গলদা চিংড়ি আর কিভাবেই বা উৎপন্ন হয় এই গলদা ? সেটাই এবার আলোচনা করব। এই সকল পুরুষ গলদা চিংড়ির মীন তৈরি করতে প্রয়োজন নিও-ফিমেল গলদা বা নব্য-স্ত্রী গলদা চিংড়ি।
কোথায় পাওয়া যাবে?
রাজীব গান্ধী সেন্টার ফর অ্যাকুয়াকালচার (আরজিসিএ) হল একটি সরকারী সংস্থা যারা নব্য-স্ত্রী স্ক্যাম্পি তৈরি করেছে, যা শতভাগ পুরুষ সন্তান জন্ম দিতে পারে । আরজিসিএ ভারতীয় স্ক্যাম্পির নির্বাচনী প্রজনন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে যা দেশে এটির প্রথম যেখানে নিও-ফেমেলের মাধ্যমে মানসম্মত সমস্ত পুরুষ বীজ উৎপাদন প্রযুক্তির বিকাশ হয়েছে।
প্রজনন পদ্ধতি:
পুরুষ স্ক্যাম্পি বা পুরুষ গলদা চিংড়ি আট থেকে নয় মাসের চাষে 150 গ্রাম পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়, যখন স্ত্রী গলদার বৃদ্ধির হার মাত্র 50 গ্রাম। সেক্স রিভার্সাল পদ্ধিতির মাধ্যমে সকল পুরুষ গলদা (ম্যাক্রোব্রাচিয়াম রোজেনবার্গি) চিংড়ির মীন উৎপন্ন করা হয়। অ্যান্ড্রোজেনিক গ্রন্থি (AG) ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে একটি যৌন বিপরীত প্রযুক্তি প্রক্রিয়াটির মূল চাবিকাঠি । আরো সহজ করে একটু আলোচনা করা যাক কি এই পদ্ধতি। পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা এবং গুজরাট থেকে ভালমানের গলদা চিংড়ির প্রজননক্ষম পরিনত গলদা চিংড়ি বেছে নেওয়া হয়েছিল এবং সুস্থ পুরুষ গলদা চিংড়িকে “সেক্স রিভার্সাল” বা লিঙ্গ পরিবর্তন পদ্ধতিতে 'কার্যকরী স্ত্রী মাছ'-এ রূপান্তর করা হয়ে, যাকে নিও-স্ক্যাম্পি বা বাংলা করলে নব্য-স্ত্রী গলদা চিংড়ি বলা । আর এই “সেক্স রিভার্সাল” সাধারণত মাইক্রোসার্জিকাল হস্তক্ষেপের সাথে অ্যান্ড্রোজেনিক গ্রন্থি (AG) ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। এই নব্য-মহিলাগুলি থেকে অন্য পুরুষ গলদার চিংড়ির প্রজননে ১০০% পুরুষ বংশধর পাওয়া যায়। এভাবে সকল পুরুষ গলদা চিংড়ি উৎপন্ন হয়।
তবে এর সাথে এটাও জেনে রাখা প্রয়োজন এই পদ্ধতি কোনো ক্ষতিকারক পদ্ধতি নয়। “সেক্স রিভার্সাল” বা যৌন-বিপরীত প্রযুক্তি হরমোন বা রাসায়নিক ব্যবহার করে না এবং এটি জিনগতভাবে পরিবর্তিত চিংড়ি তৈরি করে না। ম্যানিপুলেশন শুধুমাত্র ব্রুডস্টকের মধ্যে সীমাবদ্ধ, উৎপন্ন প্রজন্মের মধ্যে প্রভাব থাকেনা।
এই পদ্ধতি জলজ শিল্পে এক যুগান্তকারী পদ্ধতি। তাছাড়া, এটি আক্রমণাত্মক এবং/অথবা পোকামাকড় ক্রাস্টেসিয়ান প্রজাতির ব্যবস্থাপনার জন্য একটি টেকসই সমাধানের অংশও হতে পারে, যেখানে নন-প্রজননকারী পুরুষ বা মহিলা জনসংখ্যার উৎপাদন চাওয়া হয়। সাইলেন্সিং এজেন্ট ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে প্রেরণযোগ্য নয়, এবং ম্যানিপুলেশনটি ব্রুডস্টকের মধ্যে সীমাবদ্ধ, বাড়তি জনসংখ্যার জন্য কোন হেরফের প্রয়োজন নেই।
সমস্ত পুরুষ স্ক্যাম্পির সুবিধা হল এরা অভিন্ন আকার, দ্রুত বৃদ্ধি এবং বাজারে তাড়াতাড়ি বিক্রি করা যায় । রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি । কম FCR মানে বাইরের কৃত্রিম খাবার কম লাগে এবং তুলনামূলকভাবে বেশি ফলন । শুধু স্থানীয় বাজার ই নয়, উচ্চ মানের সকল পুরুষ স্ক্যাম্পি বা গলদা চিংড়ির চাষে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির সাথে সামুদ্রিক খাদ্য রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে।
যাইহোক, বর্তমান সময়ে আমাদের গলদা চিংড়ি চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন দ্বিগুণ বা আরো অধিক বাড়ানো যায় । সাধারণ ভাবে যে সব পুকুরে দেশি পোনার চাষ করা হয়, সেই সব পুকুরই গলদা চিংড়ি চাষের উপযুক্ত। আর এই পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ি চাষের মাধ্যমে মৎস্য শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে গলদা চিংড়ির বার্ষিক উৎপাদন বর্তমান উৎপাদনের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
তথ্যসূত্র: সুমন কুমার সাহু, মৎস্যচাষ সম্প্রসারণ আধিকারিক, হলদিয়া
আরও পড়ুন -Pigeon farming guide: দেখে নিন বাণিজ্যিকভাবে পায়রা পালনের সহজ উপায়