আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকেই কৈ মাছ একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর ও সুস্বাদু মাছ হিসেবে পরিচিত। এক সময় দেশের নদী-নালা, খাল-বিল ও প্লাবন ভূমিতে প্রচুর পরিমাণে কৈ মাছ পাওয়া যেত। অনেকদিন থেকে আমাদের দেশে জীয়ল মাছ হিসাবে কৈ মাছ পরিচিত অর্থাৎ কৈ মাছ জলের বাইরে অনেকক্ষন বেঁচে থাকতে পারে | তবে বর্তমানে, থাই কৈয়ের বাণিজ্যিক চাষ একটি লাভজনক প্রকল্প হিসাবে বিবেচতি হয়ে থাকে। তাই বাণিজ্যিকভিত্তিতে পরিকল্পিতভাবে থাই কৈ চাষ করে যে কেউ হতে পারেন একজন সফল খামারি।
থাই কৈ চাষের সুবিধা(Benefits of thai koi):
১) বিরূপ পরিবেশেও বেঁচে থাকতে সক্ষম এবং মৃত্যুর হার খুবই কম।
২) রোগবালাই নেই বললেই চলে।
৩) চাহিদা সব সময় বেশি বলে এর মূল্য তুলনামূলকভাবে সব সময় বেশি থাকে।
৪) অধিক ঘনত্বে চাষ করা যায়।
৫) কৈ মাছ মূলত কীট-পতঙ্গ খায়। একারণে পোকামাকড়, ছোট মাছ, ব্যাঙের পোনা, শামুক, ঝিনুকের মাংস ইত্যাদি সরবরাহ করে এ মাছ চাষ করা যায়।
৬) ছোট পুকুর বা খাঁচায় চাষ করা সম্ভব।
৭) তুলনামূলক অল্প পঁজিতেই চাষ করা সম্ভব।
চাষ পদ্ধতি(Farming process):
থাই কৈ এবং আমাদের দেশীয় কৈয়ের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই বললেই চলে। তবে থাই কৈ সাধারণগত দেশি কৈয়ের চেয়ে চ্যাপ্টা এবং এর শরীরের পিছনের দিকে কিছু কালো দাগ থাকে। এ মাছ দ্রুত বর্ধনশীল। একে পুকুর বা খাচাঁয় চাষ করা সম্ভব। তবে, পুকুরে চাষ করাই বেশি লাভজনক।
আরও পড়ুন - Rabbit rearing at home: জেনে নিন বাড়িতে খরগোশ পালনের পদ্ধতি
পুকুর নির্বাচন(Pond selection):
পুকুর রৌদ্র আলোকিত খোলামেলা জায়গায় হাওয়া উত্তম এবং পাড়ে ঝোপ-জঙ্গল থাকলে তা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। পাড়ে বড় গাছপালা থাকলে সেগুলোর ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে এবং দিনে কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা সূর্যের আলো পড়া নিশ্চিত করতে হবে। থাই কৈ চাষের জন্য তুলনামূলকভাবে ছোট পুকুর বিশেষভাবে উপযুক্ত।
পুকুরের আয়তন ২০ থেকে ৩০ শতকের মধ্যে হওয়াই ভালো। এতে করে ব্যবস্থাপনার সুবিধা হয়। পুকুরের গভীরতা বেশি না হয়ে ৫ থেকে ৬ ফুট হওয়া উত্তম। প্রথমে পুকুরটি সেচ দিয়ে শুকিয়ে ফেলতে হবে। পুকুরে অতিরিক্ত কাদা থাকলে তা উঠিয়ে ফেলতে হবে কারণ অতিরিক্ত কাদা পুকুরে গ্যাস সৃষ্টি করে যা পুকুরের শুকানোর পর তলার মাটি রৌদ্রে ফেটে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
সার প্রয়োগ(Fertilizer):
আড়াআড়িভাবে ২টি হালের চাষ দেওয়ার পর প্রতি শতাংশ ১ কেজি হিসাবে পাথুরে চুন (আগের দিন গুলিয়ে রেখে পরের দিন) পুকুরের পাড়সহ সর্বত্র এমনভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে যেন মনে হয় সমগ্র পুকুরটি সাদা কাপড়ে মুড়ে দেয়া হয়েছে। চুন প্রয়োগের ৩-৫ দিন পর প্রতি শতাংশ ৫ কেজি পচা গোবর অথবা ৩ কেজি মুরগির বিষ্ঠা ছিটিয়ে দিতে হবে। জৈব সার প্রয়োগের ২-৩ দিন পর পুকুরে ৪-৫ ফুট পানি প্রবেশ করাতে হবে।
জল প্রবেশ করানোর পর প্রতি শতাংশে ২০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ২০০ গ্রাম টিএসপি গুলে পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে। জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগের ৫ থেকে ৭ দিন পর পুকুরে থাই কৈ-এর পোনা মজুদ করতে হবে। অন্যদিকে পুকুরে যদি জল থাকে কিংবা কোনো কারণে পুকুর শুকানো সম্ভব না হয় তবে সেক্ষেত্রে পুকুরে যেন রাক্ষুসে মাছ না থাকে, তা প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে।
পোনা মজুদ:
কৈ এমন একটি জীয়ল মাছ যার অতিরিক্ত শ্বসন অঙ্গ আছে। তাই বাতাস থেকে অক্সিজেন নিতে সক্ষম হওয়ায় জলের উপরে এরা দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারে। বৃষ্টির সময় এরা কানকুয়া ব্যবহার করে অতি দ্রুত চলতে পারে।
সেজন্য যে পুকুরে কৈ-এর চাষ করা হবে তার পাড় অবশ্যই নাইলনের ঘন জাল দিয়ে ঘিরতে হবে। নয়তো পুকুরে খুব কম পরিমাণ কৈ পাওয়া যাবে। ছোট ফাঁসযুক্ত জাল দিয়ে পুকুরটি ভালোভাবে ঘেরার পর পুকুরে প্রতি শতাংশে নার্সিংকৃত এক থেকে দেড় ইঞ্চি মাপের ৩০০ থেকে ৩২৫ টি কৈয়ের পোনা মজুদ করতে হবে।
খাদ্য(Food):
থাই কৈ একটি দ্রুত বর্ধনশীল মাছ। সেজন্য পর্যাপ্ত খাবার প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্য ব্যবস্থাপনা দুইভাবে করা যেতে পারে। শামুক বা ঝিনুকের মাংস, ব্যাঙের পোনা, গরু বা মুরগির নাড়িভূড়ি কিংবা ফিসমিল (নিয়মিতভাবে নয়), কুড়া, ভুষি, খৈল ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে যে কোনো একটি খাবার নিয়মিত ব্যবহার করে অন্যগুলো আংশিক ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
উন্নত খাবার হিসাবে ফিসমির ২৫%, কুড়া ৩০%, খৈল ২৫% এবং ভুষি ২০% একত্রিত করে বল অথবা পিলেট আকারে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়ায় সম্ভাবনা বেশি থাকে। এ ক্ষেত্রে একমাত্র খৈল বাদে অন্য উপাদানগুলো উল্লেখিত অনুপাতে বেশি পরিমাণে মিশ্রিত করে একটি মিশ্রণ তৈরি করে রাখতে হবে।
বাণিজ্যিক খাদ্য ব্যবস্থাপনা:
বাণিজ্যিভবে নিয়মিত কৈয়ের উৎপাদন পেতে হলে গুণগতমান সম্পন্ন পিলেট খাবার প্রদান করা উচিত। এক্ষেত্রে বাজার থেকে কৈয়ে জন্য তৈরিকৃত পিলেট খাবার (প্রোটিনের পরিমাণ ৩০%৩৫) অথবা যদি তা না পাওয়া যায় তাহলে চিংড়ির জন্য তৈরি খাবার ব্যবহার করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন -Aquarium Fish Farming: সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি অ্যাকুরিয়ামে মাছ চাষ পদ্ধতি