গিফট হল তেলাপিয়া মাছ। বিশেষ ভাবে উৎপন্ন। তেলাপিয়া মাছ চাষের বড় সমস্যা হলো এর অনিয়ন্ত্রিত বংশ বিস্তার। এই ধরণের অনিয়ন্ত্রিত বংশবিস্তারের কারণে পুকুরে বিভিন্ন আকারের তেলাপিয়া মাছ দেখা যায়, এতে করে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। প্রকৃতিগতভাবেই পুরুষ তেলাপিয়া মাছের দৈহিক বৃদ্ধির হার বেশি। এই ধারণাকেই কাজে লাগিয়ে শুধুমাত্র পুরুষ তেলাপিয়া মাছ হিসেবে “গিফট” মাছ তৈরি করেছেন মৎস্য বৈজ্ঞানিকেরা।
সকল পুরুষ তেলাপিয়া মাছ দুই ভাবে তৈরি করা যায়, ১) হরমোন দিয়ে, ২) সিলেকটিভ ব্রীডিং ( নির্বাচিত প্রজনন) করে। আর এই সিলেকটিভ ব্রীডিং করেই “গিফট” তৈরি করা হয়। গিফট এর সম্পূর্ণ নাম “জেনেটিক্যালি ইম্প্রুভড ফার্মড তিলাপিয়া” ।
এই নিয়ে মাছ চাষি, মৎস্য উদ্যোক্তা, মৎস্য রপ্তানিকারী এবং সাধারণ উপভোক্তাদের জন্য সবিস্তারে আলোচনা করা হল।
গিফট মাছের চাষে মাছ চাষিরা লাভবান হবেন দ্রুত। এই গিফট জাতীয় তেলাপিয়া রপ্তানিযোগ্য মাছ হওয়ায় কলকাতার বেশ কিছু বাণিজ্যিক রপ্তানি সংস্থা “গিফট” তেলাপিয়া মাছের রপ্তানিতে উৎসাহিত। চুক্তি ভিত্তিক মাছের চাষের মাধ্যমে বৈদেশিক বাজারে রপ্তানিতে আরো বেশি করে জনপ্রিয় হতে চলেছে। অতি সম্প্রতি তেলাপিয়া বিশ্বজনীন মাছ বা গ্লোবাল ফিস হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে । সারা বিশ্বে চাষ করা মাছের নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এই মাছ।
তেলাপিয়া মাছ আমাদের দেশীয় মাছ নয়। এটি একটি বিদেশী মাছ বা এলিগেন ফিশ । তেলাপিয়া মাছের আদি নিবাস আফ্রিকায়। এই মাছের প্রায় ১০০টি প্রজাতি রয়েছে। এদের মধ্যে নাইলোটিকা ও লাল তেলাপিয়াসহ আরো কয়েকটি প্রজাতি চাষের উপযোগী মাছ বলে ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। কারণ এরা কম সময়ে স্বল্প গভীরতায় বেশী উৎপাদন দিতে সক্ষম। তেলাপিয়া মাছের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এদের অধিকাংশই ডিম মুখে রেখে তা দেয় এবং পোনা সাঁতার কাটতে অভ্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত বাবা মার তত্ত্বাবধানে থাকে ।
ভারতবর্ষে ১৯৫২ সালে তেলাপিয়া মাছের চাষ শুরু হলেও , ১৯৫৯ সালে আইন করে তা নিষিদ্ধ করে কেন্দ্রীয় সরকার। মশার লার্ভা খায় বলে এক সময় বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোলেও ব্যবহার করা হয়েছিল তেলাপিয়া। কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা যায় , প্রজনন হার বেশি হওয়ায় পুকুর থেকে খাল, বিলের মতো জলাশয়ে ব্যাপক হারে বাড়ছে তেলাপিয়ার সংখ্যা। যার ফলে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছিল জলজ বাস্তুতন্ত্রের।
বহু বছর পরে ‘ফিশারিজ রিসার্চ কাউন্সিল’–এর সুপারিশে আবার তেলাপিয়া মাছ চাষ শুরুর অনুমতি দেওয়া হয়। তবে নিয়ন্ত্রিত ভাবে, অর্থাৎ তেলাপিয়া চাষের জন্য সরকারি লাইসেন্স নিতে হবে। তাই শর্ত সাপেক্ষে চাষ করা যাবে তেলাপিয়া মাছের। পুরুষ ও স্ত্রী তেলাপিয়া একসাথে চাষ করলে বংশ বিস্তার খুব দ্রুত হয়। এতে মাছের সংখ্যা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে এবং ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে যায়। সকল পুরুষ তেলাপিয়া মাছের চাষে এ সমস্যা আর থাকে না। স্ত্রী মাছের তুলনায় পুরুষ মাছের বৃদ্ধি বেশি । দ্রুত বৃদ্ধির কারণে বাণিজ্যিক ভাবে শুধু পুরুষ তেলাপিয়া মাছের চাষ লাভ জনক।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, তেলাপিয়া ও নাইলোটিকা উভয় মাছই তেলাপিয়া নামে বাজারে বিক্রি হতে দেখা যায় যদিও মাছদুটি আলাদা প্রজাতির অন্তর্ভূক্ত। তেলাপিয়া ও নাইলোটিকা উভয় মাছই পার্শিফর্ম বর্গের এবং সিক্লিড গোত্রের অন্তর্ভূক্ত। তাদের গণও একই আর তা হল ওরিওক্রোমিস।
তুলনামূলক চাপা বর্ণের তেলাপিয়ার বৈজ্ঞানিক নাম ওরিওক্রোমিস মোসাম্বিকাস, যার ইংরেজি নাম মোজাম্বিক তেলাপিয়া , বাংলায় সংক্ষেপে তেলাপিয়া।
অন্যদিকে উজ্জ্বল বর্ণের নাইলোটিকা মাছের বৈজ্ঞানিক নাম ওরিওক্রোমিস নিলোটিকাস , যার ইংরেজি নাম নীল তিলাপিয়া অথবা নিলোটিকা (প্রজাতির নাম অনুসারে) বাংলায় নীল তেলাপিয়া বা নাইলোটিকা।
আগেই আলোচনা হয়েছে যে, তেলাপিয়া চাষের বড় সমস্যা হলো এর অনিয়ন্ত্রিত বংশ বিস্তার। এই ধরণের অনিয়ন্ত্রিত বংশবিস্তারের কারণে পুকুরে বিভিন্ন আকারের তেলাপিয়া মাছ দেখা যায়। এতে করে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। প্রকৃতিগতভাবেই পুরুষ তেলাপিয়া মাছের দৈহিক বৃদ্ধির হার বেশি। এই ধারণাকেই কাজে লাগিয়ে শুধুমাত্র পুরুষ তেলাপিয়া চাষকেই মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ বলা হয়। এই প্রজাতি সম্পূরক খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্থ্, প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকে, অধিক ঘনত্বে চাষ করা যায় এবং প্রজননের জন্য পুকুরের পাড়ে গর্ত করে না সেই কারণে বর্তমানে শুধুমাত্র পুরুষ তেলাপিয়া বা মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষে মাছচাষিদের আগ্রহ বাড়ছে। তবে এই মাছ চাষের জন্য মৎস্য দপ্তরের লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক।
তেলাপিয়ার সমস্ত পুরুষ মাছ তৈরি বিভিন্ন পদ্ধতিতে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয়েছে। তার একটি পদ্ধতি হল হরমোন প্রয়োগের মাধ্যমে হ্যাচারিতে উৎপন্ন সমস্ত তেলাপিয়া পুরুষে রূপান্তরিত হয়। এই তেলাপিয়া এলাকায় মনোসেক্স তেলাপিয়া নামে পরিচিত । চলতি কথায় কেউ কেউ মনোপিয়াও বলে থাকে । হ্যাচারিতে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরনোর পর ২১ দিন ‘আলফা ১৭ মিথাইল টেস্টোস্টেরন’ হরমোন খাওয়ানো হচ্ছে চারা মাছগুলিকে। এর প্রভাবে ওই সময়ের পর স্ত্রী মাছগুলি পুরুষে রূপান্তরিত হয়ে যায়। কিন্তু তার সময়সীমা ৬–৭ মাস। তারপর আবার পুরনো সত্ত্বা ফিরে আসে মাছগুলির। এই মুহূর্তে সারা দেশে এই ধরণের মাছের অনুমোদিত হ্যাচারির সংখ্যা ৬টি। এর মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশে ২, তামিলনাড়ুতে ২,মহারাষ্ট্রে ১ এবং পশ্চিমবঙ্গে হুগলির খামারগাছিতে ১টি হ্যাচারি রয়েছে।
তবে হরমোনের প্রভাব ব্যাতিরেকে সমস্ত পুরুষ তেলাপিয়া উৎপাদনের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার “গিফট তেলাপিয়া” । “জেনেটিক্যালি ইম্প্রুভড ফার্মড তিলাপিয়া”-র সংক্ষিপ্ত নাম “গিফট” । সিলেকটিভ ব্রিডিং করে একটি প্রজাতির মাছের মাংসল অংশ বৃদ্ধি করে উৎপাদন বাড়ানো যায়। গিফট (জেনেটিক্যালি ইমপ্রুভড ফার্ম তেলাপিয়া) তেলাপিয়া এভাবেই উৎপন্ন।
পুরুষ তেলাপিয়া বা মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ কে গিফট তেলাপিয়া বলা হয়। আমাদের দেশে গিফট তেলাপিয়ার জাতটি বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত তেলাপিয়া নাইলোটিকার আটটি জার্মপ্লাজমের মধ্যে পুঞ্জীভূত নির্বাচন পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র রাজীব গান্ধী সেন্টার ফর আকোয়াকালচার ( আর জি সি এ) উদ্ভাবন করেছে । পরীক্ষামূলক গবেষণায় জানা যায় গিফট জাতের তেলাপিয়া স্থানীয় জাতের তেলাপিয়ার চেয়ে ৬০% অধিক বৃদ্ধি এবং ৫০% বেশি বাঁচার হার প্রদর্শন করেছে এবং গিফট জাতের তেলাপিয়া দেশে বিদ্যমান অন্যান্য তেলাপিয়ার চেয়ে ইতিমধ্যে শতকরা ৫০-৬০ ভাগ বেশী উৎপাদনশীল বলে প্রমাণিত হয়েছে। এটি নি:সন্দেহে পোনা উৎপাদন ও চাষের জন্য একটি উৎকৃষ্ট জাতের তেলাপিয়া মাছ।
তবে সাধারণ তেলাপিয়া বা নাইলোনটিকার থেকে এই “গিফট তেলাপিয়া” মাছ চাষের সুবিধা কি ? সুবিধা হল এটি মিষ্টি ও নোনাজল উভয়ে পরিবেশে অন্যান্য মাছের সাথে মিশ্রভাবে চাষ করা যায়। গিফট তেলাপিয়া উচ্চফলনশীল মাছ । পুকুরে ১ মিটার গভীরতায় ৩-৪ মাসেই বিপণনযোগ্য হয় । চার মাস পর পর বছরে কমপক্ষে তিনটি ফলন চক্র তোলা সম্ভব । যে কোন খাবার এরা পছন্দ করে এবং সহজে রোগাক্রান্ত হয় না । এই মাছেরসহজে পোনা উৎপাদন সম্ভব, তাছাড়া অল্প পুঁজিতে চাষ করা যায় । এই মাছ খেতে সুস্বাদু এবং বাজারে চাহিদা বেশী । তাছাড়া তেলাপিয়াই মিস্টি জলের একমাত্র মাছ , যার মধ্যে রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, যা অত্যন্ত ভালো একটি অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এবং এই উপাদানটি হার্ট অ্যাটাকের আশংকা কমায়। কোলেস্টেরলের সঠিক মাত্রা ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং ধমনিতে ব্লকেজ ঠেকায় ।
*একটি কেস স্টাডিঃ* উল্লেখ করা হল ।
অল্প সময়ের মধ্যে বেড়ে ওঠা এই মাছ খুব লাভ জনক। এই বছর আমাদের রাজ্যে পরীক্ষামূলক এই “গিফট তেলাপিয়া” মাছের চাষ হয়েছিল রাজ্যের কয়েকটি স্বনাক্তকৃত স্থানে । তার মধ্যে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হলদিয়া ব্লকে দুই জন প্রগতিশীল মাছ চাষি 'আর জি সি এ স্ট্রেন'এর সমস্ত পুরুষ গিফট তিলাপিয়া পরীক্ষামূলক চাষ করেছিল। হাফ গ্রাম ওজনের “গিফট তেলাপিয়া” ১০০ দিনের চাষে গড়ে চারশো গ্রাম! অভাবনীয় সাফল্যে উৎসাহিত সকলেই। তামিলনাড়ুর “রাজীব গান্ধী সেন্টার ফর একোয়াকালচার” ( আর জি সি এ) সরকারি সংস্থা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল এই“গিফট তিলাপিয়া” মাছ । পরীক্ষামূলক চাষ করা হয়েছিল হলদিয়া ব্লকে। হলদিয়া ব্লকের দুই জন প্রগতিশীল মাছ চাষি রঙ্গলাল সামন্ত ও রনোজিত ভৌমিক কে এই প্রকল্পে দুই হাজারটি করে “গিফট তেলাপিয়ার” পোনা তুলে দেওয়া হয় ৩রা মার্চ ২০১৮ তে। প্রায় দুই মাস পর ৩০শে এপ্রিল মাছের ওজন দাঁড়িয়েছিলো ১৬০ গ্রাম, এবং ১০০ দিন পর সম্পূর্ণ আহরনের সময় ওজন দাঁড়ায় চারশো গ্রাম। এতে এলাকার মাছ চাষিরা খুবি উৎসাহিত , তারা আশাবাদি এই মাছ লাভ জনক।
লেখকঃ সুমন কুমার সাহু, মৎস্যচাষ সম্প্রসারন আধিকারিক, হলদিয়া
গিফ্ট তেলাপিয়া মাছের চাষ পদ্ধতি সম্বন্ধে সবিস্তারে জানতে পড়ুন কৃষি জাগরণের এপ্রিল মাসের সংখ্যাটি।
রুনা নাথ(runa@krishijagran.com)