উত্তর চব্বিশ পরগণার হিঙ্গলগঞ্জের মামুদপুরে কৃষি জমিতে একই সঙ্গে দেশি জাতের ধানের সঙ্গে সব্জি-ডাল-সরিষা-পাটের পাশাপাশি জমিতে ছোট ছোট পুকুরে চলছে মাছ চাষ। উত্তর চব্বিশ পরগণার বাদুরিয়া গ্রামের সেভ আওয়ার রাইস-এর স্টেট-কোঅর্ডিনেটর আলাউদ্দিন আহমেদ-এর সঙ্গে আগেই আলাপ ছিল। তাঁর আমন্ত্রণে উত্তর চব্বিশ পরগণার হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের মামুদপুর গ্রামে পৌঁছাই কৃষি জমিতে একই সঙ্গে চারটে ফসল সহ মাছ চাষের এক অনবদ্য কৃষি কর্ম নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করতে। মামুদপুর গ্রামে পৌঁছে দেখা হল আলাউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে। তিনি জানালেন ধান বা চাল নিয়ে নতুন করে কোন পরিচয় দরকার নেই, ধান বা চাল হচ্ছে আমাদের জীবনের একমাত্র নির্ভরযোগ্য ও পরম গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য বস্তু। জীবনে অন্য কোন শস্যের অতটা প্রভাব নেই। ধান ইন্দ-বার্মা অঞ্চলে প্রথম উৎপন্ন হতে দেখা যায়। এই একটি শস্যই (ধান) আমাদের দেশকে, এশিয়ার অন্যান্য ধান উৎপাদনকারী দেশের সাথে ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছে। অধিকাংশ এশিয়াভুক্ত দেশগুলির জীবন যাত্রা ও খাদ্য নিরাপত্তা ধানের উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও ধান অনেক দেশের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। প্রায় ২০০ কোটি মানুষ, কর্মক্ষম থাকার জন্য যে খাদ্য শক্তির (Food energy) প্রয়োজন, চাল থেকে তার ষাট শতাংশেরই বেশী আরোহণ করে। আমাদের দেশের মোট উৎপাদিত ধানের বেশীরভাগটাই আসে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের কাছ থেকে। ১৯৬৬ সালে ‘সবুজ বিপ্লব’- এর নামে ধানের হাই ইনপুট ভ্যারাইটির সূচনা আমাদেরকে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের উপর নির্ভরতা বাড়িয়ে দেয়, ফলে খাদ্য ও পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে ওঠে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের অর্থনীতি ও ভালো থাকার উপর অত্যন্ত প্রভাব পড়ে। সবুজ বিপ্লবের আগে ভারতবর্ষের এক লাখের অধিক প্রকার বেশী জাতের ধান ছিল। আর বাংলায় ৫,৫০০ প্রকার দেশী জাতের ধানের চাষ হত।
আজ মেরে কেটে বাংলায় কৃষকের জমিতে ১০০-১৫০ টি জাত পাওয়া যেতে পারে। সবই লুপ্তপ্রায়। ১৯৬৬ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক ধান্য বর্ষে আই-আর-৮ ধানের সূচনা থেকেই দেশীয় ধানের ক্ষয় শুরু হয়। পশ্চিম বাংলার কোটি কোটি মানুষের জীবন যাত্রার উপরে ধান ও ধান নির্ভর ব্যবস্থা একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। কোন ভাবে এই অবস্থার পরিবর্তন হলে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের জীবনে তার প্রভাব পড়বে। যেহেতু ধান আমাদের জীবন, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ব্যবস্থার একটি সহজাত অংশ। ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক ধান্য বর্ষে কেরালা রাজ্যের এর্নাকুলাম জেলার কুম্বালাঙ্গিতে ধান নিয়ে একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ভারতবর্ষের ১০ টি রাজ্যের ৫৬ টি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে। উক্ত কর্মশালায় আমাদের দেশের চাষীদেরকে জৈব উপায়ে দেশী ধান চাষে কীভাবে উৎসাহিত করা হয় এবং উক্ত ধান বীজ ভাণ্ডারের মাধ্যমে কীভাবে সংরক্ষণ করা যায় – এ বিষয়ে যৌথভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আলোচনায় ঠিক হয়, কেরালার ‘ঊষা সোলাপানি’ উক্ত বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করবে। ২০০৬ সালে ‘থানাল’ নামে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঊষা সোলাপানি কেরালায় ধান বাঁচাও আন্দোলন শুরু করে, পড়ে ২০০৭ সালে কেরালা, তামিলনাড়ু ও কর্ণাটক রাজ্যে এই আন্দোলন শুরু হয়, ২০০৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা এই আন্দোলনে শামিল হয়। ২০০৯ সালে ধান বাঁচাও আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গে আমরা যখন শুরু করি, তখন আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল – গ্রাম-বাংলার কৃষকদের চরম ক্ষুদা ও দারিদ্র দূর করা। এই উদ্দেশ্যে আমাদের উন্নয়ন কার্যাবলী ছিল চাষীদের জমিতে জৈব উপায়ে বাস্তুতান্ত্রিক ধান চাষ ব্যবস্থা এবং সুস্থায়ী চাষের প্রবর্তন করা। এই কাজ কে মাথায় রেখে গত ৭ বছর ধরে নিবিড়ভাবে উক্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকে মামুদপুর ও যোগেশগঞ্জ এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার পাথরপ্রতিমা ও সাগর ব্লকে পুরো মাত্রায় চেষ্টা চালিয়েছি।
২০১৬ সাল অবধি মোট ৪,১৯১ জন চাষী তাদের ৩,৩৬৮.২ একর জমিতে জৈব উপায়ে ৫১ প্রকার দেশী জাতের ধান চাষ করে চলেছেন। এছাড়া ৪ টি বীজ ভাণ্ডারে ৩০০ প্রকার দেশী ধানের বীজ সংরক্ষণ করা আছে। যে কোন উৎসাহী চাষী বীজ ভাণ্ডার থেকে উপযুক্ত মূল্যের বিনিময়ে বীজ সংগ্রহ করতে পারে। আলাউদ্দিন আহমেদ মামুদপুর গ্রামের তুষারকান্তি দাস-এর সঙ্গে পরিচয় করালেন। তুষারবাবু মামুদপুর গ্রাম নবদিগন্ত জৈব কৃষক সংঘের নেতা। তুষারবাবু জানালেন, আমাদের গ্রামে খুবই কম সংখ্যক লোক চাকুরীজীবী, বেশীরভাগই কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল। ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের এখানে পাটনাই, আসফলে, লালগেঁতু, সাদাগেঁতু, হলদেবাটন, তালমুগুর, হামাই, রূপসাল, দারশাল সহ আরও অনেক রকমের দেশী ধানের চাষ হত। কিন্তু সেই দেশী ধানগুলি হারিয়ে গিয়েছে। তার বদলে চলে এল স্বর্ণ মাসুরীখ, স্বর্ণ প্রতীক্ষা, স্বর্ণ শ্রাবণ, ছিয়ার প্রভৃতি নানান শঙ্কর জাতীয় দেশী ধান। আর এল রাসায়নিক, নানা ধরণের সার ও প্রাণঘাতক কীটনাশক ঔষধ। এই সকল কীটনাশক মানুষের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের আজকের পরিবেশের নানান ধরণের মাছ, শামুক, গেঁড়ি, পাখী সবই আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। আজকের চাষী জমিতে ৫ কেজির জায়গায় ৩০ কেজি সার দেওয়া সত্ত্বেও চাষীর ফলন দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং নানান ধরণের অসুখে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে এবং কৃষক তার পরিবার ছেড়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে। ঠিক এই সময় ধান বাঁচাও আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা পশ্চিমবঙ্গ স্টেট কোঅর্ডিনেটর আলাউদ্দিন আহমেদ আসেন আমাদের গ্রামে। তাঁরই উদ্যোগে এবং ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠে মামুদপুর নবদিগন্ত জৈব কৃষক সংঘ। আমার উদ্যোগে এই গ্রামে সংঘের সদস্যেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন ধরণের নবদিগন্ত চাষ আবাদ শুরু করেছে।
এই গ্রামে ছোট ছোট জমিতে পুকুর কেটে আইল বাঁধ উঁচু করে একই জমিতে দেশীয় ধান-সবজি-ডাল-সরিষা-পাট এবং মাছ চাষের মাধ্যমে মামুদপুর গ্রামের চাষীরা তাদের আয়কে তিনগুণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রভাস পণ্ডিত, রণজিৎ সামন্ত, রাধেশ্যাম প্রামাণিক, উতপল বেরা, তুষারকান্তি দাস, স্থানীয় হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক, অপূর্ব দাস, মিহির বেরা, অমিতোষ বেড়া, তন্দ্রা দাস, সুচিত্রা সীট, জয়তি জানা, ভরত বেরা, অসিত জানা, বিজন মান্না, প্রতিমা মান্না, গীতা দাস সহ ইত্যাদি বহু নারী ও পুরুষ কৃষক এই সংঘের সদস্য। প্রতিটি ঘরে ঘুরে দেখা গেল নবদিগন্ত জৈব কৃষক সংঘের উদ্যোগে প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে কম্পোস্ট সার, ভার্মি কম্পোস্ট সার, তরলসার, পঞ্চ গব্য, শস্য গব্য – এই জাতীয় সহজ সরল সার কৃষকরা যাতে তৈরী করে ব্যবহার করতে পারে, তার ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। শেখানো হয় বীজ বাছাই ও শোধন প্রক্রিয়া। গ্রামের মধ্যে চোখে পড়ল স্থানীয় চাষী ও কৃষকদের নেতা তুষারকান্তি দাসের বারিতে বীজ ভাণ্ডার। সেখানে ৩০ রকমের বিভিন্ন দেশীয় ধান বীজ যথা – ধুদেশ্বর, রূপশাল, দারশাল, গোবিন্দভোগ, রাধুনি পাগল, কালা ভাতে খাড়া, রাধাতিলক, কেরালা সুন্দরি, তুলাইপঞ্জি, মুক্তশ্রী, হামাই, তালমুগুর, হরসানোনা, বহুরুপি, কবিরাজশাল ইত্যাদি দেশী ধান বীজ এবং সবজি বীজ সংরক্ষিত আছে। উক্ত বীজ নির্বাচন ও সংরক্ষণের জন্য একটি জমিকে বেছে নিয়ে ‘ধান বৈচিত্র্য এলাকা’ (Rice Biodiversity Block) গড়ে উঠেছে। এখানে উল্লেখ্য, ধান কাটার এক সপ্তাহ আগে জমিতে কোন সেচ এবং চাষ না দিয়ে জল এবং তৈল বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়, একে বলা হয় গ্রাম বাংলায় – ‘পয়রা চাষ’।
এলাকার চাষী প্রভাষ পণ্ডিত জানালেন – ‘ আমার তিন বিঘা জমিতে ইতিমধ্যে ২৫,০০০ টাকার সবজি বিক্রি হয়েছে। ধান কাটার পর ধানের মূল্য হিসাবে আনুমানিক আরও ২৫,০০০ টাকা পেতে পারি। এছাড়াও আছে মাছ বিক্রির টাকা। জমির মধ্যে ছোট ছোট পুকুরগুলিতে চাষ হয় – গলদা চিংড়ি, মৌরলা, শোল, কই, ট্যাংরা ও সাদা মাছ (পোনা) ইত্যাদি। এগুলি বাজারজাত করে এখান থেকেও আয় হয়।
এখানে উল্লেখ্য, মামুদপুর গ্রামে নবদিগন্ত জৈব কৃষক সংঘের উদ্যোগে চাষ আবাদ হয় সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতি অবলম্বন করে। কোন রাসায়নিক সার এবং কোন রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে এই চাষ আবাদ হয়। এটি পশ্চিমবঙ্গের চাষী ভাইদের কাছে এক নতুন দৃষ্টান্ত। এলাকার চাষীরা একত্রে বলেন- আলাউদ্দিন আহমেদ সাহেব আমাদের ধান চাষের সঙ্গে সবজি ও মাছ চাষের যে নতুন দিশা দেখিয়েছেন, সেজন্য আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ”।
তবে আমাদের দুঃখ হল – ধান, সবজি বিক্রির জন্য স্থানীয় ভাবে কোন বাজার না থাকায় আমরা ফসল উৎপাদন করেও উপযুক্ত দাম পাচ্ছি না। সরকারের কাছে আমাদের দাবি – ‘আমরা যাতে আমাদের উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত দাম পাই, তার সুব্যবস্থা সরকারী ভাবে হলে ভালো হয়’। উৎসাহী যে কোন চাষী এই নতুন পদ্ধতির বিষয়ে বিশদে জানতে যোগাযোগ করতে পারেন- তুষারকান্তি দাস (মামুদপুর, নবদিগন্ত জৈব কৃষক সংঘ) –এর সঙ্গে। চলভাষ – ৯০৬৪৫৫৪১৫০।
তথ্যসূত্র - ইকবাল দরগাই
স্বপ্নম সেন (swapnam@krishijagran.com)