সুপারি বাংলাদেশের অর্থকরী ফসল এবং এটি এক অতি পরিচিত ফসল । প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ পানের সাথে অপরিহার্য উপাদান হিসেবে সুপারি ব্যবহার করে আসছে। বর্তমানে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাতেও কিছু পরিমাণ সুপারির চাষ হয়ে থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে প্রীতিভোজ শেষে পান সুপারি দিয়ে আপ্যায়ন এর একটা রেওয়াজ আছে | সুপারি পাতাও বেড়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া সুপারি গাছ বাড়ির শোভাবর্ধন ও বায়ু প্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে। জেনে নিন কিভাবে সুপারি চাষ (Locut cultivation) করা যায়;
জাত নির্বাচন(Variety):
বারি সুপারি-১ এবং বারি সুপারি-২ , এই ২ টি হলো সুপারির উচ্চ ফলনশীল জাত |
মাটি(Soil):
সুপারি চাষের জন্য উর্বর ও মাঝারী ধরনের মাটি অর্থাৎ হালকা বুনটের মাটি উপযোগী | তবে বেলে দো-আঁশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী। মাটির পিএইচ মান ৫.৫-৬.০ এর মধ্যে হলে সবচেয়ে ভালো হয়।
চারা উৎপাদন পদ্ধতি:
বীজ দ্বারা সুপারি গাছের বংশবিস্তার হয়ে থাকে। প্রথমে বীজতলায় বীজ লাগিয়ে চারা উৎপাদন করা হয়। সুপারির চারা বীজতলায় ১-২ বছর রাখার পর নির্দিষ্ট স্থানে লাগাতে হয় |
আরও পড়ুন -Betel Vine Cultivation: পান চাষের এই বিশেষ পদ্ধতিতে আপনিও হবেন লাভবান
জমি তৈরী(Land preparation):
বীজতলার জমি ৪-৫ বার ভালোভাবে চাষ দিয়ে আগাছা ও আবর্জনা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। জমিতে মই দিয়ে সমান করে নিতে হবে। বীজতলার জমির উর্বরতা অনুযায়ী হেক্টর প্রতি ১৫-২০ টন গোবর বা জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে, তবে কোনো রাসায়নিক সার প্রয়োগের দরকার নেই। সুপারির চারা সাধারণত মাদা তৈরি করে লাগানো হয়। মাদার আকার ৭০ সেমি. x ৭০ সেমি. x ৭০ সেমি হলে ভালো হয়। মাদা তৈরি করার সময় উপরের মাটি একদিকে এবং নিচের মাটি অন্যদিকে আলাদা করে রাখতে হবে। গর্তের ভেতরটা শুকনো পাতা, খড় এসব দিয়ে ভরাট করে আগুনে পুড়িয়ে দিলে গর্তটা শোধন হয়ে যাবে।
প্রতিটি গর্তের জন্যে ১০ কেজি পচা গোবর বা কম্পোস্ট এবং ১ কেজি খোল গর্তের উপরের অর্ধেক মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে গর্তের তিন-চতুর্থাংশ ঐ মাটি দ্বারা ভরে ফেলতে হবে। সাধারণত মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চারা রোপণ করা যায়। তবে জুন-জুলাই মাস চারা রোপণের জন্য উপযোগী। মাদার দূরত্ব অর্থাৎ চারার দূরত্ব বর্গাকার পদ্ধতিতে ৪ হাত এবং আয়াতাকার পদ্ধতিতে লাইন থেকে লাইন ৮ হাত এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৪ হাত।
বীজতলা তৈরী(SeedBed):
প্রতিটি বীজতলা ১-১.৫ মিটার চওড়া এবং ৩ মিটার লম্বা হওয়া উচিত। বীজতলা উত্তর দক্ষিণে লম্বা হলে ভালো হয়। দুই বেডের মাঝখানে চলাফেলার জন্য দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ বরাবর ৫০-৭৫ সেমি বা ২০-৩০ ইঞ্চি
জায়গা ফাঁকা রাখতে হয়। এরূপ ফাঁকা স্থানের মাটি তুলে নালা তৈরি করতে হবে এবং নালার মাটি বীজতলায় তুলে দিয়ে বীজতলাকে বেড আকারে ৬-৮ সেমি উঁচু করতে হবে।
বীজ রোপণ:
বীজ সংগ্রহ করার পর বীজতলায় বীজ রোপণ করতে হবে। বীজ রোপণের সময় সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেমি বা ১২ ইঞ্চি এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব হবে ২৫ সেমি বা ১০ ইঞ্চি। বীজ ১-২ সেমি. গভীরে এমনভাবে রোপণ করতে হবে যাতে বীজটি মাটির সামান্য নিচে থাকে এবং বীজের উপরে মাটির একটা পাতলা আবরণ থাকে।
সার প্রয়োগ(Fertilizer):
রাসায়নিক সার ২ ভাগে ভাগ করে বছরে ২ বার গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে (প্রথমবার সেপ্টেম্বর মাসে এবং দ্বিতীয়বার ফেব্রুয়ারি মাসে)।
সুপারি গাছ থেকে ভালো ফলন পেতে গাছের বয়স এক বছর হলে প্রতি গাছের জন্য ২০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০০ গ্রাম এমওপি সার ২ ভাগ করে এক ভাগ বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক সার ভাদ্র-আশ্বিন মাসে প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স ২ বছর হলে ৪০০ গ্রাম ইউরিয়া, ২০০ গ্রাম টিএসপি এবং ২০০ গ্রাম এমওপি একই ভাবে দুইভাগ করে একভাগ শুস্ক মৌসুমে অপর অংশ বর্ষায় প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স ৩ বছর হলে ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া, ২৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ২৫০ গ্রাম এমওপি সার একইভাবে দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স ৪-১০ বছর হলে ৬০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৩০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৩০০ গ্রাম এমওপি সার অনুরূপভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
রোগবালাই ও দমন(Disease management system):
কুঁড়ি পচা রোগ:
এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ ক্ষেত্রে ছত্রাক জীবাণু মোচার গোড়ায় কাণ্ডের সংযোগ স্থলের নরম টিস্যু আক্রমণ করে। আক্রান্ত স্থানের টিস্যু প্রথমে হলুদ ও পরবর্তীতে বাদামী রঙ ধারণ করে এবং শেষ পর্যায়ে পচে কালো হয়ে কুঁড়িগুলো ঝরে পড়ে।
প্রতিকার:
রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া মাত্রই আক্রান্ত স্থান চেছে ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু পরিষ্কার করে ‘বোর্দো পেস্ট’ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত স্থান ব্যান্ডেজ করে দিতে হবে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে গাছের পাতা ও মোছায় ১% বোর্দো মিক্সার অথবা ১.৫% কুপ্রাভিট ১৫-২০ দিন অন্তর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে। মৃত গাছ, ফলপচা রোগে আক্রান্ত মোচা ও ফল সরিয়ে পুড়ে ফেলতে হবে এবং বাগানের সমস্ত গাছে ১% বোর্দো মিক্সার অথবা কুপ্রাভিট স্প্রে করে সকল গাছ ভিজিয়ে দিতে হবে।
লেদা পোকা:
এ পোকার মথ কচি মোচায় ছিদ্র করে ডিম পাড়ে। ডিম থেকে ক্রীড়া বের হয়ে অফুটন্ত মোচার ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং মোচার মধ্যে কচি-ফুলগুলো খেতে থাকে এবং মল ত্যাগ করে সম্পূর্ণ মোছাটাকেই পূর্ণ করে ফেলে। আক্রান্ত মোচায় ফুল আসে না এবং মোচাটিও ফুটে না।
প্রতিকার:
আক্রান্ত মোচা সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে। আক্রান্ত গাছসহ সকল গাছে ১০ লিটার জলের সঙ্গে ৬ চা চামচ সুমিথিয়ন মিশিয়ে ১৫-২০ দিন পরপর ২-৩ বার মোচায় স্প্রে করতে হবে।
ফসল সংগ্রহ:
সুপারির চারা লাগানোর পর সঠিকভাবে যত্ন নিলে ৪-৫ বছরের মধ্যেই ফলন আসতে শুরু করে। গাছে ফুল আসার পর থেকে ফল পাকতে ৯-১০ মাস বয়স লাগে। সাধারণত সুপারি গাছ ১০-৪০ বছর পর্যন্ত সর্বোচ্চ ফলন দিয়ে থাকে |
নিবন্ধ: রায়না ঘোষ
আরও পড়ুন -Cashew Farming: অধিক লাভে জুলাইয়ে রোপণ করুন কাজুর চারা