শীতকাল কৃষিজীবীদের কাছে এক পরম আনন্দের সময়। কৃষকদের তৎপরতায় এই ঋতুতেই শস্যক্ষেত্র ভরে ওঠে সবুজ শাক-সবজিতে। শীতকালীন অজস্র প্রকার সবজির মধ্যে গাজর অন্যতম। ইংরেজিতে এই সবজির নাম Carrot। বৈজ্ঞানিক নামানুসারে গাজরকে Daucus carota বলা হয়। গোটা বছর ধরেই গাজর চাষ হলেও, শীতকালে এই সবজির ফলন খুব ভালো পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়। তরকারি ও সালাদ হিসাবে গাজরের চাহিদা খাদ্যরসিকদের কাছে বরাবরের প্রিয়। এই সবজি রেখে দিলে সহজে নষ্টও হয় না। তুলনামূলক লাভজনক এই সবজি চাষে বহু কৃষকভাই ভালোরকমের সুবিধাও পেয়েছেন।
গাজর চাষের উপযুক্ত মাটি ও জলবায়ু:
বেলে দোঁ-আশ মাটি গাজর চাষের পক্ষে সবথেকে উপযুক্ত। আশ্বিন থেকে কার্তিক অর্থাৎ মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য নভেম্বর মাস গাজরের বীজ বপনের সবথেকে উপযোগী সময়। ঠান্ডা আবহাওয়ায় গাজরের ফলন ভালো হয়। গাজর চাষের জন্য উঁচু জমি যেখানে রোদ পড়ে সেরকম জায়গা নির্বাচন করা উচিত।
গাজরের জাত :
গাজরের বিভিন্ন জাতের মধ্যে রয়েল ক্রস, কোরেল ক্রস, কিনকো সানটিনে রয়েল ও স্কারলেট নান্টেস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও পুষা কেশর, নিউ কোয়ারজা, সানটিনি, ইয়োলো রকেটের মতন জাতগুলোও কৃষকদের অত্যন্ত প্রিয়।
জমি প্রস্তুতকরণ:
১. গাজরের শেকড় মাটির বেশ গভীরে প্রবেশ করে বলে, গাজর চাষের জমি ৮-১০ ইঞ্চি গভীর করে চাষ করতে হবে।
২. জমিতে ৪ থেকে ৫টি চাষ দিলে এবং মই দিয়ে জমি ভালোভাবে তৈরি করলে গাজরের ফলন ভালো হবে।
৩. জমির মাটি ঝুরঝুরে করতে হবে।
৪.গাজরের বীজ সারিতে বপন করলে গাজরের যত্ন নিতে সুবিধা হয়। তাই ৮-১০ ইঞ্চি দূরত্ব রেখে সারি তৈরি করা উচিত।
বীজ বপন পদ্ধতি:
১. জমিতে বীজ পোঁতবার আগে গাজরের বীজ একদিন ভিজিয়ে রাখা উচিত
২. গাজরের বীজ খুব ছোট আকারের হয়। বীজ বপনের সময় তাই বীজের সঙ্গে ছাই বা মাটির গুঁড়ো মিশিয়ে নিলে সুবিধা পাওয়া যায়।
৩. সারিতে বীজ লাগালে। ২-৩ ইঞ্চি দূরত্ব রেখে বীজ বপন করতে হবে।
সার প্রয়োগের পদ্ধতি:
গাজরের ভালো ফলনের জন্য গাজর চাষের জমিতে বেশি পরিমানে জৈব সার প্রয়োগ করা উচিত। মাটিতে জৈব সার দিলে মাটির গুণাগুণ দিনকে দিন উন্নত হবে। হেক্টরপ্রতি গাজর চাষে সার প্রয়োগের পদ্ধতি নিম্বরূপ -
সার | সারের পরিমাণ(প্রতিহেক্টরে) |
গোবর/জৈবসার | ১০ টন |
ইউরিয়া | ১৫০ কেজি |
টিএসপি | ১২৫ কেজি |
এমপি/এসওপি | ২০০ কেজি |
সারের পরিমাণ(প্রতি হেক্টরে) -
সম্পূর্ণ গোবর ও টিএসপি এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও এমপি সার জমি তৈরি করার সময় প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া চারা গজানোর ১০-১২দিন ও ৩৫-৪০ দিন পর সমান ভাবে দুই কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। একই রকম ভাবে বাকি অর্ধেক এমপি সার গজানোর ৩৫-৪০ দিন পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
পরিচর্যা:
বীজ বপন হয়ে গেলে গাজরের ক্ষেতে হালকা সেচ দেওয়া ভালো। সেচের পর জমিতে জো দেখা দিলে নিড়ানির মাধ্যমে চটা ভেঙে মাটি আলগা করে দেওয়া উচিত। চারা বের হওয়া শুরু হলে আরও একবার সেচ দিলে বীজের অঙ্কুরোদ্গম ভালো হয়। ফসল তোলার সময় প্রয়োজন পড়লে আরও একবার সেচ দেওয়া যেতেই পারে। জমিতে জল জমলে, সেই জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা উচিত, নাহলে ফসলকে বড়সড় ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
আরও পড়ুন - বাড়িতে বসেই সুস্বাদু স্ট্রবেরি পেতে চান? নিজের ছাদ বাগানে সহজেই করতে পারেন স্ট্রবেরি চাষ
পোকামাকড় ও রোগ দমন:
গাজরের হলুদ ভাইরাস রোগ:
লীফ হপার পোকা গাজর চাষের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হতে পারে। এই পোকার উপস্থিতিতে গাজরে হলুদ ভাইরাস রোগের প্রার্দুভাব লক্ষ্য করা যায়। এই জাতীয় পোকা আক্রমণ করলে, গাজরের কচি পাতাগুলি হলুদ হয়ে কুঁকড়িয়ে যায়। এরফলে দেখতে দেখতে গাছের পাতার পাশের ডগাগুলি হলুদ ও বিবর্ণ হয়ে পড়ে। লীফ হপার পোকা থেকে গাজরকে বাঁচাতে হলে, আক্রান্ত ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে, সাথে সাথে চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। সবিক্রন ৪২৫ ইসি, রেলোথ্রিন-এর মতন কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগে এই পোকার দমন হতে পারে।
পচা রোগ:
গাজর চাষে প্রায়শ এ রোগের আক্রমণ দেখা যায়। গাজরের মূল ও পাতার গোড়ায় ব্যাক্টেরিয়াজনিত কারণে এই পচন রোগ ধরে। নাইট্রোজেন সারের অতিরিক্ত প্রয়োগে এই রোগ বিস্তার লাভ করে। এই রোগ থেকে সদ্য জন্ম নেওয়া গাজরকে বাঁচাতে হলে ইউরিয়া সারের অতিরিক্ত প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।
জাবপোকা:
গাজর চাষে জাব পোকার আক্রমণ একটি কঠিন বিষয়। এই পোকা গাছের পাতা ও কচি অংশের রস শোষণ করে ফসলের সর্বনাশ করে দিতে সক্ষম। এই পোকার আক্রমণ থেকে গাজরকে বাঁচাতে হলে, রগোর এল -৪০, ক্লাসিক ২০ ইসি, এসপি, টিডো ২০ এসএল প্রভৃতি কীটনাশকের যে কোন একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় প্রয়োগ করা যেতে পারে।
ফসল সংগ্রহ:
জমিতে চারা গজিয়ে যাওয়ার ৭০-৮০ দিন বাদে গাজর সবজি হিসেবে খাওয়ার জন্য উপযুক্ত হয়। তবে ভালো ও পুষ্টিকর গাজরের জন্য বীজ বোনার ১০০ থেকে ১২৫ দিনের ভিতর ফসল সংগ্রহ করা উচিত।
নিবন্ধ - কৌস্তভ গাঙ্গুলী
আরও পড়ুন - জানুন এলাচ চাষের জন্য কেমন মৃত্তিকার প্রয়োজন ও তার চাষের পদ্ধতি