চন্দ্রমল্লিকা ফুলের রূপে মুগ্ধ হন না এমন মানুষ গোটা পৃথিবীতে কেউ আছে বলে জানা নেই। অনুষ্ঠান বাড়ির ডেকোরেশন থেকে বিভিন্ন পুষ্প প্রদর্শনী-- চন্দ্রমল্লিকার সৌন্দর্য্যের আবেদন জুড়ি মেলা ভার। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই চন্দ্রমল্লিকা ফুল ফোটে। গ্রিনহাউস পরিবেশে এই ফুলের ফলনও খুব আশাবাচক। চন্দ্রমল্লিকা ফুল কম্পোজিট (Compositae) গোত্রের অন্তর্গত বলে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত। ক্রিসমাস অর্থাৎ ডিসেম্বর নাগাদ এই ফুল ফোটে বলে এর ইংরেজি নাম দেওয়া হয়েছে ক্রিসেন্থিমাম। জাপান ও চীন এই দুই দেশ মূলত এই ফুলের আদি উৎসস্থল। ভারতে চন্দ্রমল্লিকা ফুলের বাজার বেশ ভালো। এই ফুলের চাষ আমাদের রাজ্যেরও বিভিন্ন জায়গায় করা হয়। এই ফুল মূলত গুল্মজাতীয়। এই বিশেষ শ্রেণীর বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ ৫০-১৫০ সেমি পর্যন্ত উচ্চতা পর্যন্ত বাড়তে পারে।
চন্দ্রমল্লিকা ফুল চাষের পদ্ধতি: ( cultivation of Chrysanthemum)
মাটি (Soil)
উন্নতমানের নিষ্কাশন হয় এমন লাল দো-আঁশ মাটি চন্দ্রমল্লিকা চাষের জন্য ভালো বলে বিবেচিত হয়। মাটি যাতে জৈব উপাদান সমৃদ্ধ হয় তা খেয়াল রাখতে হবে। মাটির প্রকৃতি পিএইচ ৬.০-৭.০ হলে চাষের পক্ষে তা অত্যন্ত মঙ্গল।
জমি প্রস্তুতি (Field making)
চন্দ্রমল্লিকা ফুল ফোটানোর জন্য ভাল চাষ করা জমির দরকার। মাটি সূক্ষ্ম হলে এই ফুলের ফলন ভালো হয়। এর জন্য কম করে ২-৩ বার মাটিতে চাষ দেওয়া দরকার। শেষবার চাষ দেওয়ার সময়, একর পিছু ৮-১০ টন গোবর দিতে হবে।
বীজ বপন (Seed sowing)
ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে সাকার রোপণ করে নিয়ে, জুন থেকে জুলাই মাসের মধ্যে শাখা কলম রোপণ করে নিতে হবে। মে-জুলাই মাস নাগাদ চন্দ্রমল্লিকা চারাকে বৃষ্টি ও প্রখর রোদের চোখরাঙানি থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। গাছ রোপনের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে সারি সারি এবং গাছে গাছে ৩০ সেমি ব্যবধান থাকে। প্রপাগেশন পদ্ধতি ব্যবহার করে চন্দ্রমল্লিকা চাষ করা গেলে আখেরে লাভের মুখ দেখবেন চাষি ভাইয়েরাই।
বিস্তার
চন্দ্রমল্লিকার বংশবৃদ্ধি মূলত সাকার এবং শাখা কলম পদ্ধতি ব্যবহার করে করা হয়। শাখা কলম পদ্ধতি প্রয়োগ করলে, এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে জুনের শেষ অবধি স্বাস্থ্যকর গাছের অংশবিশেষ উপরের থেকে ৪-৫ সেন্টিমিটার কেটে নিতে হয়। শিকড় কাটিং হয়ে গেলে Ceresan@0.2% বা ক্যাপ্টেন @০.২১% দিয়ে শোধন করে নিলে রোপণের উপযোগী হয়। সাকার পদ্ধতিতে, মাটির ঠিক উপরের কাণ্ডটি কাটা হয়। পরে সাকারগুলিকে মাদার গাছ থেকে আলাদা করে বীজতলায় বা টবে কিছুদিনের জন্যে রাখা হয়।
বীজ (Seed)
বীজের হার
৪৫,০০০ উদ্ভিদ প্রতি একর জমিতে রোপণের জন্যে ব্যবহার করা উচিত
বীজের শোধন (Seed purification)
মাটি বাহিত রোগ থেকে চারা রক্ষার জন্য কাটাগুলি Ceresan@0.2১ বা ক্যাপ্টেন @ ০.২১% দিয়ে শোধন করে নিলে ভালো।
সার (Fertilizer)
সারের প্রয়োজনীয়তা (কেজি / একর)
ইউরিয়া এসএসপি এমওপি
১৬০ ৫০০ ১৩৩
পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা (কেজি / একর)
নাইট্রোজেন ফসফরাস পটাশ
৭৩ ৮০ ৮০
শেষবার চাষ করার সময় ইউরিয়া @ ১৬০ কেজি / একর, এসএসপি @ ৫০০ কেজি / একর এবং এমওপি @ ১৩৩ কেজি / একর সারের পরিমাণ যোগ করে চাষের ফলন ভালো হবে।
আগাছা নিয়ন্ত্রণ (Parasite control)
জমিকে আগাছা থেকে বাঁচাতে এবং গাছের যথাযথ বিকাশের জন্য ২ থেকে ৩ বার হাত দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে। প্রথম আগাছা দমন বীজ রোপণের ৪ সপ্তাহ পর করা উচিত বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। চারা লাগানোর কয়েক মাস পর গাছের আগা কেটে দিলে গাছ লম্বা হতে পারে না, বরং ঝোপালো হয়ে ওঠে।
সেচ: (Irrigation)
চন্দ্রমল্লিকা চাষে সেচ কতটা দিতে হবে তা মাটির অবস্থার উপর নির্ভর করে। চন্দ্রমল্লিকার চারা বিকেলের দিকে রোপণ করা উচিত। চারা লাগানোর পর গোড়ার দিকের মাটি থুপে থুপে চেপে দিতে হয়। হালকা সেচ দেওয়া চারা লাগানোর পর আবশ্যক। চন্দ্রমল্লিকা চাষের মাটি উত্তম প্রকারের নিষ্কাশন ক্ষমতা সম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন। যাতে মাটি তাড়াতাড়ি জল টেনে নেয়। প্রধানত প্রথম মাসে সপ্তাহে দু'বার করে সেচ দিতে হয় এবং পরবর্তী সেচগুলো সপ্তাহ ছেড়ে ছেড়ে দিতে হয়।
চন্দ্রমল্লিকার রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ (Chrysanthemum disease-pest control)
কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ
জাব পোকা:
প্রধানত এটি ফুল ফোটার সময় দেখা দেয়। এই পোকাগুলি ডাঁটা, কাণ্ড, ফুল, কুঁড়ি ইত্যাদি চুষে নিতে থাকে। যদি পোকা দেখা যায় তবে Rogor ৩০ ইসি বা Metasystox ২৫ ই সি @ ২ মিলি/লিটার স্প্রে করতে হবে।
ফড়িঙ:
যদি পোকামাকড় লক্ষ্য করা যায় তবে Rogor 30 ইসি @ 2 মিলি বা Profenofos ২৫ ই সি @ ২ মিলি / লিটার স্প্রে করতে হবে।
আমেরিকান শুঁয়োপোকা:
এই শুঁয়োপোকা গাছের পাতা খায় এবং গাছের কুঁড়ি ও ফুল বিনষ্ট করে দেয়। আমেরিকান শুঁয়োপোকা রোগ নিয়ন্ত্রণে Nuvacron(Dichlorophos) @ ২-৩ মিলি/ লিটার স্প্রে করা হয়।
রোগ নিয়ন্ত্রণ (Disease control)
ব্ল্যাক লীফ স্পট বা কালো পাতার স্পট:
Septoria Chrysanthemella এবং S. obesa মাধ্যমে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই রোগের ফলে পাতায় ধূসর বাদামি বর্ণের বৃত্তাকার দাগ সৃষ্টি হয়। পাতাগুলি শেষে হলুদ হয়ে মারা যায়। এই রোগ নিয়ন্ত্রণে Zineb বা Dithane এম-৪৫ @ ৪০০ গ্রাম / একর স্প্রে করা হয়।
পাতা কোঁকড়ানো:
এই রোগে পাতা বাদামি হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত হলুদ হয়ে মারা যায়। আক্রান্ত স্থানে ১৫ দিনের মধ্যেই Dithane এম -৪৫ @ ৪০০ গ্রাম /একর স্প্রে করতে হবে।
পাউডারি মিলিডিউ:
Oidium chrysanthemi এর ফলে এই রোগের উদ্ভব। সাদা পাউডারের মত পদার্থ পাতা এবং কান্ডে লক্ষ্য করা যায়। এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে Kerathane ৪০ ইসি @ ০.৫% স্প্রে করতে হবে।
ফসল তোলা: (Harvesting)
রোপণের প্রায় ৫-৬ মাস বাদেই ফুল বিক্রির উপযোগী হয়ে যায়। অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে ফুল সংগ্রহ করা হয়। সকালে রড ওঠার আগে ফুল তোলা শুরু করা উচিত। একটি গাছ থেকে বছরে গড়ে কমপক্ষে ৩০-৪০টি ফুল পাওয়া যায়।