রাত্রির নৈসর্গিক সৌন্দর্যে বিকশিত হওয়া সুমিষ্ট গন্ধযুক্ত রজনীগন্ধা বেডে যখন সম্পূর্ণ রূপে প্রস্ফুটিত হয়, যখন চন্দ্রকিরণ এর ওপর পূর্ণমাত্রায় এসে পড়ে, তখন শুধু উদ্যানের সৌন্দর্য বর্ধনই হয় না, এক অপরূপ সৌন্দর্যময় পরিবেশেরও সৃষ্টি হয়। এই ভেষজ বহুবর্ষজীবী কন্দযুক্ত আলংকারিক উদ্ভিদটি বাণিজ্যিকভাবে পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘকাল থেকেই চাষ করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ পুষ্প উৎপাদকরা রজনীগন্ধার চাষ করে উন্নমিত হয়েছেন। তবে বর্তমানে, এই রাজ্যে রজনীগন্ধা চাষে কন্দক্ষেত্রে সমস্যা এবং কৃষকদের বেশ কয়েকটি সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রধান সমস্যাগুলির মধ্যে, আগাছা ব্যবস্থাপনা একটি গুরুতর বিষয়। এখন রাজ্যে এই ফুলের উত্পাদনশীলতা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। এমনকি কৃষকদের থেকে জানা যায়, মোট ব্যয়ের ৪০ শতাংশ শুধুমাত্র আগাছা ব্যবস্থাপনায় খরচ হয়। এই সমস্যার সমাধান করতে, বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয় ৪০ মাইক্রন কালো পলি মালচিং প্রয়োগের মাধ্যমে গত তিন বছরে রজনীগন্ধার চাষের ক্ষেত্রে আগাছা সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং পলি মালচিং প্রয়োগ করে দেখা গেছে যে, বিধান উজ্জ্বল, ফুলে রজনী, প্রজ্জ্বল এবং কলকাতা সিঙ্গেল প্রভৃতি জাতের তুলনামূলকভাবে ৪০.৫, ৩৬.৬, ১১.৭ এবং ৮.০ শতাংশ পর্যন্ত মুক্ত ফুলের ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে।
ক্ষেত্র প্রস্তুতি, রোপণ এবং মালচিং (sub heading) – সঠিক নিকাশী ব্যবস্থা সহ উন্নত সমতলভূমি এই ফসলটির জন্য উপযুক্ত। উদ্ভিদটি চাষের জন্য প্রচুর পরিমাণে জলের প্রয়োজন হয়, কারণ মাটি সারা বছর আর্দ্র রাখতে হয়। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, জল যেন জমিতে দাঁড়িয়ে না থাকে। কারণ জমিতে দাঁড়িয়ে থাকা জল, বিশেষত শীত ও বর্ষাকালে তা ফসলের জন্য ক্ষতিকারক। জলাবদ্ধতা স্বল্প সময়ের জন্য হলেও, তা মূল পদ্ধতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করে এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং ফলনকে প্রভাবিত করে। ৩-৪ বার ভূমি কর্ষণের পরে সকল আগাছা অপসারিত করতে হবে। অন্তিম ভূমি কর্ষণের সময় প্রতি হেক্টরে ২৫০ কেজি হারে গোবর সার ও নিম কেক (১৫ টন) একত্রে প্রয়োগ করতে হবে। এরপর প্রস্থে ৩ ফুট এবং ৬ ইঞ্চি উচ্চতার বেড প্রস্তুত করতে হবে, দৈর্ঘ্য ক্ষেতের আকারের উপর নির্ভর করে, বেডের মধ্যে আভ্যন্তরীণ কর্ষণের জন্যে এক ফুট জায়গা থাকতে হবে এবং সেচ ও নিকাশী ব্যবস্থা ভালো থাকতে হবে। এই উদ্ভিদটি কন্দের মাধ্যমে প্রসার লাভ করে। রজনীগন্ধা রোপণের পর ধীরে ধীরে এর কন্দগুলি ৪.৫-৫ সেন্টিমিটার ব্যাসের এবং স্বাস্থ্যকর ও পরিপক্ক হয়ে ওঠে। রোপণের আগে কন্দগুলিকে ছত্রাকনাশক (ব্লিটক্স ২ গ্রাম / লিটার) জলে প্রয়োগ করে ২০ মিনিটের জন্য সেই জলে দ্রবীভূত করা হয়। এরপর কন্দগুলি ১ দিনের জন্য সাধারণ তাপমাত্রায় শুকানো হয়। এক হেক্টর জায়গায় রজনীগন্ধা চাষের জন্য প্রায় এক লক্ষ ষাট হাজার কন্দ লাগবে।
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে রজনীগন্ধার কন্দ রোপণ করা হয়, তবে পশ্চিমবঙ্গে দক্ষিণ অঞ্চলে, মার্চ-এর মধ্যবর্তী সময় থেকে এপ্রিল-এর মধ্যবর্তী সময় এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যবর্তী সময় থেকে অক্টোবরের মধ্যবর্তী সময়ে এর কন্দগুলি রোপণ করা হয়। সাধারণত একটি উদ্ভিদের থেকে অপর উদ্ভিদ ২০ সেমি. দূরত্ব এবং এক সারি থেকে অপর সারি ৩০ সেমি. দূরত্ব বজায় রেখে রোপণ করা হয়। রোপণের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখা উচিত, তা হল, কন্দগুলি মাটির পৃষ্ঠ থেকে ৪-৫ সেন্টিমিটার গভীরে স্থাপন করা হয়। কন্দ রোপণের আগে বেড ৪০ মাইক্রন কালো পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এবং ৫ সেন্টিমিটার ব্যাসের গর্ত করতে হবে। এরপর এক সারি থেকে অপর সারি ২০*৩০ সেমি. দূরত্বে কন্দগুলি রোপণ বা গর্তগুলিতে স্থাপন করা হয়।
রজনীগন্ধা চাষে ভূমি উত্তোলন খুবই জরুরী। অন্তিম ভূমি কর্ষণের পর ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য এক হেক্টর জমিতে এফওয়াইএম সার ১৫ টন ভার্মিকম্পোস্ট সহ ১৪০০ কেজি প্রয়োগ করতে হবে। রজনীগন্ধার সর্বোচ্চ ফলন পাওয়ার জন্য এনপিকে ২০০:২০০:২০০ অনুপাতে প্রতি হেক্টরে প্রয়োগ করতে হবে।
স্বপ্নম সেন (swapnam@krishijagran.com)
তথ্যসূত্র - ড. তাপস কুমার চৌধুরী