চিনের জিন সাম্রাজ্যের নথিতে প্রথম বনসাই পদ্ধতির উল্লেখ পাওয়া যায়, যদিও সেখানে বনসাই-এর বদলে ‘পেনজাই’ শব্দটি ছিল। পরবর্তীকালে জাপানিরা চিনাদের কাছ থেকে বনসাই সংস্কৃতি গ্রহণ করে। এক জাপানি জেন সন্ন্যাসী তাঁর লেখায় প্রথম ‘বনছেকি’ শব্দটা ব্যবহার করেন, ধরা হয়, সেখান থেকেই এসেছে বনসাই।
প্রথমদিকে জাপানিরা এই খর্বাকৃতি গাছ দিয়ে ঘরবাড়ি সাজাতেন। পরে বনসাই দিয়ে বড় বড় বাগান তৈরি শুরু হয়। প্রাচীন বনসাইগুলো আজও সে দেশের সম্পদ। উৎপত্তি চিনে হলেও বিশ্বে এটিকে জনপ্রিয় করতে জাপান অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে। সহজ ভাবে বনসাই বলতে বড় গাছের মিনিয়েচার বা ক্ষুদ্র সংস্করণকে বোঝায়। বনসাই শব্দটি একটি জাপানি শব্দ, ‘বন’ মানে অগভীর ছোট পাত্র, ‘সাই’-এর অর্থ মাটিতে পুঁতে দেওয়া গাছ। সামগ্রিকভাবে এটি আধুনিক বাগিচার জীবন্ত ভাস্কর্য শিল্প, ক্ষুদ্রের মধ্যে বৃহৎ প্রাকৃতিক শিল্পকলা সৃষ্টিই যার গূঢ় রহস্য। বনসাই এর উচ্চতা ১৫-১২০ সেমি পর্যন্ত হয়ে থাকে। ১৫ সেমি উচ্চতার বনসাইকে মেইম বা মিনি বনসাই বলে।
শ্রেণীবিভাগ (Classification) -
সাধারণত বনসাই এর আকার, আকৃতি, উচ্চতা, সংখ্যা ও পটের উপর কান্ডের অবস্থান এবং শাখাপ্রশাখার বিন্যাসের উপর ভিত্তি করে বনসাই -এর শ্রেণীবিভাগ করা হয়।
বনসাই কে দু’ভাগে ভাগ করা যায় -
(১) সাইকেই (Saikei) -
থালা জাতীয় টবে গাছপালা, পাহাড়, পর্বত, নদী, ঝরণা ইত্যাদি সহকারে একটি আকর্ষণীয় ভূমিরূপ তৈরি করাকে সাইকেই বলে। এটি উদ্ভিদ ও জড় পদার্থের সমন্বয়ে করা হযে থাকে।
(২) সুইসেকি (Suiseke) -
সুইসেকি হলো থালা জাতীয় টবে কেবল জড় পদার্থ দিয়ে তৈরি ভূমিরূপ।
বনসাই স্টাইল (Bonsai style) -
রীতি সিদ্ধ সোজা খাড়া ভঙ্গিমা (Formal Upright Style) -
কাণ্ডের গোড়া থেকে আগা একই সরলরেখায় অবস্থান করে। একেবারে খাড়া কান্ডের শাখাপ্রশাখা কান্ডের ১/৩ ভাগ বাদ দিয়ে উৎপন্ন হবে। শাখাগুলো ডানে বামে কাণ্ডের সাথে ৯০ ডিগ্রী কোণে অবস্থান করে। যেমন- দেবদারু, জুনিপেরাস।
রীতি বর্জিত মামুলী খাড়া ভঙ্গিমা (Informal Upright Style) -
কাণ্ড এখানে কিছুটা আঁকাবাকা থাকে। এর কান্ডের নীচের দিকে বড় এবং উপরের দিকে ছোট বাঁক দেখা যায়। শাখা প্রশাখা সমেত বনসাইটি কোনাকৃতি হয়। যেমন - অশ্বথ, লেবু, পাতি নিম ইত্যাদি।
হেলানো কান্ড (Slanting Style) -
ডগা সমেত বনসাইটি ১০-৪৫° কোণ পর্যন্ত একদিকে হেলে থেকে ফরমাল আপরাইট ষ্টাইলে ৯০° কোণে খাড়া থাকে। পুকুর ধারে এ ধরণের ষ্টাইলে গাছ দেখা যায়।
ঝড়ের বেগে হেলানো ভঙ্গিমা (Wind swept Style) -
ঝড়ের বেগে হেলে পড়া গাছের মত দেখতে হয়। ক্রমাগত জোরে বায়ু বইতে থাকলে গাছগুলোকে যেমন একদিকে হেলে থাকতে দেখা যায় ঠিক তেমন ভঙ্গিমা।
কাষ্ঠল কান্ডযুক্ত জ্বরাগ্রস্ত - বৃক্ষের ভঙ্গিমা (Drift wood Style) -
পরিণত অবস্থায় বৃক্ষের ছাল সরে গেলে হুবহু জ্বরাগ্রস্ত বৃক্ষের চেহারা নেয়।
গুঁড়িযুক্ত বনসাই ক্যাসকেড (Cascade) -
এই স্টাইলে গভীর টব ব্যবহৃত হয়। গোড়ার কাণ্ড হতে টব বেশ উঁচুতে উঠে জলপ্রপাতের মত নীচুতে টবের নীচে নেমে আসে।
সেমি কাসকেড (Semi Cascade) -
ক্যাসকেডের মতই, তবে আগা সাধারণত টবের উপরের মাটির লেভেল থেকে নীচে যায় না।
জোড় কাণ্ড (Twin Trunk) -
দুটো কাণ্ডের একই শিকড় থাকে। একটি কাণ্ড অন্যটির চেয়ে দ্বিগুণ মোটা হবে এবং সেটি লম্বায়ও অন্যটির দ্বিগুণ হবে।
বনবীথি (Group Style Yose-se) -
এ স্টাইলে ৩-৯ টি বা বিজোড় সংখ্যক গাছ একই টবে বসানো হয়। সবগুলো গাছ অসমান হয় এবং গাছগুলো আগে পিছে থাকে।
কাণ্ড পেঁচানো (Twisted Trunk) -
এতে কাণ্ডগুলো পরস্পর পেঁচানো থাকে।
শিলাশ্রয়ী ভঙ্গিমা (Clasped to Stone Style) -
এই ভঙ্গিমায় একাধিক গাছ একটি অমসৃণ টিলা সদৃশ পাথরের গহ্বরে থাকে। গাছগুলোর শিকড় গহ্বরের মধ্যেই থাকে।
আরও পড়ুন - জেনে নিন চন্দ্রমল্লিকা ফুল চাষের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম
যে কোনও ভালো নার্সারি থেকে ভালো বনসাই সংগ্রহ করা যেতে পারে কিন্তু সময় ও ধৈর্য থাকলে নিজের হাতেও তৈরি করা যায় বনসাই। দীর্ঘকাল সযত্নে ছোটো আকৃতিতে গাছকে বাড়িয়ে তোলার ফলে এর পাতার আকৃতি এক-চতুর্থাংশ হয়ে গেলেও ফুল বা ফলের আকৃতিতে পরিবর্তন কম হয়, তাই অবশ্যই গাছ নির্বাচনের সময় খেয়াল রাখতে হবে গাছে ফুল-ফল যেন ছোট আকৃতির হয়। এছাড়া যেসব গাছ বা গুল্মের শাখা-প্রশাখা বাঁকা, কান্ড সহজেই বাঁকানো যায়, বনসাই-এর জন্য সেগুলো আদর্শ। এদেশের আবহাওয়ায় বট, অশ্বত্থ, পাকুড়, শিমুল, তেঁতুল, পলাশ, ছাতিম, জাম, নিম, পেয়ারা, ডালিম, কমলালেবু, কৃষ্ণচূড়া, দেবদারু, কনকচাঁপা, বাগানবিলাস, চিনা বাঁশ ইত্যাদি গাছের বনসাই ভালো হয়।
আরও পড়ুন - সুগন্ধি মন মাতানো জুঁই ফুলের চাষ করতে চান? জেনে নিন পদ্ধতি